প্রতিবাদ: স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে ম্যাচের আগে বিদ্রোহী সুপার লিগের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন চেলসির সমর্থকেরা। রয়টার্স
ফুটবলের ভাষায় ‘কিক-অফ’ হওয়ার অনেক আগেই মুখ থুবড়ে পড়ল বিদ্রোহী সুপার লিগ। একের পর এক ক্লাব নাটকীয় ভাবে সরে দাঁড়াতে থাকায় এই লিগের উৎক্ষেপণ ঘটাই এখন অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রথম আঘাত আসে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবগুলির দিক থেকে। যে ছ’টি সেরা ক্লাবের যোগ দেওয়ার কথা ছিল সুপার লিগে, তারা প্রত্যেকেই নাম প্রত্যাহার করে নেয়। ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড, ম্যাঞ্চেস্টার সিটি, চেলসি, লিভারপুল, আর্সেনাল এবং টটেনহ্যাম হটস্পার— এই ছ’টি শীর্ষস্থানীয় ক্লাব জানিয়েছিল, তারা বিদ্রোহী লিগে নামবে।
কিন্তু সম্মতি দেওয়ার মাত্র দু’দিনের মধ্যেই প্রবল জনরোষে পড়ে একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে যেতে বাধ্য হল তারা। সবার প্রথমে প্রত্যাহারের কথা জানা ম্যাঞ্চেস্টার সিটি। মাত্র একটি বাক্যের বিবৃতি দিয়ে ক্লাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়, তারা নাম প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে। এর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বাকি পাঁচটি ক্লাবও সঙ্কেত দেয়, তারাও একই পথে হাঁটার কথা ভাবতে শুরু করেছে। এর পরে দ্রুতই মিলিয়ে যায় সুপার লিগের ভবিষ্যৎ। একটা ফুটবল ম্যাচের ফয়লাসা হতে যে ন্যূনতম ৯০ মিনিট লাগে, সেই সময়টুকুও লাগেনি লিগের সম্ভাবনায় তালাচাবি পড়ে যেতে। কিছু ক্ষণের মধ্যে ইটালির বড় ক্লাব ইন্টার মিলান জানিয়ে দেয়, তারাও এই অভিযানে আর নেই। ইউরোপের সময় মঙ্গলবার মধ্যরাতে একের পর এক ক্লাব নাম প্রত্যাহার করতে থাকে বিদ্রোহী লিগ থেকে। সুপার লিগ আয়োজকদের এক জন একটু পরে স্বীকার করে নেন, প্রস্তাবিত লিগ বন্ধ করে দিতে হচ্ছে। বাইরে থেকে চাপ দিয়ে লিগ বন্ধ করা হল বলেও তাঁদের কেউ কেউ অভিযোগ জানাতে থাকেন।
ঘটনা হচ্ছে, দুনিয়া জুড়ে যে রকম প্রতিবাদের লাভা উদগীরণ হয়েছে এই বিদ্রোহী লিগকে কেন্দ্র করে, তা দেখেই সম্ভবত পিছু হঠতে বাধ্য হয়েছে নামী ক্লাবগুলির মালিকেরা। প্রায় সব ক্লাবের ভক্তরাই সুপার লিগের উদ্দেশে তোপ দেগে মালিক, কর্তাদের এক হাত নিয়েছেন। সকলেই জোরালো ভাবে বলেছেন, টাকার কাছে বিকিয়ে গিয়েছেন মালিকেরা। ভক্তদের ভালবাসা, ক্লাবের গৌরব উপেক্ষা করে শুধুই আর্থিক মুনাফাকে প্রাধান্য দিয়ে নতুন লিগ খেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ইপিএলের ক্লাবগুলির গেটের বাইরে অনেকে পুষ্পস্তবক রেখে দিয়ে আসে। পাশে লেখা শান্তিতে ঘুমাও প্রিয় ক্লাব। যার অর্থ, ভক্তদের হৃদয়ে মৃত্যু ঘটে গিয়েছে প্রিয় ক্লাবের। সঙ্গে ফিফা, উয়েফার মতো সংস্থার হুমকি যে, সকলকে স্বীকৃত সব টুর্নামেন্ট থেকে বহিষ্কার করা হবে। এমনকি, সুপার লিগে খেলা ফুটবলারদের বিশ্বকাপ বা ইউরোতেও খেলতে দেওয়া হবে না বলে জানায় তারা। এ সব দেখেই টনক নড়ে ক্লাব কর্তৃপক্ষগুলির। ইংল্যান্ডের একটি সংবাদপত্রের খবর, কয়েকটি ক্লাবের ফুটবলারেরা ইপিএলের ম্যাচ চলাকালীনই একজোট হয়ে ক্লাব কর্তৃপক্ষকে জানায়, তাঁরা বিদ্রোহী লিগে কিছুতেই খেলতে চান না। তার কারণ, এই লিগে খেললে দেশের হয়ে বিশ্বকাপ, ইউরোর মতো প্রতিযোগিতায় খেলার ছাড়পত্র তাঁরা হারাবেন।
লিভারপুলের ম্যানেজার য়ুর্গেন ক্লপ বিবৃতি দেন, তাঁর সঙ্গে বা ফুটবলারদের সঙ্গে আলোচনা না করেই ক্লাব বিদ্রোহী লিগে খেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ম্যাঞ্চেস্টার সিটি এই লিগে খেলার কথা ঘোষণা করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পেপ গুয়ার্দিওলা সাংবাদিক সম্মেলনে এসে তোপ দাগেন, ‘‘যদি হারলে কিছু না এসেই যায়, তা হলে সেটা কোনও খেলাই নয়!’’ গুয়ার্দিওলার ইঙ্গিত ছিল, প্রস্তাবিত সুপার লিগে পদ্ধতির দিকে। ১৫টি ক্লাবের কেউ অবনমনে যাবে না বলে জানানো হয়েছিল। খারাপ ফল করলেও প্রত্যেক বার তারা লিগে খেলতে পারত। যা চ্যাম্পিয়ন্স লিগে দেখা যায় না। সেখানে প্রত্যেকটি দেশের লিগ থেকে সেরা দলগুলিই শুধু খেলার ছাড়পত্র পায়। ঘরোয়া লিগে ভাল করতে না পারলে তার দরজা বন্ধ হয়ে যায়, তা সে যত বড় নামই হোক না কেন। আর্সেনাল যেমন চার মরসুম ধরে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে পারছে না। কিন্তু সুপার লিগে তাদের প্রত্যেক বার অংশগ্রহণ নিশ্চিত ছিল। পেপের এমন মন্তব্যের কিছুক্ষণের মধ্যেই ভাবান্তর দেখা দেয় ম্যাঞ্চেস্টার সিটির উচ্চ মহলে। তেমনই করোনা অতিমারির দ্বিতীয় স্রোত চলার মধ্যেও চেলসি ভক্তরা ক্লাবের সামনে প্রতিবাদী মিছিল বার করেন। বিশ্ব জুড়ে প্রাক্তন, বর্তমান ফুটবলারেরা প্রতিবাদে সামিল হন। দূর দূরান্তে প্রিয় ক্লাবের ভক্তরা গর্জে ওঠেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় তুলে ভক্তরা বিদ্রোহী ক্লাবগুলিকে বয়কটের ডাক দেন।
সব মিলিয়ে প্রবল চাপ তৈরি হয় ক্লাবগুলির উপরে। ম্যান সিটি সুর পাল্টানোর পরেই টটেনহ্যাম হটস্পারের পক্ষ থেকে বিবৃতি চলে আসে, এমন একটা লিগের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তারা ভুল করেছে। কিছুক্ষণ পরে ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের কর্তাদের গলাতেও অনুশোচনার সুর। তাঁরা স্বীকার করে নেন, ভক্তদের কণ্ঠ শুনে মন পাল্টেছে তাঁদের। ইংল্যান্ডের মুখ্য ক্লাবগুলির মত পাল্টানোর নেপথ্যে ব্রিটিশ সরকারের ভূমিকাও থাকতে পারে কারও কারও অনুমান। প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন শুরু থেকেই এই লিগের বিরোধিতা করেছিলেন। ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের পক্ষ থেকে আরও একটি ঘোষণা আসে। তাদের এগজিকিউটিভ ভাইস চেয়ারম্যান এড উডওয়ার্ড এ বছরের শেষেই ক্লাব ছেড়ে চলে যাবেন। এই উডওয়ার্ড বিদ্রোহী লিগে ‘রেড ডেভিল্স’-এর যোগদান নিশ্চিত করার ব্যাপারে প্রধান কারিগর ছিলেন।
রাতারাতি ইপিএলের ছ’টি ক্লাবকে হারিয়ে সুপার লিগ জন্মের আগেই অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়ে যায়। তখনই পরিষ্কার হয়ে যায়, স্পেন আর ইটালির বাকি ছয় ক্লাবকে নিয়ে লিগ চালু করলে তা টিভি স্বত্ব বা বিজ্ঞাপন বাজারে তেমন আকর্ষণ তৈরি করতে পারবে না। এর কিছুক্ষণের মধ্যে আবার ইটালির ইন্টার মিলান এবং স্পেনের আতলেতিকো দে মাদ্রিদও পিছু হঠেছে বলে খবর শোনা যায়।
রিয়াল মাদ্রিদের প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ়, যিনি বিদ্রোহী লিগের পিছনে প্রধান মস্তিষ্ক বলে মনে করা হচ্ছে, তিনি চব্বিশ ঘণ্টা আগেই বলেছিলেন, এমন ভাবে চুক্তি করা হয়েছে যাতে ১২টি দলের কেউ লিগ থেকে নাম প্রত্যাহার করতে পারবে না। এক দিনের মধ্যে তার মুখের উপর অর্ধেক দল ফাঁকা হয়ে যায়। জার্মানির বায়ার্ন মিউনিখ বা বরুসিয়া ডর্টমুন্ড এবং ফ্রান্সের প্যারিস সাঁ জারমাঁর মতো দল ইতিমধ্যেই বিদ্রোহী লিগে হাত মেলাতে অস্বীকার করেছে। বুধবার রাত পর্যন্ত পাওয়া খবর, ১২টির মধ্যে ৯টি ক্লাব সরে দাঁড়িয়েছে। সুপার লিগের মাথা তুলে দাঁড়ানোর আর কোনও সম্ভাবনা বেঁচে নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy