Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
ক্রিকেট মোহনায় আজ সীমান্ত যুদ্ধ

ঘাস ছেঁটে আমেরদের অভ্যর্থনা

শাহিদ আফ্রিদি গত দু’দিন ধরে শার্জিল খানকে একটা কথা ক্রমাগত বোঝাচ্ছেন। বলছেন, তুমি অনেক দিন রান করোনি। আমার বিশ্বাস ইন্ডিয়া ম্যাচটা তোমার হবে!

যুদ্ধের আগে। শুক্রবার ধোনি-আফ্রিদি। ছবি: উৎপল সরকার ও শঙ্কর নাগ দাস।

যুদ্ধের আগে। শুক্রবার ধোনি-আফ্রিদি। ছবি: উৎপল সরকার ও শঙ্কর নাগ দাস।

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ মার্চ ২০১৬ ০৩:৪৫
Share: Save:

শাহিদ আফ্রিদি গত দু’দিন ধরে শার্জিল খানকে একটা কথা ক্রমাগত বোঝাচ্ছেন। বলছেন, তুমি অনেক দিন রান করোনি। আমার বিশ্বাস ইন্ডিয়া ম্যাচটা তোমার হবে!

ইডেন ড্রেসিংরুমে উদাত্ত গর্জন ছাড়ছেন রবি শাস্ত্রী। হুঙ্কার দিচ্ছেন— বয়েজ, কাল মাঠে এমন ভাবে নামবে যেন নেমেছো প্রতিপক্ষকে ফায়ার করতে!

ওয়াকার ইউনিস পারলে টেবল চাপড়ে ওঠেন। চুয়াল্লিশেও মারাত্মক ইয়র্কার ছাড়েন বিশ্বকাপে পাকিস্তানের কাছে ভারতের অবধ্য থাকার ইতিহাস শুনে। খিঁচিয়ে উঠে বলে দেন, ‘‘হিস্ট্রি? কীসের হিস্ট্রি? হিস্ট্রি কি পাল্টায় না?’’

রবিচন্দ্রন অশ্বিন এখন আর এটাকে ম্যাচ বলেই ধরেন না। অক্লেশে বলে ফেলেন, এটা তাঁর কাছে সোজাসাপ্টা সীমান্ত-যুদ্ধ!

ইডেন প্রেসবক্সের তলায় দাঁড়ালে আগে ক্লাবহাউসের নীচটা দেখা যেত। এখন দেখতে হলে আরও একটু নেমে নতুন মিডিয়া সেন্টারের জানালার কাছে পৌঁছতে হয়। সন্ধে নাগাদ সেখান থেকে নীচে তাকিয়ে দেখা গেল, ক্লাবহাউস গেটের ঠিক বাইরেটায় অসংখ্য কালো মাথার জমায়েত। এঁরা অবশ্যই শুধু ধোনি-আফ্রিদিদের দেখতে আসেননি। সন্ধে এখন সাড়ে ছ’টা, পাকিস্তান মাঠে থাকলেও ভারত ছেড়ে গিয়েছে বহুক্ষণ। এঁরা তা হলে এখনও কেন? শোনা গেল, এঁরা টিকিট-বুভুক্ষুর দল। যাঁরা সকাল থেকে সন্ধে পড়ে থাকছেন ইডেনে। শনিবারের টিকিট-প্রাপ্তির লোভে। একটা দল আবার বেরিয়ে যাচ্ছে পুরো ময়দান চত্বরে। রাজভবন। গোষ্ঠ পাল সরণী। মহমেডান মাঠ। আকাশবাণী ভবন। আইসিসি কার্ড-হোল্ডার চোখে পড়লেই হল। মুহূর্তে দু’তিন জন ধাওয়া করবেন তাঁকে। গলায় এঁদের আর্তি, চোখে অনুনয়, এবং চরম বিরক্তি প্রদর্শন ছাড়া এঁদের থামানো অসম্ভব।

এবং যদি কোনও রোম্যান্টিকের ওই ক্রিকেট-উন্মত্তের দলকে আগামীকালের বদলে এ দিনই ইডেনের নামিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে হত পাগলামিটা দেখার জন্য, দোষ দেওয়া যেত না। একটা ক্রিকেট-ম্যাচকে ঘিরে এত রংয়ের ব্যাপকতা সম্ভব? একটা ক্রিকেট ম্যাচকে ঘিরে এত ঘটনার পরপর জন্ম হয়? এক-এক সময় মনে হবে, এ ম্যাচের প্রিভিউ বোধহয় সাদা পাতায় কালো কালিতে ধরা সম্ভব নয়। ম্যাচ কোথায়, এ তো ক্রিকেটের হোলি চলছে! আবিরের মুগ্ধতা বর্ণহীন সাদা-কালোয় ধরবে কে?

দুপুর তিনটেয় ভারতীয় প্র্যাকটিসের সময় যে দৃশ্যটা দেখা গেল, ওটা বাঙালির চিরন্তন ক্রিকেট-আবেগকে পুরনো স্মৃতির সরণিতে নামিয়ে দেবে। ইডেনের বাইশ গজের দিকে হাঁটছেন সিএবি প্রেসিডেন্ট সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। আর তাঁকে দেখে প্র্যাকটিস ফেলে ছুটে আসছেন আশিস নেহরা থেকে হরভজন সিংহ। প্রিয় ‘দাদা’-র সঙ্গে কথা বলতে। বিরাট কোহালি সর্বপ্রথম এলেন। কিছুক্ষণ কথা-টথা বলে প্র্যাকটিসে ফিরে যাওয়ার পর আচমকাই একসঙ্গে হরভজন, নেহরা, যুবরাজ। চারদিকে বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে বর্তমান, মধ্যে পুরনো অধিনায়ক। যেখানে নেহরা নাকি মৃদু অনুযোগ করেন— প্র্যাকটিস উইকেট থেকে বাউন্স পাচ্ছি না। দাদা তুমি দেখো! নতুন কোথায়, এ তো সেই পুরনো সোনার টিম ইন্ডিয়া যার জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠের দায়িত্ব জমা দাদার পকেটে।

আবার বিকেল ছ’টার শো দেখুন। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় নন, এ বার পিচ দেখতে যাচ্ছেন শাহিদ আফ্রিদি। দেখে-টেখে যে সঙ্গীকে নিয়ে পাশের নেটের বিরাট কোহালির দিকে হাঁটা দিলেন আফ্রিদি, সেই মহম্মদ আমের আগামীকাল নিঃসন্দেহে ভারতীয় ব্যাটিংয়ের এক নম্বর শত্রু। অথচ আজ চিহ্নমাত্র নেই। বরং পাক পেসারকে নিজের নতুন ব্যাট দিয়ে দিলেন কোহালি। আর এই ব্যাট প্রদানের নেপথ্য গল্পটাও বেশ মজার। শোনা গেল, গত রাতে টিম হোটেলের রেস্তোরাঁয় বিরাটরা যেমন ডিনার করতে নেমেছিলেন, তেমন আমেররাও গিয়েছিলেন। লিফটে দেখা হয়ে গেলে আমের আচমকাই নাকি বিরাটকে বলে বসেন, পাকিস্তানের এক নম্বর ব্যাট কে জানো? বিরাট জানতে চাইলে সহাস্যে নিজেকে দেখিয়ে দেন আমের। যা শুনে নাকি বিরাট তাঁকে বলেন, ঠিক আছে। তুমি যখন পাকিস্তানের সেরা ব্যাট, আমার নতুন দু’টোর থেকে একটা তোমার। কাল মাঠে দিয়ে দেব। এবং তার পর মাঠে দেখামাত্র প্রতিশ্রুতি রক্ষা।

এত পর্যন্ত পড়লে মনে হতে পারে শুরুর চারটে লাইন অর্থহীন। যুদ্ধ কোথায়, উত্তেজনা কোথায়, প্রাক্-ম্যাচে তো প্রশান্তির পায়রা উড়ছে! মুশকিল হল, এ সব ভালবাসা-টাসা স্রেফ বহিরঙ্গ। মায়াবী বিভ্রম, বাস্তবে যার কোনও অস্তিত্ব নেই। কারণ দু’টো টিমের নিভৃতে যত না প্রীতি, তার চেয়ে অনেক বেশি বৈরিতা বসবাস করছে।

সবচেয়ে বড় কূটনৈতিক চালটা দেওয়া হল ইডেনের বাইশ গজ নিয়ে। এ দিন দুপুরে কিছুক্ষণের জন্য যে অনাবৃত ইডেন পিচ দেখা গিয়েছিল, তাতে সবুজ আভা ছিল। কিন্তু সন্ধের দিকে তা দাঁড়াল সাদা ফ্যাটফ্যাটে চেহারার। শোনা গেল, পিচে ঘাস দেখামাত্র নাকি ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্ট থেকে অনুরোধ যায়, সবুজ আভাটা ছেঁটে ফেলা হোক। কারণ সহজবোধ্য— টিম মহম্মদ আমের! মীরপুরে যাঁর ঘটানো ‘অগ্নিকাণ্ডের’ পর এখন ঝুঁকি নেওয়া অসম্ভব। আপাতত যা খবর, পরিবর্তিত পিচ পুরো ব্যাটিং ট্র্যাক। যেখানে পরের দিকে স্পিনও ধরতে পারে।

দু’টো টিম যে সাংবাদিক সম্মেলন করে গেল, সেখানেও বন্ধুত্ব-টন্ধুত্ব নেই। আপাদমস্তক যুদ্ধং দেহি। অশ্বিন বলে গেলেন, এটা তাঁর কাছে অ্যাসেজের চেয়েও বড়। যেখানে ক্রিকেট আর ক্রিকেট থাকে না। সীমান্ত যুদ্ধ হয়ে যায়। ওয়াকার আবার এসে পুরো চাপটাই ঠেলে দিলেন ভারতের দিকে। বারবার বলতে থাকলেন, প্রথম ম্যাচটা হেরে ভারতই চাপে। বললেন, এতটা চাপে থাকা ভারতকে বিশ্বকাপে আগে পায়নি পাকিস্তান। ডাক দিলেন ইতিহাস পাল্টানোর। আতঙ্ক ছড়ালেন বলে যে, শনিবার হারা মানে ভারতের বিশ্বকাপ অভিযানই মোটামুটি শেষ হয়ে যাওয়া!

এটা ঠিক যে, প্রাক্-যুদ্ধের সার্বিক বিচারে পাকিস্তানের চেয়ে ভারতই তুলনায় চাপে। শনিবার ধোনিরা হারলে সেমিফাইনালের রাস্তা কঠিন নয়, ভয়ঙ্কর কঠিন হয়ে যাবে। ভারত অধিনায়ক হোটেলে সাংবাদিক সম্মেলন ডেকেও পরে বাতিল করে দিলেন। বলা হল, ধোনি ম্যাচে মনঃসংযোগ করতে চাইছেন, তাই প্রেস কনফারেন্স এখন থাক। পাকিস্তান শিবিরে তখন শিকাগো-নিবাসী ‘চাচা’-কে টিকিট ধরাচ্ছেন আফ্রিদি। একই হোটেলের লবিতে ছবি তুলছেন দেদার। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও ঠিক যে, ক্রিকেট যদি হয় অনিশ্চয়তার খেলা, পাকিস্তান তার প্রতিভূ। চলমান উদাহরণ। আফ্রিদির টিম কবে ডুববে, কবে ভাসবে স্বয়ং আফ্রিদিও জানেন কি?

তাই বোধহয় অতিরিক্ত হিসেব কষাকষির রাস্তায় না গিয়ে শনিবার গ্যালারির উত্তাপ নেওয়া ভাল। নামেই শুধু জায়গাটার নাম কলকাতা, আজ রাতে শহর আসলে ক্রিকেট-বিশ্বের মোহনা। যে মোহনায় মিশবে পঞ্জাব থেকে পেশোয়ার, সিন্ধু থেকে শিকাগো।

আজ রাতে ইডেনে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ‘দ্য ম্যাচ’। আজ রাতের ইডেনে বহু প্রতীক্ষার ভারত বনাম পাকিস্তান।

অন্য বিষয়গুলি:

wt20 sourav ganguly
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy