রোহন বোপান্না। ছবি: পিটিআই।
টেনিস এমন একটা খেলা যেখানে শারীরিক সক্ষমতার তুঙ্গে থাকতে হয়। বয়স বাড়লে সেই সক্ষমতা যে কমবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু রোহন বোপান্নাকে দেখলে সেটা মোটেই বোঝার উপায় নেই। ৪৩ বছর বয়সেও তিনি কোর্ট দাপাচ্ছেন। দাপুটে টেনিস খেলছেন। ১৩ বছর পর ইউএস ওপেনের ফাইনালে উঠেছিলেন। জিতলে জীবনের দ্বিতীয় গ্র্যান্ড স্ল্যামটি পেতে পারতেন। কিন্তু ১৩ বছর আগের সেই আক্ষেপ থেকেই গেল। সে বারও ফাইনালে হেরেছিলেন। এ বারও তার ব্যতিক্রম হল না। কফিই যাঁর সাফল্যের রহস্য, সেই বোপান্না হেরে গেলেও মাথা থাকছে উঁচুই। কারণ তিনি এমন এক জন খেলোয়াড় যাঁকে শুধু সাফল্য দিয়ে বর্ণনা করা যায় না।
এই ডাবলসেই কিছু দিন আগে পর্যন্ত খেলে চলেছিলেন লিয়েন্ডার পেজ়। অবশেষে প্রায় ৪৫ বছরে গিয়ে তিনি টেনিস থেকে সরে আসেন। বোপান্না যেন তাঁরই উত্তরসূরি। তবে সাফল্যের দিক থেকে পেজ়ের ধারেকাছেও আসবেন না। পেজ় সারা জীবনে ১৮টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতেছেন। বোপান্না মাত্র একটি। কিন্তু বয়সকে হার মানানোর ব্যাপারে দু’জনেই সমান।
অন্যদের থেকে দেরি করে টেনিস খেলা শুরু করেছিলেন বোপান্না। কার্লোস আলকারাজ় যে বয়সে গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতে নিয়েছিলেন, সেই বয়স থেকে সবে টেনিসকে গুরুত্ব দিতে শুরু করেছিলেন বোপান্না। ১৯৮০ সালের ৪ মার্চ কর্নাটকের বেঙ্গালুরুতে জন্ম বোপান্নার। ছোটবেলা থেকে হকি এবং ফুটবল খেলতেই বেশি ভালবাসতেন। কিন্তু বাবা এমজি বোপান্না চাইতেন, ছেলে ব্যক্তিগত কোনও খেলা খেলুক। বাবার ইচ্ছেতেই টেনিসে আসা।
ছোট থেকে দু’জনেই বোপান্নার খেলাধুলোয় প্রচুর সাহায্য করেছেন। তখন তাঁরা থাকতেন কুর্গে। ছ’ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে বেঙ্গালুরুতে অনুশীলন করাতে নিয়ে আসতেন বোপান্নাকে। টেনিস খেলা শুরু করার পর থেকে স্টেফান এডবার্গ ছিলেন বোপান্নার আদর্শ। কিন্তু এডবার্গের মতো সিঙ্গলস নয়, বোপান্না হাত পাকিয়েছেন ডাবলসে। সিঙ্গলস যে একেবারে খেলেননি তা নয়। কিন্তু অল্প সময়েই বুঝতে পেরেছিলেন, সাফল্য পেতে গেলে ডাবলসই তাঁর সেরা অস্ত্র। সেই মতো নিজেকে প্রস্তুত করতে শুরু করেছিলেন।
প্রথম দিকে শুরু করেছিলেন জুনিয়র সার্কিটে। তার পরে ১৯৯৯ সালে তিনি সিনিয়র পর্যায়ে খেলতে শুরু করেন। পেশাদার খেলোয়াড় হিসাবে আত্মপ্রকাশ ২০০৩-এ। একাধিক চ্যালেঞ্জার ট্রফি জিতলেও, বোপান্নার প্রথম এটিপি ট্রফি ২০০৮-এ। আমেরিকার এরিক বুতোরাককে নিয়ে লস অ্যাঞ্জেলেস ওপেন জেতেন। এখনও পর্যন্ত ২৪টি এটিপি ডাবলস খেতাব জিতেছেন। তার মধ্যে পাঁচটি এটিপি মাস্টার্স খেতাব রয়েছে।
দীর্ঘ টেনিসজীবনে প্রচুর ডাবলস খেলোয়াড়কে সঙ্গী করেছেন তিনি। তবে সবচেয়ে ভাল দুটি নাম নিঃসন্দেহে আইসাম উল হক কুরেশি এবং মহেশ ভূপতি। প্রথম বার ২০০৭ সালে পাকিস্তানের কুরেশির সঙ্গে জুটি বাঁধেন বোপান্না। সেই সময় দুই দেশেই আলোড়ন উঠেছিল। অতীতে কখনও পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের কেউ জুটি বাঁধেননি। ফলে টেনিস কোর্টে নতুন জিনিস দেখতে পেয়েছিলেন সমর্থকেরা। ২০০৮ সালে মুম্বই হামলার ঘটনার পরেও কুরেশি এবং বোপান্নার সম্পর্কে ছেদ হয়নি। দু’জনকে একসঙ্গে ‘ইন্দো-পাক এক্সপ্রেস’ বলে ডাকা হত। কোর্টে তাঁদের বন্ধুত্বও ছিল দেখার মতো। দু’দেশের সম্পর্কও অনেক সহজ হয় টেনিস কোর্টে এই জুটি তৈরি হওয়ার পরে। ২০১০-১৪-র মধ্যে পাঁচটি ট্রফি জিতেছিলেন তাঁরা।
কুরেশির সঙ্গে জীবনের সোনালি সময় কাটিয়েছেন বোপান্না। ২০১১ সালে তাঁরা প্যারিস মাস্টার্স জেতেন, যা বোপান্নার জীবনের প্রথম মাস্টার্স খেতাব। ২০১০ সালে ইউএস ওপেনের ফাইনালে ওঠাও কুরেশির সঙ্গেই। এক সময় দু’জনের জুটি ভেঙে যায়। কিন্তু বন্ধুত্ব এখনও অটুট রয়েছে।
তবে কেরিয়ারের বেশির ভাগ এটিপি ট্যুর লেভেলের প্রতিযোগিতায় ট্রফি জেতা ভূপতির সঙ্গেই। কিন্তু বিতর্কও সঙ্গী হয়েছে বার বার। ২০১২ সালে লন্ডন অলিম্পিক্সের সময় ফর্মের তুঙ্গে ছিলেন লিয়েন্ডার। কিন্তু তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত বিরোধিতার কারণে কিছুতেই জুটি বাঁধতে রাজি হননি বোপান্না। অনেক অনুরোধ-উপরোধেও রাজি হননি। শেষ পর্যন্ত ভূপতির সঙ্গে জুটি বাঁধার অনুমতি দেওয়া হয়। লিয়েন্ডার জুটি গড়েন বিষ্ণু বর্ধনের সঙ্গে।
দীর্ঘ দিন ধরে টেনিস খেললেও এখনও পর্যন্ত মাত্র একটি ট্রফি রয়েছে বোপান্নার। ২০১৭ সালে ফরাসি ওপেনে মিক্সড ডাবলস জেতেন গ্যাব্রিয়েলা ডাব্রোস্কিকে নিয়ে। এর পর মিক্সড ডাবলসে আরও দু’বার ফাইনালে উঠেছেন তিনি। ২০১৮ সালে টিমিয়া বাবোসকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের ফাইনালে ওঠেন। এ বছরের অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের ফাইনালে উঠেছিলেন সানিয়া মির্জাকে নিয়ে। দু’বারই হেরে যান।
২০০২ সাল থেকে ডেভিস কাপে খেলছেন বোপান্না। শুরু থেকেই দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ তিনি। ২০১৮ এশিয়ান গেমসে দ্বিবীজ শরণের সঙ্গে জুটি বেঁধে ডাবলসে সোনা জেতেন। ২০১৩-র জুলাইয়ে পুরুষ ডাবলসে তিন নম্বর স্থানে উঠে এসেছিলেন বোপান্না। সেটাই এখনও পর্যন্ত তাঁর কেরিয়ারের সেরা র্যাঙ্কিং।
বোপান্নার খেলার মূল অস্ত্র হল তাঁর শক্তিশালী সার্ভিস। জোরালো সেই সার্ভিসের রিটার্ন করতে গিয়ে সমস্যার মধ্যে পড়তে হয় প্রতিপক্ষকে। দ্বিতীয় সার্ভিসের ক্ষেত্রেও তাঁর সাফল্যের হার ভালই। এ ছাড়া নেটের সামনেও তিনি অসাধারণ। শারীরিক নমনীয়তা ভাল হওয়ার কারণে বিপক্ষের শট রিটার্ন করতে অসুবিধা হয় না। এই কারণেই ডাবলসে তাঁর রেকর্ড ভাল।
বোপান্নার দুর্বলতা হল তাঁর গ্রাউন্ডস্ট্রোক। কোর্টের দুই প্রান্ত থেকে শক্তিশালী গ্রাউন্ডস্ট্রোক মারতে পারেন। কিন্তু প্রচুর ভুল করেন। ফলে ‘উইনার’-এ পয়েন্ট পেলেও ‘আনফোর্সড এরর’-এর কারণে তাঁকে অনেক পয়েন্ট খোয়াতে হয়েছে। এ ছাড়া, লম্বা র্যালিতে তিনি স্বচ্ছন্দ নন। যে কারণে ধীরগতির কোর্টে তাঁর সাফল্যের হার কম। উইম্বলডন জেতা তাঁর স্বপ্ন থাকলেও আজ পর্যন্ত তা সফল হয়নি।
বাবা ছিলেন কফি বাগানের মালিক। সেই কারণেই ছোট বেলা থেকে কফির প্রতি আলাদা প্রেম রয়েছে বোপান্নার। এখন তাঁর নিজস্ব কফির ব্র্যান্ড রয়েছে। তিনি আর অন্য কোনও সংস্থার কফি খান না। নিজের ব্র্যান্ডের প্রচারও করেন সুযোগ পেলেই।
এ বছর মার্চে ড্যানিয়েল নেস্টরের নজির ভেঙে সবচেয়ে বেশি বয়সি খেলোয়াড় হিসাবে এটিপি ১০০০ খেতাব জেতার পরে বোপান্না জানিয়েছিলেন, কফিই তাঁর সাফল্যের উৎস। বলেছিলেন, “এই ভারতীয় আমি সব সময় বিদেশে গেলে সঙ্গে রাখি। এটাই আমার সাফল্যে কারণ। ম্যাচের পর ক্লান্তি সারিয়ে উঠতে এটাই সাহায্য করে। এখন বয়স হচ্ছে। তাই নিজের শারীরিক দিকটা খেয়াল রাখা দরকার।”
বয়স হয়েছে। আর কত দিন খেলতে পারবেন সেটা নিজেও জানেন না। হয়তো ইউএস ওপেনই তাঁর শেষ গ্র্যান্ড স্ল্যাম ট্রফি। অবসর নিলেও বোপান্না যে মাথা উঁচু করেই বিদায় নেবেন, তা এখনই বলে দেওয়া যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy