স্বমহিমায় সুনীল গাওস্কর। ছবি টুইটার থেকে নেওয়া।
টেস্টে প্রথম ১০ হাজার রান। ডন ব্র্যাডম্যানকে টপকে ৩৪ সেঞ্চুরির রেকর্ড। পরে ধারাভাষ্যকার ও লেখক হিসেবেও খ্যাতির শিখরে। সুনীল গাওস্করের কেরিয়ারে রয়েছে এমন অনেক অমূল্য রত্ন। কিন্তু, তার মধ্যে একটা দিকই তেমন উজ্জ্বল নয়। তা হল নেতৃত্ব। তিনি নাকি ছিলেন ডিফেন্সিভ ক্যাপ্টেন। অধিনায়ক হিসেবে কেমন তিনি, সেটাই ফিরে দেখলেন তাঁর একদা সতীর্থরা।
নেতা সুনীল
কারসন ঘাউড়ি: স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার মতো নিরাপদ ক্যাপ্টেন ছিলেন গাওস্কর। হি ওয়াজ ভেরি সেফ। নিরাপদ বলতে বোঝাতে চাইছি যে, ভারত জিতলে তো অবশ্যই দুর্দান্ত, যদি ড্র করে তা হলেও মন্দ নয়, কিন্তু হারা চলবে না। সুনীলের নেতৃত্বে পরাজয়ে তীব্র অপছন্দ ছিল ভারতের। নিরাপদ ছিল বলেই স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার কথা বলছি। কারণ, সবচেয়ে নিরাপদ ব্যাঙ্ক হল এটাই।
গাওস্করকে নিরাপদ নেতা বলে চিহ্নিত করলেন কারসন ঘাউড়ি।
সদানন্দ বিশ্বনাথ: দুর্দান্ত নেতা। সবার থেকে সেরাটা বের করে আনতে পারতেন। প্রত্যেকের সর্বোচ্চ পারফরম্যান্স আদায়ের ক্ষমতা ছিল। তরুণদের দারুণ ভাবে গাইড করতেন। সিনিয়র ও জুনিয়রদের একই চোখে দেখতেন। ভেদাভেদ করতেন না। জানতেন কী ভাবে সম্মান করতে হয়, কী ভাবেই বা সম্মান আদায় করতে হয়। দুর্দান্ত ব্যাটিং দক্ষতার জন্য দলের সবার শ্রদ্ধা পেতেন। আমি তো দেখেছি যে, অস্ট্রেলিয়ায় উনি জেতার জন্য ঝুঁকিও নিয়েছেন। দারুণ সব ফিল্ড সাজাতেন। সব সময় স্পিনারদের সঙ্গে কথা বলতেন। তাঁদের মতো করে ফিল্ড সাজাতেন। কখন ফিল্ড ছড়িয়ে দিতে হবে, কখন কাছে আনতে হবে, তা দারুণ ভাবে বুঝতেন। বোলারের আইডিয়াকেও কাজে লাগাতেন। বোলার যে ফিল্ড চাইত, সেটাই দিতেন। বোলারের ভাবনা অনেকেই জানতে চায় না। গাওস্কর তা করতেন না। খুব প্রো-অ্যাকটিভ, উদ্ভাবনী ক্ষমতায় ভরপুর ছিলেন। যাকে আর্ট অফ ক্যাপ্টেন্সি বলাই চলে।
মদন লাল: খুবই ভাল ক্যাপ্টেন ছিলেন। অধিনায়ক হিসেবে বেশ ভাল। সব সময় বোলারদের পাশে থাকতেন। সাহায্য করতেন ইনপুট দেওয়ার মাধ্যমে। আমি তো অনেক কিছু শিখেছি। এই যে বলা হয় ডিফেন্সিভ ক্যাপ্টেন, আমি এটা একেবারেই মানতে পারি না। বলুন তো, কোন ক্যাপ্টেন হারতে চায়। যখন জয়ের কোনও নিশ্চয়তা নেই, তখন অধিনায়ক তো স্বাভাবিক ভাবেই চেষ্টা করবে যাতে হারতে না হয়। তার মানে গাওস্কর রক্ষণাত্মক ক্যাপ্টেন ছিলেন, এমনটা নয়। যখন জেতার সম্ভাবনা থাকবে, তখনই তো আপনি জয়ের জন্য ঝাঁপাবেন। তাই না? জোর-জবরদস্তি করলে তো গণ্ডগোল হয়ে যাবে।
আরও পড়ুন: ‘মুম্বইয়ে যখন গলি ক্রিকেট খেলত, তখনও কিছুতেই আউট হতে চাইত না’
ডিফেন্সিভ ক্যাপ্টেন?
কারসন ঘাউড়ি: প্রত্যেক পরিস্থিতিতে কাজের ধরন পাল্টে যায়। আলাদা আলাদা পরিস্থিতিতে সময়ের দাবি বদলে যায়। হাতে যদি ৪৫০ রান থাকে, তখন অনেক ঝুঁকি নেওয়া যায়। কিন্তু হাতে যদি ২৫০ রান থাকে, তখন অন্য ভাবে স্ট্র্যাটেজি করতে হয়। কারণ, তখন হাতে পুঁজি কম। ফলে বেহিসেবি ঝুঁকি নেওয়া যায় না। তখন সাবধানী হতে হয়।
এই পরিস্থিতিতেও মনসুর আলি খান পতৌদি কিন্তু ঝুঁকি নিতেন। হাতে আড়াইশো থাকলেও জেতার জন্য ঝাঁপাতেন। অবশ্য টাইগারের হাতে সেই মানের বোলাররাও ছিল। প্রসন্ন, বিষেণ বেদি, চন্দ্রশেখর, ভেঙ্কটরাঘবনের উপর মারাত্মক আস্থাও ছিল পটৌডির। একনাথ সোলকার, আবিদ আলির মতো ফিল্ডারদের উপর ছিল নির্ভরতাও। তাই এই রানটাও পটৌডির কাছে ছিল জেতার মতো। উনি সব সময় ভাবতেন যে ২০০ বা ২২০ রানের মধ্যে বিপক্ষকে আউট করা যাবে। সেই বিশ্বাস ছিল বোলারদের মধ্যে। আসলে বিভিন্ন ক্যাপ্টেনের মধ্যে এই বিষয়টায় তারতম্য ঘটে।
সদানন্দ বিশ্বনাথ: দেখুন, গাওস্করের সময়ে দলের ব্যাটিং গভীরতা তেমন ছিল না। মিডল অর্ডার ব্যাটিং ছিল নড়বড়ে। জমাট ভাব ছিল না। হ্যাঁ, বিশ্বনাথ ও অমরনাথ যদিও ছিলেন। কিন্তু, তখনকার দৃষ্টিকোণে ড্র করাও ছিল দারুণ রেজাল্ট। সানি-ভাই হারতে চাইতেন না। হারতে ঘৃণা করতেন। আমি অস্ট্রেলিয়ায় বেনসন অ্যান্ড হেজেস কাপে খেলেছি গাওস্করের নেতৃত্বে। দেখেছি, কী ভাবে উনি দল চালাতেন। তাই ডিফেন্সিভ ক্যাপ্টেনের ছাপটা একেবারেই মানছি না।
অধিনায়ক গাওস্করের মস্ত বড় গুণ ছিল ম্যান-ম্যানেজমেন্ট। আমার মনে আছে, অস্ট্রেলিয়ায় আমরা আন্ডারগড হিসেবে গিয়েছিলাম। কেউ পাত্তা দেয়নি। তার আগে আমরা ডেভিভ গাওয়ারের ইংল্যান্ডের কাছে হেরেও গিয়েছিলাম। গাওস্কর কিন্তু আমাদের উদ্দীপ্ত করেছিলেন দারুণ ভাবে। আমাদের দলে তারুণ্য ও অভিজ্ঞতার দারুণ মিশেল ছিল। গাওস্করের নেতৃত্বে আমরা একটা পরিবার হয়ে উঠেছিলাম। মনে আছে তার পর শারজায় একটা কনসার্ট দেখতে গিয়েছিলাম সুনীলের আমন্ত্রণে। সঙ্গে ছিল শিবরামকৃষ্ণাণ। এটাই ম্যান ম্যানেজমেন্ট।
মদন লাল: তখন সময় আলাদা ছিল। এমন নয় যে গাওস্করের হাতে খারাপ দল ছিল। তা নয়। ভাল ক্রিকেটার গাওস্করের হাতেও ছিল। আর গাওস্করও তো টেস্ট জিতেছে। বেনসন অ্যান্ড হেজেস কাপ জিতেছে। তার পর পরিস্থিতি অনেক বদলেছে। অনেক পরিবর্তন এসেছে ক্রিকেটেও। তাই এখনকারের দৃষ্টিকোণে গাওস্করের নেতৃত্বকে বিচার করলে ভুল হবে।
কোন ক্যাপ্টেন হারতে চায়, নেতা গাওস্করের হয়ে সওয়াল মদন লালের।
আরও পড়ুন: পাল্টাচ্ছে না জার্সির রং, মোহনবাগান এ বার থেকে এটিকে-মোহনবাগান
সেরার সেরা?
কারসন ঘাউড়ি: বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গ্রেট উঠে আসে। কিন্তু আমি সুনীল গাওস্করের বিশাল বড় ভক্ত। শ্রদ্ধা করি। যখন খেলতেন, তখন উইকেট ঢাকা থাকত না। স্থানীয় আম্পায়াররা ম্যাচ পরিচালনা করতেন। কোনও প্রোটেক্টিভ গিয়ার ছিল না। আর এই সমস্ত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও গাওস্কর বিধ্বংসী সব পেসারদের বিরুদ্ধেও অনায়াসে রান করে গিয়েছেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের হাতে তখন দুর্দান্ত সব পেসার। অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, পাকিস্তান, নিউজিল্যান্ড, সব দলের কাছেই সেরা সেরা পেসাররা ছিল। গাওস্কর এই সেরাদের বিরুদ্ধেই রান করেছে। এক্সপ্রেস গতির পেসারদের সামলেছে দাপটে। আর সেটাও না ঢাকা উইকেটে। এটাই বিস্ময়কর। তুলনায় সচিন কভার দেওয়া উইকেটে খেলেছে, সমস্ত প্রোটেক্টিভ গিয়ারের সাহায্য পেয়েছে, হেলমেট কখনও খোলেনি। নিরপেক্ষ আম্পায়ার পেয়েছে। থার্ড আম্পায়ার পেয়েছে। সচিন যখন খেলেছে, তখন ভারতের ব্যাটিং ছিল টপ ক্লাস। সহবাগ, দ্রাবিড়, সৌরভ, লক্ষ্মণদের পাশে পেয়েছে। কিন্তু গাওস্করের সময় ভারত পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিল গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ আর ওর উপরে। কিছুটা মোহিন্দার অমরনাথ, অংশুমান গায়কোয়াড়, চেতন চৌহানও ছিল। পরের দিকে বেঙ্গসরকর এসেছিল। কিন্তু, গাওস্কর শুরুতে আউট হলেই লোকে ভাবত যে ভারত হেরে যাবে। এমনই ছিল নির্ভরতা।
মদন লাল: ও দুনিয়ার সেরা ব্যাটসম্যান ছিল। অতীত-বর্তমান বা ভবিষ্যৎ, কেউ সুনীলের ধারেকাছে আসতে পারবে না। ও-ই গ্রেটেস্ট।
অধিনায়ক গাওস্করের মস্ত বড় গুণ ছিল ম্যান-ম্যানেজমেন্ট, বললেন সদানন্দ বিশ্বনাথ।
সদানন্দ বিশ্বনাথ: নিশ্চিত ভাবেই বিশ্বের সেরা ওপেনারদের অন্যতম। টেকনিক নিয়ে কথা হবে না, প্রায় নিখুঁতই। দুর্ধর্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ পেস ব্যাটারির বিরুদ্ধেই ১৫টার মতো সেঞ্চুরি রয়েছে। সত্তরের বেশি পেসারের বিরুদ্ধে খেলেছে। ইউনিভার্সিটি ক্রিকেট থেকে সটান জাতীয় দলে এসেছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজে অভিষেকে মাতিয়ে দেওয়া ব্যাটিং। অজিত ওয়াদেকরের নেতৃত্বে আমরা সিরিজ জিতেছিলাম। তার পর ইংল্যান্ডেও জিতি সিরিজ। গাওস্করই ছিল এই সাফল্যের মেরুদণ্ড। সানি-ভাই পুরো বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে, হেলমেট ছাড়াই কী ভাবে মারাত্মক সব পেসারদের খেলতে হয়।
গাওস্করের জীবনে ডেস্টিনির একটা বড় ভূমিকা ছিল। ছোটবেলায় অন্য একটি বাচ্চার সঙ্গে বদলা-বদলি হয়ে গিয়েছিল। কানের ফুটোর জন্য যা ধরা পড়েছিল। ধরেছিলেন মামা মাধব মন্ত্রী। যিনি নিজেও ছিলেন জাতীয় দলের ক্রিকেটার। ধরা না পড়লে গাওস্করকে কি আমরা পেতাম?
গাওস্করকে আমার মনে হয় মহাভারতের একলব্য। নিজের গুরু নিজেই হয়ে উঠেছিলেন। আমি এক বার মার্শেনিলকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ম্যাডাম, গাওস্করের গুরু কে? মাধব মন্ত্রীর কথা বলেছিল মার্শেনিল। আমি বলেছিলাম, আমার মনে হয় নিজেই নিজের গুরু সুনীল। মার্শেনিল একমতও হয়েছিল। আসলে কী ভাবে পেসারদের সামলাবে তা ঠিক করে নিয়েছিলে ও নিজেই। দেখুন, পেস বোলিং খেলা মোটেই সহজ নয়। দিল্লিতে ২৯তম সেঞ্চুরির সময় ম্যালকম মার্শালকে যে ভাবে খেলেছিল, তা অবিশ্বাস্য। তার আগেই কিন্তু বিদ্রুপ শুনতে হয়েছে। বলা হয়েছিল ‘তেরে পিছে মার্শাল আ রহা হ্যায়’। আমার মতে, গ্রেটেস্ট টেকনিক সানিরই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy