Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪

স্ল্যাম হ্যাটট্রিক করে সানিয়া মির্জা এখন ভারতীয় টেনিসের সচিন

সানিয়া মির্জাকে এর পর আমাদের দেশের সর্বকালের সেরা মেয়ে খেলোয়াড় বলতে আমার কোনও দ্বিধা নেই। এমনিতেই আন্তর্জাতিক খেলাধুলোয় টপ লেভেলে ভারতীয় মেয়েদের অতীত রেকর্ড তেমন বলার মতো কিছু নয়। ছবিটা যা বদলানোর সাম্প্রতিক বদলেছে। মেরি কম, সাইনা নেহওয়াল, মিতালি রাজ, হিনা সিধু, অপূর্বি চান্ডিলাদের সৌজন্যে।

জয়োচ্ছ্বাস। মেলবোর্নে ডাবলস চ্যাম্পিয়নদের বাঁধ ভাঙা হাসি। ছবি: এএফপি।

জয়োচ্ছ্বাস। মেলবোর্নে ডাবলস চ্যাম্পিয়নদের বাঁধ ভাঙা হাসি। ছবি: এএফপি।

জয়দীপ মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০১৬ ০৩:৪৫
Share: Save:

সানিয়া মির্জাকে এর পর আমাদের দেশের সর্বকালের সেরা মেয়ে খেলোয়াড় বলতে আমার কোনও দ্বিধা নেই।

এমনিতেই আন্তর্জাতিক খেলাধুলোয় টপ লেভেলে ভারতীয় মেয়েদের অতীত রেকর্ড তেমন বলার মতো কিছু নয়। ছবিটা যা বদলানোর সাম্প্রতিক বদলেছে। মেরি কম, সাইনা নেহওয়াল, মিতালি রাজ, হিনা সিধু, অপূর্বি চান্ডিলাদের সৌজন্যে। কেউ বক্সিংয়ে কোনও ক্যাটেগরিতে অনেক বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন, কেউ ব্যাডমিন্টনে অলিম্পিক্স মেডেল জিতেছে। কেউ ওয়ান ডে ক্রিকেটে রেকর্ড গড়েছে। কেউ শ্যুটিংয়ে বিশ্বের এক নম্বর, কেউ বিশ্বরেকর্ড ভেঙেছে।

কিন্তু সানিয়া যে খেলাটা খেলে সেই টেনিস বহু যুগ ধরে বছরভর সারা পৃথিবী জুড়ে হয়ে থাকে। সত্যিকারের ওয়ার্ল্ড স্পোর্ট। সে রকম একটা ইভেন্টে একজন ভারতীয় মেয়ে, যে কিনা নিজের আর্থসামাজিক প্রতিবন্ধকতার কারণে গোবর লেপা কোর্টে টেনিসটা শিখেছে, সে-ই আজ টানা তিনটে গ্র্যান্ড স্ল্যাম ডাবলস চ্যাম্পিয়ন। শেষ পাঁচ মাসে পেশাদার ট্যুরে টানা ছত্রিশ ম্যাচ জিতেছে। টানা আটটা টুর্নামেন্ট চ্যাম্পিয়ন। গত এগারো মাসে বারোটা খেতাব। আমি তো এমনও মনে করি, আমাদের দেশে ক্রিকেটে যেমন সচিন তেন্ডুলকরের অপরিসীম প্রভাব, মেয়েদের টেনিসে তেমনই সানিয়ার।

কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা, কচ্ছ থেকে কোহিমার প্রতিটা বাচ্চা ক্রিকেটার যেমন ব্যাট ধরার পর থেকেই তেন্ডুলকর হওয়ার স্বপ্ন দেখে, তেমনই ইদানীং প্রত্যেক টেনিস অ্যাকাডেমিতে কাতারে কাতারে বাচ্চা মেয়ে আসছে সানিয়া হয়ে উঠতে। আমার নিজের কলকাতা ছাড়াও অন্য রাজ্যেও টেনিস অ্যাকাডেমি থাকায় এ ব্যাপারটা আমি আরও ভাল বুঝতে পারি। মেয়েকে টেনিস প্লেয়ার করে তুলতে এত তুমুল আগ্রহ বছর কয়েক আগেও আমাদের দেশে মা-বাবাদের ছিল না। পুরোটার পিছনেই সানিয়ার ‘ওয়ার্ল্ড বিটার’ ভাবমূর্তির প্রভাব।

সানিয়ার আগে কোনও ভারতীয় মেয়ে বিশ্ব টেনিস শাসন তো দূরের কথা, গ্র্যান্ড স্ল্যাম সেমিফাইনাল-ফাইনাল খেলবে ভাবাটাও অলীক স্বপ্ন ছিল। সেখানে ও টানা এক বছর ধরে ডাবলসে বিশ্বের এক নম্বর। ডাবলস-মিক্স়ড ডাবলস মিলিয়ে হাফডজন গ্র্যান্ড স্ল্যাম হয়ে গেল শুক্রবার। সানিয়া-মার্টিনা জুটি এর পর ফরাসি ওপেন জিতলে ওদের ডাবলসে ‘স্ল্যাম’ হয়ে যাবে। মানে টানা চারটে গ্র্যান্ড স্ল্যাম খেতাব।

রোলাঁ গারোয় সেটা হয়ে যেতেও পারে। ক্লে কোর্ট অন্য সারফেসের তুলনায় স্লো ঠিকই। সানিয়াদের খেলার স্টাইলের ঠিক যুতসই নয়। কিন্তু এখন তো গোটা বিশ্বেই টেনিস কোর্ট আগের চেয়ে স্লো। বল আগের চেয়ে ভারী। মনে হয় না, ওরা রোলাঁ গারোয় খুব একটা অন্য রকম পরিবেশ পাবে বলে। তা ছাড়া জেতা একটা অভ্যেস। সানিয়াদের যে অভ্যেসটা খুব ভালই হয়ে গিয়েছে।

অনেকে বলতে পারেন, ও মার্টিনা হিঙ্গিসের মতো একজন চ্যাম্পিয়ন পার্টনার পেয়েছে। সত্যি কথা। দু’বার অবসর ভেঙে ফিরেও যে প্লেয়ার পঁয়ত্রিশেও গ্র্যান্ড স্ল্যাম জেতে, ফের বিশ্বের এক নম্বর হয়, সে চ্যাম্পিয়ন-ই। কিন্তু পাশাপাশি এটাও মনে রাখতে হবে, চব্বিশ ঘণ্টা আগেই দু’জনের মুখোমুখি লড়াইয়ে মার্টিনাকে হারিয়েছে সানিয়া। আর সেই মিক্সড ডাবলস ম্যাচে মার্টিনার সঙ্গী ছিল যে-সে কেউ নয়— লিয়েন্ডার পেজ। তা ছাড়া ওদের জুটি গত বছর তিনটে গ্র্যান্ড স্ল্যাম চ্যাম্পিয়ন। এ দিন মেলবোর্নে ডাবলস ফাইনালে সানিয়ারা ৭-৬ (৭-১), ৬-৩ স্ট্রেট সেট চেক প্রতিপক্ষ হ্লাভাকোভা-রাদেস্কাকে হারানোর কিছুক্ষণের মধ্যে নেমে মিক্স়়ড ডাবলস সেমিফাইনালে সানিয়া-ডডিজ হেরে গেলেও সেটাকে আমি বেশি গুরুত্ব দেব না। হাইভোল্টেজ ফাইনাল খেলার একটা ক্লান্তি বলে কিছু তো আছে!

তা ছাড়া এ দিন ডাবলস ফাইনালে সানিয়া পার্টনারের তুলনায় বেশি ভাল খেলেছে। ওর ফোরহ্যান্ড বরাবরই বিশ্বমানের। যখন সি‌ঙ্গলসে প্রথম তিরিশে উঠে এসেছিল, সেই সময় সানিয়ার ফোরহ্যান্ডকে শারাপোভার সঙ্গে তুলনা করা হত। কিন্তু এ দিন অবাক হয়ে দেখলাম, ওর ব্যাকহ্যান্ডেরও দুর্দান্ত উন্নতি ঘটেছে। ফাইনালের বেশির ভাগ বিগ পয়েন্ট সানিয়ার ব্যাকহ্যান্ডেই জিতেছে ওদের জুটি। এ দিন ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট আমার মতে যেটা, প্রথম সেটের সেই টাইব্রেকটা বিপক্ষকে মাত্র একটা পয়েন্ট দিয়ে সানিয়াদের হাসতে হাসতে জিতে এগিয়ে যাওয়ার পিছনেও সানিয়ার ভাল ফার্স্ট সার্ভ আর চমৎকার কয়েকটা ব্যাক হ্যান্ড রিটার্ন।

তবে সানিয়া-মার্টিনা জুটির এই অসামান্য ধারাবাহিকতার সবচেয়ে বড় কারণ আমার মতে, ওদের একে অন্যকে একেবারে নিখুঁত ‘কমপ্লিমেন্ট’ করার ক্ষমতা। ডাবলসে সাফল্য পেতে যেটা সবচেয়ে বেশি দরকার। কোর্টের ভেতরে তো বটেই, কোর্টের বাইরেও ওরা একে অন্যের সত্যিকারের পরিপূরক হয়ে উঠেছে যেন। নিরানব্বইয়ে লিয়েন্ডার-মহেশ যখন চারটে গ্র্যান্ড স্ল্যামেই ফাইনালে উঠে দু’টো জিতেছিল, সেই সময় সংগঠকেরা ওদের হোটেলে আলাদা রুম দেওয়া সত্ত্বেও ওরা এক ঘরে থাকত। হিঙ্গিস আবার যেমন গত মাসে বিজয় অমৃতরাজের টেনিস লিগে খেলতে এসে হায়দরাবাদে সানিয়ার বাড়িতে ডিনার করাই নয়, রাতে থেকে গিয়েছে।

এই সব কিছুর রেজাল্ট— ওদের জুটির টানা ছত্রিশ ম্যাচ জেতা। গ্র্যান্ড স্ল্যাম চ্যাম্পিয়ন হওয়ার হ্যাটট্রিক। যে দু’টোর সংখ্যাই মনে হয় আরও বাড়বে। আর সানিয়াদের কৃতিত্ব অক্ষতও থাকবে অনেক অনেক দিন।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy