অপ্রতিরোধ্য: এ ভাবেই প্রতিপক্ষকে চূর্ণ করতেন চুনী। ফাইল চিত্র
কলকাতা ময়দানে প্রথম পা রেখেই যাঁর নাম শুনেছিলাম, তিনি চুনী গোস্বামী। ফুটবলের পাশাপাশি ক্রিকেটও দারুণ খেলতেন।
১৯৬৬ সালে যখন ইস্টবেঙ্গলে সই করি, তখন আমার বয়স মাত্র ষোলো বছর। রাম বাহাদুর, পিটার থঙ্গরাজের মতো তারকারা লাল-হলুদ জার্সি গায়ে খেলছেন। ফলে প্রথম একাদশে খুব একটা সুযোগ পেতাম না। মন দিয়ে অনুশীলন করতাম আর কলকাতার লিগের খেলা দেখতাম। চুনী গোস্বামীর খেলা দেখে আমার মাথা ঘুরে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল যেন একটা পাখি সবুজ-মেরুন জার্সি গায়ে মাঠের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে উড়ছে। বলের উপরে যেমন অসাধারণ নিয়ন্ত্রণ, তেমনই দুরন্ত গতি ছিল চুনীদার। অনায়াসে বিপক্ষের তিন-চার জন ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে বল নিয়ে এগিয়ে যাওয়া কোনও ব্যাপারই ছিল না ওঁর কাছে। অথচ তখন কিন্তু ফুটবল কেরিয়ারের শেষের দিকে পৌঁছে গিয়েছেন চুনীদা। ওই খেলা দেখার পরে কেমন যেন ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম আমি।
সে দিন খেলা দেখতে দেখতেই মনে মনে নিজেকে বলেছিলাম, চুনী গোস্বামীর মতো হতে না পারলে ফুটবলার হওয়ার কোনও মূল্য নেই। কলকাতা লিগের পরেই ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে দেহরাদুনে ফিরে গিয়েছিলাম। সই করেছিলাম গোর্খা ব্রিগেডে। সত্তর সালে ইস্টবেঙ্গলে ফিরে জানতে পারলাম, চুনীদা অবসর নিয়েছেন। মনটা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তবে চুনীদার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হল ১৯৭৭ সালে মোহনবাগানে সই করার পরে। আমি তখন চুনী স্যর বলতাম। অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ছিল চুনীদার। শুধু সম্মান নয়, সকলে প্রচণ্ড সমীহ করতেন ওঁকে। চুনীদার উপস্থিতিতে চারপাশ আলোকিত হয়ে উঠত। খেলতে না পারার জন্য কোনও দিন কারও সমালোচনা করেননি। ম্যাচ হারলে বলতেন, ‘‘যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। পরের ম্যাচে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে হবে।’’ আর জিতলে ড্রেসিংরুমের দরজার দাঁড়িয়ে বলতেন, ‘‘দারুণ খেলেছো তোমরা।’’ দীর্ঘ দিন মোহনবাগানে খেলেছি।কিন্তু কখনওই চুনীদাকে কোনও ব্যাপারেই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়তে দেখিনি। চুনীদা জানতেন না যে আমি ওঁকে নিজের গুরু মনে করতাম। চেষ্টা করতাম চুনীদাকে নকল করার। শুধু খেলা নয়। ওঁর মতো ইংরেজিতে কথা বলা, হাঁটা থেকে হাসি—সবই নকল করার চেষ্টা করতাম। শুধু ওঁর মতো ক্রিকেট ও টেনিস খেলার চেষ্টা কখনও করিনি। জানতাম, চুনীদা এক জনই হয়। মনে পড়ে যাচ্ছে,কোনও ম্যাচে হয়তো বিপক্ষের তিন-চার জনকে কাটিয়ে গোল করেছি। সমর্থকেরা আমাকে কাঁধে তুলে নাচছেন। আমি কিন্তু ভিড়ের মধ্যে এক জনকেই খুঁজতাম। তিনি, চুনীদা।যে দিন উনি আমার কাঁধে হাত রেখে বলতেন, ‘‘শ্যাম থাপা তুমি তো দেখছি আমার মতো ড্রিবল করছো,’’ শুনে আনন্দে মনটা ভরে উঠত। আমার কাছে ম্যান অব দ্য ম্যাচের চেয়েও মূল্যবান ছিল চুনীদার প্রশংসা। আমার জীবনের সেরা পুরস্কারও পেয়েছিলাম চুনীদার কাছ থেকে। ১৯৭৮ সালে ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে ব্যাকভলিতে গোলের পরে চুনীদা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, ‘‘ব্যাকভলিতে তোমার মতো গোল আমি কখনও করতে পারিনি শ্যাম।’’ এই কথাটা এখনও আমার কানে বাজে। চুনীদা আমার আদর্শ। মনে মনে যাঁকে গুরু মানতাম, সেই চুনীদা বলছেন, তোমার মতো গোল করতে পারিনি। এর চেয়ে সেরা প্রাপ্তি আর কী হতে পারে। সাউথ ক্লাবে টেনিস খেলতে খেলতে আবিষ্কার করেছিলাম অন্য চুনীদাকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy