নর্থ-ইস্টকে নির্ভরতা দিচ্ছেন শুভাশিস। — ফাইল চিত্র।
এক সময়ে সবাই তাঁকে বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছিলেন। ক্লাব না পেয়ে একসময়ে ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগানের গোল আগলানোর জন্য নিজেই যোগাযোগ করেছিলেন দুই প্রধানের কর্তাদের সঙ্গে। ইস্ট-মোহন তাঁর সেই আবেদনে কর্ণপাতও করেনি। দুঃখে, হতাশায়, অভিমানে ভেঙে পড়েছিলেন এটিকে-কে প্রথম বার আইএসএল চ্যাম্পিয়ন করা বাঙালি গোলকিপার শুভাশিস রায়চৌধুরী।
বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে তিনি এখন পাহাড়ের ফ্র্যাঞ্চাইজি নর্থ-ইস্ট ইউনাইটেডের বারের নীচে। শুক্রবার আইএসএল-এর ম্যাচে গোয়ার বিরুদ্ধে নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন শুভাশিস। গোয়া ফ্র্যাঞ্চাইজির একের পর এক আক্রমণের ঝ়ড় এসে থেমে যাচ্ছিল বাঙালি গোলকিপারের হাতে। শেষ পর্যন্ত ম্যাচটা ড্রয়ের কোলে ঢলে পড়ে।
ইন্ডিয়ান সুপার লিগের ইনস্টাগ্রামে নর্থ-ইস্ট বনাম গোয়ার ম্যাচের একটি ভিডিয়ো পোস্ট করা হয়েছে। সেই ভিডিয়োয় দেখা যাচ্ছে, অবিশ্বাস্য রিফ্লেক্সে বলে চাপড় মেরে শুভাশিস নিশ্চিত গোল বাঁচাচ্ছেন। নর্থ-ইস্ট-এর গোলকিপিং কোচ সন্দীপ নন্দী বলছিলেন, ‘‘শুভাশিসের জন্যই গোয়ার বিরুদ্ধে ম্যাচটা আমরা ড্র করতে পেরেছি।’’ যাঁকে নিয়ে এত কথা, নর্থ-ইস্ট-এর সেই গোলকিপার চোয়াল শক্ত করে বলছেন, “একসময়ে ভেঙে পড়েছিলাম। সন্দীপদাই আমাকে অনুপ্রাণিত করে।’’
ভারতীয় ফুটবলকে হাতের তালুর মতো চেনা সন্দীপের কথামতো নিজেকে অনুশীলনে ডুবিয়ে দেওয়ার সুফল এখন পাচ্ছেন শুভাশিস। নর্থ-ইস্টকে নির্ভরতা দিচ্ছে তাঁর গ্লাভস জোড়া। এখনও পর্যন্ত তিনটি ম্যাচ খেলে অপরাজিত পাহাড়ের ফ্র্যাঞ্চাইজি। লিগ তালিকায় রয়েছে চার নম্বরে। যদিও সবে শুরু হয়েছে আইএসএল। দিল্লি এখনও বহু দূর। তবে শুরু থেকেই আলো ছড়িয়ে ভরসা দিচ্ছেন শুভাশিস।
আরও পড়ুন: ফের বল বিকৃতিতে অভিযুক্ত পাকিস্তানের জাতীয় দলের ক্রিকেটার
ফুটবলবিশ্ব জানে, গোলকিপারের দুনিয়াটা বড় কঠিন! এই আলো তো এই অন্ধকার। শুভাশিসের ফুটবল জীবনেও কখনও মেঘ, কখনও রোদ! প্রথম বারের আইএসএল চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল আন্তোনিও লোপেজ হাবাসের কলকাতা। শেষের দিকের দু’একটা ম্যাচ বাদ দিলে শুভাশিসই ছিলেন স্পেনীয় কোচের প্রথম পছন্দ। সে বার এটিকে-র আইকন প্লেয়ার লুইস গার্সিয়া তাঁর কলামে শুভাশিসের গোলকিপিংয়ের প্রশংসা করেছিলেন। কলকাতাকে চ্যাম্পিয়ন করা গোলকিপার পরের মরসুমে ইস্টবেঙ্গলে সই করেন। লাল-হলুদ জার্সিতে বেশ ভালই চলছিল। হঠাৎই উলটপালট করে দিল চোট। ছিটকে যেতে হয় চেনা মাঠ থেকে। শুরু হয় মাঠে ফেরার এক অন্য লড়াই। চোট সারিয়ে মাঠে ফিরলেও নিয়মিত জায়গাটা হারাতে হয় তাঁকে। কেরল ব্লাস্টার্স-এর হয়ে সাত-সাতটা ম্যাচ খেলার পরে তাঁকে রিজার্ভ বেঞ্চে বসিয়ে দেন বিশ্বকপার গোলকিপার তথা কেরলের তত্কালীন কোচ ডেভিড জেমস।
সন্দীপ নন্দী এখন নর্থ-ইস্ট ইউনাইটেডের গোলকিপিং কোচ।
অনেক আশা নিয়ে গতবার নতুন ফ্র্যাঞ্চাইজি জামশেদপুর-এ সই করেছিলেন। সেখানে তিনটি ম্যাচ খেলার পরে কোনও এক অজানা কারণে দলেরই বাইরে চলে যেতে হয়। মাঠের বাইরের ঘটনায় তিনি ভেঙে পড়েছিলেন সেই সময়ে। বাধ্য হয়ে ইস্ট-মোহন কর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন তিনি। লাভ হয়নি। শুভাশিস বলছিলেন, ‘‘জামশেদপুরের হয়ে তিনটি ম্যাচ খেলেছিলাম। খারাপ পারফরম্যান্স ছিল না। কিন্তু, কী কারণে যে আমাকে দল থেকে সরিয়ে দেওয়া হল, বুঝতে পারিনি। এ বার ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগানে খেলার জন্য আমি নিজেই যোগাযোগ করেছিলাম। কিন্তু, কেউই তো সাড়া দিল না। খুব খারাপ লেগেছিল।”
গোলকিপারই বোধহয় একমাত্র বোঝেন গোলকিপারের লড়াই। কঠিন সময়ে শুভাশিসের পাশে এসে দাঁড়ান পাঁচবারের ভারতসেরা গোলকিপার সন্দীপ। তিনি বলছিলেন, ‘‘শুভাশিস লম্বা রেসের ঘোড়া। আমার সঙ্গে ওর যোগাযোগ অনেক দিন ধরে। একসঙ্গে খেলেছি। এ বারের আইএসএল-এর আগে বলেছিলাম, কোনও দিকে না তাকিয়ে খেলে যা। আমার কথা শুনেছে শুভাশিস। প্রচণ্ড খেটেছে ও। তার ফল ও এখন পাচ্ছে।’’ আর তিনি, শুভাশিস কী বলছেন? অভিমানের বাষ্প গলায় জড়িয়ে শক্তপোক্ত চেহারার গোলকিপার বলছিলেন, ‘‘মাঝে একটা সময়ে জুনিয়র-জুনিয়র করে ভারতীয় ফুটবলে ঝড় উঠল। অবশ্যই জুনিয়রদের তুলে আনা উচিত। জুনিয়ররা উঠে না এলে এগোবে কী করে দেশের খেলা। তাই বলে কি অভিজ্ঞদের অসম্মানিত করা হবে? এখন তো আমার চারপাশে অভিজ্ঞদেরই খেলতে দেখছি। কোথায় গেল সেই সব জুনিয়ররা?’’
কথায় বলে, অনুশীলনই নিখুঁত হয়ে উঠতে সাহায্য করে। সেটাই হয়েছে শুভাশিসের ক্ষেত্রে। নিখুঁত থেকে এখন আরও নিখুঁত হয়ে উঠেছেন তিনি। মাঠে ঘাম ঝরাচ্ছেন। খাদ্যাভ্যাসেও ব্যাপক পরিবর্তন এনেছেন। এক সময়ে তাঁর ওজন ছিল ৮২ কেজি। এখন তা কমে হয়েছে ৭৫ কেজি। সন্দীপ বলছিলেন, ‘‘পাঁচতারা হোটেলে খাবারের ছড়াছড়ি। শুভাশিস সেই সব দিকে ফিরেও তাকায় না। ওর সামনে দাঁড়িয়ে আমিই হয়তো আইসক্রিম খাচ্ছি। শুভাশিস তখন স্যালাড খাচ্ছে।’’ জন আব্রাহামের দলের গোলকিপার বলছেন, ‘‘খাবারের উপরে লোভ আমার কোনও দিনই ছিল না। আমি ভাতে জল ঢেলেও খেতে পারি। চা ভালবাসতাম। এখন তা ছেড়ে দিয়েছি। মিষ্টি খেতে পছন্দ করতাম। এখন মিষ্টি চেখেও দেখি না। স্যালাড জাতীয় খাবারের উপরে জোর দিচ্ছি। কিছু পেতে গেলে তো অনেক কিছু ছাড়তে হয়, তাই না?’’ প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছেন বহু যুদ্ধের সৈনিক।
উপেক্ষা, ব্রাত্য থেকে যাওয়ার যন্ত্রণাগুলো বুকে ঝড় তোলে শুভাশিসের। শিষ্যের মনের ভিতরে ওঠা সেই ঝড়কেই অন্যদিকে এখন চালিত করছেন ‘গুরু’ সন্দীপ। গুরু-শিষ্যের যুগলবন্দিতে পাহাড়ে ফুটছে ফুল।
আরও পড়ুন: কোহালিকে টপকাতে দরকার আট রান, রেকর্ডের সামনে হিটম্যান
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy