Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪

মহানাটকের পরে ভারতীয় বোর্ডের রাজা সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়

কে জানত, অবসরের এত বছর পরে প্রশাসক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ও ফিরিয়ে আনবেন ক্রিকেটার সৌরভের সেই ছবি! আর তা-ও কি না ক্রিকেট প্রশাসক হিসেবে তাঁর জীবনের সব চেয়ে বড় ‘ম্যাচে’!

সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র

সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র

সুমিত ঘোষ 
শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০১৯ ০২:৪০
Share: Save:

ক্রিকেট জীবনে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় মানে সবাই জানত, হার-না-মানা এক ক্রিকেটার। ডাকাবুকো অধিনায়ক। শেষ হয়েও যাঁর হবে না শেষ। ফুরিয়ে গিয়েছেন যখন ধরে নেওয়া হবে, তখনই ঘটাবেন অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তন!

কে জানত, অবসরের এত বছর পরে প্রশাসক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ও ফিরিয়ে আনবেন ক্রিকেটার সৌরভের সেই ছবি! আর তা-ও কি না ক্রিকেট প্রশাসক হিসেবে তাঁর জীবনের সব চেয়ে বড় ‘ম্যাচে’! রবিবার মুম্বইয়ে বোর্ডের বেসরকারি সভায় নতুন প্রেসিডেন্ট হওয়ার ব্যাপারে প্রথমে তিনিই ছিলেন ফেভারিট। তার পরে হঠাৎই সম্ভাবনা মিলিয়ে যাওয়া শুরু। রাত সাড়ে দশটা নাগাদ সভার মধ্যে থেকে খবর বেরিয়ে পড়ে যে, সৌরভের আর কোনও আশা নেই। তিনি প্রেসিডেন্ট বা সচিব কিছুই হচ্ছেন না। নতুন বোর্ডে নতুন প্রেসিডেন্ট হবেন এন শ্রীনিবাসন সমর্থিত ব্রিজেশ পটেল। তিনিও প্রাক্তন ক্রিকেটার এবং কর্নাটক ক্রিকেট সংস্থার প্রধানের পদ দীর্ঘদিন ধরে সামলেছেন। সচিব হবেন বিজেপির পরাক্রমশালী নেতা অমিত শাহের পুত্র জয় শাহ। যিনি গুজরাত ক্রিকেট সংস্থায় অনেক দিন ধরেই গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন।

অর্থাৎ, পুরো ছবিটাই পাল্টে গিয়েছে। শনিবার নয়াদিল্লিতে সৌরভ যখন অমিত শাহের সঙ্গে বৈঠক করে বেরিয়ে আসেন, তখন ঠিক ছিল সৌরভ প্রেসিডেন্ট হবেন, অমিত-পুত্র জয় হবেন সচিব। আর ব্রিজেশ বড় জোর ছিলেন সচিব পদের জন্য ‘ডার্ক হর্স’। না হলে তাঁকে করা হবে ভাইস প্রেসিডেন্ট। সেটাই কী করে একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে ব্রিজেশ প্রেসিডেন্ট পদে উঠে এলেন, তা কেউ ভেবে কুলকিনারা পাচ্ছিলেন না।

আরও পড়ুন: বিজেপির হয়ে প্রচারের শর্তেই কি বোর্ড প্রেসিডেন্ট? সৌরভ বললেন...​

ও দিকে মুম্বইয়ে বার বার নানা কর্তাকে ফোন করে কোনও উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। সকলেই তখন সভার মধ্যে ব্যস্ত। সৌরভের মোবাইল বেজে যাচ্ছে। এসএমএসের কোনও জবাব নেই। অরুণ জেটলির প্রয়াণে যাঁকে অমিত শাহ-রা ক্রিকেট বোর্ড গঠনের কাজ সামলানোর দায়িত্ব দিয়েছেন, সেই অনুরাগ ঠাকুর নৈশভোজ দিয়েছিলেন। সেই নৈশভোজও শুরু হয়ে যাওয়ার কথা।

প্রায় হেরে যাওয়া লড়াই হঠাৎই সৌরভ বাঁচিয়ে তোলেন এগারোটা নাগাদ। মুম্বই থেকে হঠাৎই ফোনে খবর আসে যে, ক’দিন আগে লর্ডসে বিশ্বকাপ ফাইনালের মতোই টানটান উত্তেজনার ‘ম্যাচ’ গিয়েছে সুপার ওভারে। বোর্ডের প্রভাবশালী মহল নাকি ফের চিন্তাভাবনা শুরু করেছে প্রেসিডেন্ট পদ নিয়ে। প্রথমে আপত্তি তোলেন বোর্ড সদস্যরা। তিরিশটি সংস্থা বোর্ডের নির্বাচনে অংশগ্রহণের ছাড়পত্র পেয়েছে। সেটা সরকারি সভা মানে ২৩ অক্টোবরের বৈঠকের হিসেব। এ দিনের বেসরকারি সভায় লোঢা সংস্কার অনুযায়ী কোনও বিধিনিষেধ ছিল না। তাই তিরিশটি সংস্থা ছাড়াও অনেক প্রতিনিধি হাজির ছিলেন। উপস্থিত সদস্যদের গরিষ্ঠ অংশ প্রথমে আপত্তি তুলতে শুরু করে যে, ব্রিজেশের চেয়ে সৌরভ অনেক যোগ্য প্রার্থী। একে তো অনেক বেশি ক্রিকেট খেলেছেন, কোনও তুলনাই চলে না। তার উপরে প্রশাসক হিসেবে ব্রিজেশের অভিজ্ঞতা বেশি হলেও সৌরভও পাঁচ বছর ধরে সিএবি-র দায়িত্ব সামলেছেন। খুবই আকর্ষণীয় প্রার্থী। তাঁকে প্রেসিডেন্ট বেছে নেব না আমরা? বিশ্বস্ত সূত্রের খবর, বিজেপি হাইকমান্ডের (পড়ুন অমিত শাহ) থেকেও অনুরাগ ঠাকুরের কাছে ফোন যায়, সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার জন্য। তার পরেই আসরে ফেরেন সৌরভ এবং রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ ইডেনে ফলো-অন করে স্টিভের অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর মতোই অভাবনীয় ভাবে তাঁর নামই প্রেসিডেন্ট হিসেবে চূড়ান্ত হয়ে যায়।

জগমোহন ডালমিয়ার পরে তিনিই বাংলা থেকে ক্রিকেট বোর্ডের সর্বময় কর্তা হতে যাচ্ছেন। দশ মাসের জন্য যে তিনি বোর্ড প্রেসিডেন্ট হবেন এবং তার পরে তিন বছরের বাধ্যতামূলক ‘কুলিং অফে’ চলে যেতে হবে, তা মেনে নিতেও কারও আপত্তি নেই। মুম্বই থেকে সৌরভ-শুভানুধ্যায়ী এক জন ফোনে বললেন, ‘‘খুব নাটকীয় পরিস্থিতি। সব কিছু ঠিকঠাকই হয়ে গিয়েছিল। ব্রিজেশ প্রায় হয়েই গিয়েছিল। কিন্তু সব ঘুরে গিয়েছে। সৌরভই হচ্ছেন।’’

সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় সম্পর্কে এ গুলো জানেন কি?

শনিবার রাত পর্যন্ত যে রকম পরিস্থিতি ছিল, তাতে এমনই পূর্বাভাস ছিল। রাজধানীতে অমিত শাহের সঙ্গে বৈঠকের পরে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন সৌরভও। অধিক রাতে উড়ান ছাড়তে দেরি হওয়ায় তিনি দিল্লিতে আটকে যান। রবিবার সকালে সেখান থেকেই মুম্বইয়ের উড়ান ধরেন এবং দুপুরের দিকে যখন বন্ধু এবং দীর্ঘ দিনের ওপেনিং পার্টনার সচিন তেন্ডুলকরের শহরে ঢুকছেন, তখনও ভীষণই ইতিবাচক। তখনও কাউকে কাউকে তিনি বলেন, ‘‘সব ঠিকই আছে বলেই তো মনে হচ্ছে।’’ তাঁকে এবং অনুরাগ ঠাকুরকে একসঙ্গে আরব সাগরের পারের সাত তারা হোটেলেও ঢুকতে দেখা যায়। তা দেখে আরওই সকলের মনে হতে থাকে, সৌরভই বোর্ডের নতুন রাজা হচ্ছেন। জেটলির প্রয়াণে অনুরাগকেই বোর্ডের নির্বাচন সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন করার দায়িত্ব দিয়েছেন অমিত শাহ। সভায় ঢুকে সৌরভকে ছাপিয়ে ব্রিজেশ এগিয়ে যাওয়ায় তাই অনেকেই বিস্মিত হয়ে যান। নানা রকম ব্যাখ্যা বেরিয়ে পড়ে সৌরভের পিছিয়ে পড়া নিয়ে। তার মধ্যে সব চেয়ে জনপ্রিয় ব্যাখ্যা হচ্ছে, এখনই রাজনৈতিক কোনও রফায় ঢুকতে রাজি হননি সৌরভ। চাননি মসনদের বিনিময়ে দশ মাস পরে কোনও রাজনৈতিক দলে যোগ দেওয়ার অঙ্গীকার করতে। তাই তিনি পিছিয়ে পড়েছেন এবং সুযোগ বুঝে শ্রীনি তাঁর প্রার্থীকে গলিয়ে দিয়েছেন।

এমনও শোনা যাচ্ছিল যে, সৌরভকে ভাইস প্রেসিডেন্ট অথবা আইপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এবং, ক্ষুব্ধ তিনি সেই পদ গ্রহণ করতে রাজি হননি। গুরু গ্রেগ চ্যাপেলের বিধান পেয়ে বাদ গিয়েও ফিরে আসার মতো যে এর পর মহাবিক্রম দেখিয়ে সৌরভ ফিরবেন, কে ভাবতে পেরেছিল! ডিনারে যাওয়ার তোড়জোর শুরু হচ্ছে, এই অবস্থা থেকে ঘটে পুরনো সেই সৌরভীয় প্রত্যাবর্তন! প্রায় বোল্ড হয়ে গিয়েও বোর্ড প্রেসিডেন্ট হিসেবে কার্যত প্যাড পরা শুরু করে দিয়েছেন সৌরভ। নতুন ‘টিম ইন্ডিয়া’য় সচিব হিসেবে থাকছেন জয় শাহ। আর ব্রিজেশ হচ্ছেন আইপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের নতুন চেয়ারম্যান।

আপাতত দশ মাসের জন্যই ক্রিজে থাকবেন সৌরভ। তার পর চলে যেতে হবে বাধ্যতামূলক ‘কুলিং অফে’। সে যখন হবে, দেখা যাবে। এখনকার মতো বঙ্গ ক্রিকেট মহল তো বটেই, আরব সাগরের উথালপাতাল ঢেউ আছড়ে পড়তে শুরু করেছে গোটা দেশে। অধিনায়ক হিসেবে যাঁর হাত ধরে ম্যাচ গড়াপেটার কালো অধ্যায় থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেট, তিনি এ বার বোর্ডের নতুন রাজা। এমন একটা সময়ে যখন শ্রীনিবাসনদের অপশাসনে চূর্ণ-বিচূর্ণ হতে বসেছিল বোর্ড। সাধারণ মানুষের আস্থাই চলে গিয়েছিল প্রশাসকদের উপর থেকে। সৌরভ যে হারতে হারতেও জিতলেন আর শ্রীনি-সমর্থিত ব্রিজেশ যে জিততে জিততেও হারলেন, তাতে বোধ হয় ক্রিকেটই জিতল।

আরও পড়ুন: অন্য কেউ হলে হয়ত এই কামব্যাক হত না, বললেন ঋদ্ধির স্ত্রী​

আর রাত একটার সময়েও কোনও কোনও কর্তার মুখে শোনা গেল, ‘‘এই না হলে ক্যাপ্টেন গাঙ্গুলি! কামব্যাক প্রিন্স!’’ ঠিক যেমন সৌরভ খেলার সময় সবাই বলত!

এ দিকে, সৌরভ বোর্ড প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরে জল্পনা শুরু হয়েছে, সিএবি-র প্রেসিডেন্ট কে হবেন? আলোচনায় উঠে আসছে তিনটি নাম। প্রথমজন বর্তমান সিএবি সচিব অভিষেক ডালমিয়া। দ্বিতীয়জন প্রাক্তন সচিব বাবলু কোলে এবং তৃতীয়জন সৌরভের দাদা স্নেহাশিস গঙ্গোপাধ্যায়। বোর্ডের মসনদ চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছে। আগামী কয়েক দিনে নতুন করে জমে উঠতে পারে ইডেনের মসনদ নিয়ে নাটক।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy