Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪

‘লাল-হলুদের পাঁচ ঘোড়ার সেই সৌন্দর্য ভোলার নয়’

কলেজ জীবনে তিনিও ভাসতেন কলকাতা ফুটবলের স্রোতে। এখনও ইস্টবেঙ্গলের পঞ্চপাণ্ডবে মুগ্ধ। সে ছিল অন্য ময়দান। শোনাচ্ছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়... কলেজ জীবনে তিনিও ভাসতেন কলকাতা ফুটবলের স্রোতে। এখনও ইস্টবেঙ্গলের পঞ্চপাণ্ডবে মুগ্ধ। সে ছিল অন্য ময়দান। শোনাচ্ছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়...

জনজোয়ার: ইস্টবেঙ্গল মানেই যেন এই উন্মাদনার ঢেউ। লাল-হলুদ রঙে ভেসে যাওয়ার ছবি দেখা গেল শতবর্ষ নিয়ে মিছিলে। পতাকা, ঢাকঢোল নিয়ে মানুষের ঢল নেমে পড়েছিল রাস্তায়। কুমোরটুলি পার্কে দেখা গেল নজিরবিহীন জমসমাবেশ। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

জনজোয়ার: ইস্টবেঙ্গল মানেই যেন এই উন্মাদনার ঢেউ। লাল-হলুদ রঙে ভেসে যাওয়ার ছবি দেখা গেল শতবর্ষ নিয়ে মিছিলে। পতাকা, ঢাকঢোল নিয়ে মানুষের ঢল নেমে পড়েছিল রাস্তায়। কুমোরটুলি পার্কে দেখা গেল নজিরবিহীন জমসমাবেশ। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

শেষ আপডেট: ৩০ জুলাই ২০১৯ ১৭:১৫
Share: Save:

ঘটি-বাঙাল অনুভূতিটা কোনও দিনই আমার মধ্যে ছিল না। তাই ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ধুন্ধুমার ডার্বির উত্তেজনার আঁচ পেলেও বা কলকাতা ফুটবল সম্পর্কে উত্তপ্ত আলোচনা চোখের সামনে হতে দেখলেও আমি ছিলাম নিরপেক্ষ এক ব্যক্তি। কলেজে বা কাজের জায়গায় বন্ধুবান্ধব এবং সতীর্থরা যখন ফাটাফাটি করছে, তখন আমি তাদের থামানোর চেষ্টা করতাম। তরজা খুব উচ্চ স্বরে পৌঁছলে আমি এমনও বলেছি যে, তোরা যদি না থামিস, ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান লড়াই যদি না থামে, তা হলে ভারতীয় ফুটবল সেই একশো দেশের পরেই থেকে যাবে।

মজা করে অমন বললেও আমি খুব ভাল করে জানতাম, কলকাতার মানুষের ফুটবল নিয়ে আবেগ কতটা। কলেজ জীবনে আমিও মাঠে গিয়েছি খেলা দেখতে। ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের যে শতবর্ষ পালন করার মতো একটা মহালগ্ন উপস্থিত, তা সত্যিই গর্ব করার মতো ব্যাপার। ক্লাব হয়তো একটা গঠন করে ফেলা যায় কিন্তু এত বছর ধরে সারা ভারতের সেরা ক্লাবগুলোর একটা হয়ে উন্নত মান এবং ঐতিহ্য ধরে রাখা মোটেও সহজ ব্যাপার নয়। সে দিক দিয়ে ইস্টবেঙ্গল এবং মোহনবাগান কলকাতার মানুষদের গর্বিত করেছে। এই দু’টো বড় ক্লাব এখনও সারা ভারতের মধ্যে অন্যতম সেরা। আগে বিএনআর, ইস্টার্ন রেলওয়ে ছিল, মহমেডান স্পোর্টিং ছিল। এখন আর বাকিদের সেই প্রভাব, রমরমা নেই। তাই একশো বছর ধরে পুরনো ঐতিহ্যকে ধরে রাখাকে সেলাম করতেই হবে।

আমি খুবই খেলামনস্ক লোক। ক্রিকেট দেখতে ছুটেছি ইডেনে। ফুটবলেও দারুণ আগ্রহ ছিল। দিয়েগো মারাদোনার প্রতি একটা হৃদয়ের টান অনুভব করি। তাই বিশ্বের সেরা ফুটবলার কে, যখন কেউ প্রশ্ন করে, মারাদোনার নামটা না বলে পারি না।

আরও পড়ুন: শতবর্ষে বিনিয়োগকারী নিয়ে সঙ্কটে ইস্টবেঙ্গল

তেমনই ইস্টবেঙ্গল মানেই আমার মনে পড়ে পঞ্চপাণ্ডবের কথা। বেঙ্কটেশ, সালে, আপ্পারাও, ধনরাজ এবং আমেদ খান। আমি ভারতীয় ফুটবলে অন্তত আমেদ খানের মতো খেলোয়াড় দেখিনি। খুব ভাল লেগেছিল আপ্পারাওকেও। আমি যখন দেখেছিলাম, তখন একটু বয়স হচ্ছিল। বার্ধক্যের দিকে ঝুঁকে পড়া আপ্পারাও তাঁর সোনার সময় পেরিয়ে এসেছিলেন। তাতেও দেখেছিলাম, উনি বল নিয়ে এগোচ্ছেন আর কেউ ধরতেই পারছে না। শৈলেন মান্নার মতো ভদ্র ডিফেন্ডার পৃথিবীতে কোথাও পাওয়া যাবে না। মান্নাদাকে পর্যন্ত দেখেছি, বিপর্যস্ত হয়ে আপ্পারাওয়ের জার্সি টেনে ধরেছেন। তা-ও সে নাকি ফুরিয়ে আসা আপ্পারাও। তা হলে সেরা সময়ে তিনি কী রকম ফুটবলার ছিলেন! পাঁচ জনের মধ্যে ধনরাজ বাকিদের গ্রহের ছিলেন না। বাকি চার জন ধনরাজকে দিয়ে বেশি গোল করাতেন।

আরও পড়ুন: ‘রত্ন’ নিয়ে প্রসূন বললেন, অর্জুনের চেয়েও বড় সম্মান

প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় মানে পিকে আমার খুব বন্ধু ছিল। মাঝেমধ্যেই আমাদের আড্ডা হত। আমি মেওয়ালালের খুব ভক্ত ছিলাম। এত সুযোগসন্ধানী স্কোরার খুব কমই এসেছেন ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসে। অসাধারণ স্ট্রাইকিং ক্ষমতা। গোল করায় ওঁর সঙ্গে কারও তুলনা হওয়া কঠিন। পিকের অফিসে এক দিন মেওয়ালালের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তখন পঞ্চপাণ্ডব নিয়ে আমি ওঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, এই ফরোয়ার্ড লাইন নিয়ে আপনার বক্তব্য কী? মেওয়ালাল বলেছিলেন, ‘‘ধনরাজের জায়গায় আমি থাকলে আরও বেশি গোল হত। আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারত সেই ফরোয়ার্ড লাইন। প্রত্যেক মরসুমে পঞ্চাশটা করে গোল করতাম।’’ সত্যিই ভাবছিলাম, ওই চার জনের সঙ্গে ধনরাজের জায়গায় যদি মেওয়ালাল থাকতেন, কী দুর্ধর্ষ ফরোয়ার্ড লাইন হত! অবর্ণনীয় একটা পঞ্চভুজ হয়তো তৈরি হতে পারত।

তখনকার দিনে আরও এক জনের খেলা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখতাম আমরা। তাজ মহম্মদ। সেই সময় মান্নাদার প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করা হত তাঁকে। তখনকার দিনে ফুলব্যাক ছিল, তাজ মহম্মদ খেলতেন ফুলব্যাকে এবং কড়া ডিফেন্ডার হিসেবে সুখ্যাতি ছিল তাঁর। যেন মাছিও গলতে পারত না তাঁর রক্ষণকে ফাঁকি দিয়ে। শক্তপোক্ত ডিফেন্ডার ছিলেন তিনি। তবু আমার সময়কার ফুটবলের কথা মনে করতে বসে বার বার চোখের সামনে ভেসে ওঠে পঞ্চপাণ্ডবের মুখ। ওঁরা পাঁচ জন খন একসঙ্গে আক্রমণে উঠতেন, কী অসাধারণ এক ছন্দ তৈরি হত মাঠে! সূর্যের সাত ঘোড়ার মতোই যেন উজ্জ্বল ছিল লাল-হলুদের পাঁচ ঘোড়া। টগবগিয়ে যারা সারা মাঠ ছুটত।

আর আমার বন্ধু পিকে খেলার সময় মাঠে গিয়েছি। মোহনবাগান নিয়ে একটা দুর্বলতা ছিল পিকের মধ্যে। আবার এটাও ওর মুখে শুনেছি যে, ইস্টবেঙ্গলে কোচিং করিয়ে খুব আনন্দ পেয়েছে। ওর মুখেই শুনেছি, ‘‘এত আবেগপ্রবণ সমর্থকের দল আর কোথাও দেখতে পাওয়া যাবে না।’’ ইস্টবেঙ্গলের পঞ্চপাণ্ডবের মতোই অসাধারণ ছিল পিকে-চুনী-বলরাম ত্রয়ী। তার সঙ্গে জার্নেল সিংহ। বেঙ্কটেশ রাইট উইংয়ে ভাল ছিল। পিকে আরও ক্ষিপ্র ছিল এবং গোলার মতো শটের জোর ছিল। তবে ইস্টবেঙ্গলের পঞ্চপান্ডবের আগে কলকাতা ময়দানে ঝড় তুলেছিল তিরিশের দশকের মহমেডান। ওদের খেলা দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। তবে শুনেছি, অপ্রতিরোধ্য দল ছিল। ওদের বলাও হত ‘দ্য ইনভিন্সিবেলস’। তাজ মহম্মদ ওই দলে খেলেছেন। পরে ইস্টবেঙ্গলে খেলেন। আর ফরোয়ার্ড লাইনে ছিলেন ‘থ্রি আর’। রশিদ, রহিম আর রহমত। শুনেছি, এই ত্রয়ী যখন প্রতিপক্ষ বক্সে একসঙ্গে হানা দিত, যে কোনও ডিফেন্ডারের পা কাঁপতে শুরু করে দিত। রশিদের বাঁ পা দারুণ ছিল বলে শুনেছি। আর রহমত আক্রমণকে গড়ে তুলতেন। রশিদ আর রহিম তিরিশের দশকের শেষের দিকে অনেক বার সর্বোচ্চ গোলদাতার সম্মান জিতে নিয়েছেন। আমি ওঁদের দু’জনকে দেখেছি অনেক পরে প্রীতি ম্যাচে। তত দিনে রশিদের পা ভেঙেছে, তাঁর সেই তেজও আর নেই। পা সেরে গেলেও প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল খেলার মতো আর ছিল না। তবে আমাদের বাড়িতেও অনেকে ফুটবল খেলতেন। তাঁরা বলতেন, সামাদ খানের পরে যদি কারও নাম করতে হয় তো সেটা রশিদই।

পরবর্তীকালে অনেকে আবার আমেদ খান আর বলরামকে সেরা বলেছেন। বলরাম গোটা মাঠ জুড়ে খেলতে পারতেন। খেলাটাকে তৈরি করতেন উনি। ওই সময়কার ‘কমপ্লিট প্লেয়ার’। তেমনই ভোলা যাবে না মান্নাদার হেডিং। কুড়ি গজ দূরের ফুটবলারের পায়ে হেড করে বল পাঠিয়ে দিতে পারতেন একদম ঠিকানা লিখে। আমার চোখে লেগে রয়েছে আমেদ খানের ফুটবল। আমার সঙ্গে কথাবার্তায় পিকের মুখে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা শুনেছি চুনীর। সব সময় ও বলেছে, চুনী বিশ্বমানের ফুটবলার। বলরামকেও সেরা মানে পিকে।

ওঁদের দক্ষতার ফুটবলার আজ আর খুব একটা দেখা যায় না। শেষ ছিল বোধ হয় কৃশানু দে। যার স্কিল দেখে অভিভূত হয়ে থাকত দর্শকরা। আমি মজিদ বাসকারের খেলা দেখেছি। দুর্দান্ত। আমার এক কাকা খুব ভাল ফুটবল খেলতেন। তিনিও গিয়েছিলেন আমার সঙ্গে মজিদের খেলা দেখতে। এখনও মনে আছে, ম্যাচ দেখতে দেখতে কাকা বলেছিলেন, ‘‘এ হল জাত প্লেয়ার। এর চেয়ে ভাল কেউ এই মুহূর্তে নেই।’’ সেই সময় মজিদ সম্ভবত সবে ইস্টবেঙ্গলে খেলতে এসেছে। কাকার সঙ্গে মাঠে বসে সে দিনই কিন্তু ইঙ্গিত পেয়েছিলাম, কলকাতায় আর এক বড় ফুটবলার
এসে গিয়েছে।

তবে আধুনিক প্রজন্মে যদি কেউ বড় ফুটবলার থাকে তো সে হচ্ছে সুনীল ছেত্রী। আমাদের ভারতীয় দলের অধিনায়ক। টিভিতে আমি ওর খেলা দেখেছি। ভাইচুং ভুটিয়ার পরে এই আর এক জন এসেছিল, যার খেলা দেখতে লোকে মাঠে আসে। ভারতীয় ফুটবলের জন্য সুনীল যা করেছে, তা মনে রাখতেই হবে। ইস্টবেঙ্গলের শতবর্ষে শুধু একটাই আক্ষেপ থেকে যাচ্ছে। আগের মতো বাঙালি ফুটবলার যদি দেখতে পেতাম!

এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও।সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy