মুগ্ধ: শিল্ড ফাইনাল জেতার পরে শ্যাম থাপাকে চুম্বন পিকে-র। ফাইল চিত্র
সপ্তাহ খানেক আগে আমার ফুটবল গুরু প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় অসুস্থ শোনার পরে ধর্মশালায় গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, ফিরে এসে নিশ্চয়ই ভাল খবর পাব। এ যাত্রায় সুস্থ হয়েই বাড়ি ফিরবেন প্রদীপদা। শুক্রবার সকাল সাড়ে এগারোটায় কলকাতা ফিরেছি। আর তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এক সাংবাদিক বন্ধুর কাছ থেকে দুঃসংবাদটা পেলাম। তাই মনটা ভারাক্রান্ত।
প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় না থাকলে আমি ফুটবলার হতে পারতাম কি না সন্দেহ। ছোট থেকেই তিনি আমার কাছে শ্রদ্ধার আসনে। কারণ কলকাতার দুই বড় দল মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গলে না খেলেও প্রদীপদা এশিয়ান গেমসে চ্যাম্পিয়ন। রোম অলিম্পিক্সে ভারতের অধিনায়ক। এটা আমার মতো একজন তরুণ ফুটবলারকে দারুণ উজ্জীবিত করত।
কোচ হিসেবে প্রদীপদাকে প্রথম পাই সত্তর সালে ব্যাঙ্কক এশিয়ান গেমসে। ১৯৭৪ সালে আমি মুম্বইয়ের মফতলালে খেলতাম। মরসুম শেষ হওয়ার পরে প্রদীপদার ফোন পেলাম। ইস্টবেঙ্গল তখন টানা পাঁচ বছর লিগ জিতে মহমেডান স্পোর্টিংয়ের রেকর্ড স্পর্শ করেছে। সে বার লিগ জিতলেই প্রদীপদার কোচিংয়ে নতুন রেকর্ড গড়বে ইস্টবেঙ্গল। আর সে বারই হাবিব-আকবর ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে গেল মহমেডানে। প্রদীপদা সে দিন ফোনে বলেছিলেন, ‘‘ইস্টবেঙ্গল নতুন রেকর্ড করতে চাইছে টানা ষষ্ঠ বার লিগ জিতে। সেটা তোমাকে না পেলে করতে পারব না। এ বার ইস্টবেঙ্গলে চলে এসো। তোমাকে আমি তারকা বানাব।’’ প্রদীপদার সেই আন্তরিকতাই আমাকে টেনে এনেছিল ইস্টবেঙ্গলে।
সে বার কলকাতায় খেলতে এসে দেখলাম, ফুটবলাররা অনেকেই চাকরি করে। অনুশীলন হলেই সতীর্থরা অফিস ছোটে। একদিন প্রদীপদা আমাকে বললেন, ‘‘তোর তো চাকরি নেই, চল শ্যাম, ওরা চাকরি করুক। আমি তোকে বড় ফুটবলার বানাই।’’ এই বলে আমাকে নিয়ে বিশেষ অনুশীলন করাতেন। তার মধ্যে ছিল বল নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে ড্রিবল। স্পট জাম্প। এমনকি সেই ব্যাককভলিও। রোজ বলতেন, ‘‘শ্যাম মাঠে নেমে প্রমাণ করো, তুমি গোর্খা যুবকদের কাছে এক আদর্শ।’’ রোজ কথাটা বলতেন তিনি। আর আমার ভাল খেলার জেদ বাড়ত।
পঁচাত্তরের লিগে ইডেনে মোহনবাগানের চার ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে গোল করার পরে সমর্থকদের কাঁধে চেপে ইস্টবেঙ্গল তাঁবুতে ফিরেছিলাম। ওটা আমার জীবনের একটা স্মরণীয় গোল। আর তার পরে সেই ঐতিহাসিক পাঁচ গোলের ম্যাচ। যে ম্যাচে আমি জোড়া গোল করেছিলাম। সে দিন পেনাল্টি নষ্ট না করলে আমার হ্যাটট্রিক হয়ে যেত। মনে আছে, ঐতিহাসিক সেই ম্যাচের আগে যখন ইস্টবেঙ্গল তাঁবু থেকে বেরোচ্ছি, তখনও প্রদীপদা বলেছিলেন, ‘‘হাবিবরা নেই। শ্যাম তুমি কিন্তু আমার ভরসা। লিগে যে রকম দুরন্ত গোল করেছিলে, সে রকম খেলে আজ নজির গড়তে হবে।’’ আর ম্যাচটা ৫-০ জেতার পরে সেই প্রদীপদাই গালে চুমু দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘কী করলে তুমি শ্যাম? পেনাল্টি থেকে গোলটা পেলে বড় ম্যাচে প্রথম হ্যাটট্রিকের রেকর্ডটা তুমিই করতে।’’
সেই প্রদীপদার কোচিংয়েই ১৯৭৭ সালে মোহনবাগানে খেলেছি। সে বার সবুজ-মেরুন জার্সি গায়ে লিগ না পেলেও ত্রিমুকুট জিতেছিলাম। আর তার পরে আটাত্তরের লিগের বড় ম্যাচে সেই বাইসাইকেল ভলিতে করা গোল যা আমার জীবনের আরও একটা স্মরণীয় ঘটনা। যে গোলের পরে প্রদীপদা বলেছিলেন, ‘‘মনপ্রাণ ঢেলে তোমাকে যা শিখিয়েছি, তার গুরুদক্ষিণা আজ তুমি দিলে।’’
প্রদীপদা তৈরি করেছেন কোচ শ্যাম থাপাকেও। ওঁর সহকারী হয়ে ইস্টবেঙ্গলে কোচিং শুরু করেছিলাম আশির দশকের মাঝামাঝি। তার পরে পূর্ণ দায়িত্ব পাই। তখন রোজ বিকেলে প্রদীপদা আমাকে নিয়ে বসতেন কোচিং শেখাতে। উপহার দিতেন কোচিংয়ের উপরে দুর্দান্ত সব বই। বলতেন, ‘‘না পড়লে বড় কোচ হতে পারবে না শ্যাম।’’ প্রদীপদার সেই শিক্ষা কাজে লাগিয়েই পরবর্তীকালে নেপালের জাতীয় দলের কোচ হয়েছিলাম।
কাজেই আমার কাছে প্রদীপদা হলেন দ্রোণাচার্য। যিনি আমাকে খেলোয়াড় ও কোচ হিসেবে দিয়েছেন প্রচুর। যা শ্যাম থাপা দু’হাত ভরে নিয়েছে। শুক্রবার যখন গুরুকে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে ফিরছি, তখনও কানে বাজছিল পঁয়তাল্লিশ বছর আগের সেই কথাটা— ‘‘শ্যাম তোমাকে আমি তারকা বানাব।’’ জীবনের আকাশ থেকে এ রকম একজন ধ্রুবতারা খসে পড়ায় তাই খুব দিশাহীন লাগছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy