বিশ্বসেরা: ফাইনালে ওকুহারাকে হারানোর পরে উচ্ছ্বাস সিন্ধুর। রবিবার সুইৎজ়ারল্যান্ডের বাসেলে। ছবি: রয়টার্স।
বছর ছয়েক আগের কথা। আমি তখন জাতীয় দলের মেয়েদের কোচ। মনে আছে, তখন সিন্ধু যেখানেই খেলতে নামছিল শুধু ব্রোঞ্জ জিতছিল। সে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ হোক বা উবের কাপ। সিন্ধু তখন হতাশায় মাঝে মধ্যে আমায় বলত, ‘‘ম্যাম শুধু ব্রোঞ্জই পাচ্ছি। কেন সোনা বা রুপো পাচ্ছি না।’’ সিন্ধুকে তখন বলতাম, ‘‘দেখবি এক দিন পদকের রঙটা পাল্টাবেই।’’ রবিবার টিভিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনাল দেখার সময় সেই দিনটার কথা বারবার মনে পড়ে যাচ্ছিল।
শাবাশ সিন্ধু! কী দুরন্ত খেলাটাই না দেখাল! ৩৭ মিনিটের ঝড়ে ২১-৭, ২১-৭ ফলে জাপানের নজ়োমি ওকুহারাকে উড়িয়ে দিয়ে প্রথম ভারতীয় ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় হিসেবে এই মঞ্চে জিতল সোনা। জেতার পরে দেখলাম, মায়ের জন্মদিনে তাঁকেই এই জয় উৎসর্গ করল সিন্ধু। মায়ের কাছে এমন দিনে মেয়ের বিশ্বজয়ের চেয়ে সেরা উপহার আর কী হতে পারে!
এই ওকুহারাই কিন্তু দু’বছর আগে ওকে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে ফাইনালে হারিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু আজ ওকুহারাকে সিন্ধু লড়াই করার কোনও সুযোগই দেয়নি অনবদ্য স্ট্র্যাটেজিতে। কি ছিল সেই স্ট্র্যাটেজি? ওকুহারাকে শাটলের কাছে পৌঁছতে না দেওয়া। তার জন্য শাটলকে ক্রমাগত কোর্টের পিছনের দিকে ঠেলে দেওয়া, আবার কোর্টের সামনের দিকে নিয়ে আসা। শারীরিক উচ্চতার দিক থেকে ওকুহারার (পাঁচ ফুট এক ইঞ্চি) চেয়ে সিন্ধুর (পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি) এগিয়ে থাকার সুবিধে থাকায়, স্ট্র্যাটেজিটা দারুণ ভাবে কাজে লেগে গিয়েছে। ওকুহারাকে কখনই শাটলের নীচে আসতে দেয়নি সিন্ধু। তাই শাটলকে ইচ্ছে মতো স্ম্যাশ করা বা কোর্টের ফাঁকে ঠেলে দেওয়ার সুযোগ
পায়নি ওকুহারা।
যদিও বা কয়েক বার ওকুহারা শাটল মিড কোর্টে তুলে পজিশন নিতে গিয়েছে, সিন্ধু স্ম্যাশ করে সেই প্রয়াস ব্যর্থ করেছে। এমনিতেই সিন্ধুর উচ্চতা বেশি হওয়ার সুবিধে ওকে কোর্টের যে কোনও প্রান্তে শাটলের কাছে পৌঁছে যেতে সাহায্য করে। তার উপরে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ওর যে রকম দুর্ধর্ষ ফিটনেস দেখলাম, ওকুহারার শটের কাছাকাছি পৌঁছে যেতে সিন্ধুর কোনও সমস্যাই হয়নি তাই। গোটা ম্যাচটায় দাপট দেখা গিয়েছে তাই সিন্ধুরই।
এই সাফল্যের পিছনে সিন্ধুর প্রস্তুতি পর্বেরও বড় ভূমিকা রয়েছে। এ মরসুমে তাইল্যান্ড ওপেনেও নামেনি ও। যাতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য তিন-চার সপ্তাহ প্রস্তুতি নেওয়ার সময় পায়। কোর্টের বাইরে সিন্ধুর এই কঠোর পরিশ্রমে ওর শারীরিক ফিটনেস এবং মানসিক শক্তিও অনেক বেড়েছে। ফিটনেস সেই পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে বলেই শাটলের নীচে আগের থেকে আরও দ্রুত পৌঁছে যেতে পারছে ও।
অনেকে বলতে পারেন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে তিন বারের চ্যাম্পিয়ন এবং সিন্ধুর প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী ক্যারোলিনা মারিন এ বার খেলেননি। তাই সুবিধে হয়েছে সিন্ধুর। তাঁদের বলব, রিয়ো অলিম্পিক্স ফাইনালে হয়তো মারিন সিন্ধুকে হারিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু তার পরে মারিনকে যে সিন্ধু হারাতে পারেনি তা কিন্তু নয়। গত বছর মালয়েশিয়া ওপেনেই তো সিন্ধু হারিয়েছে মারিনকে। তা ছাড়া ২০১৭ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপেও তো মারিন কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই ছিটকে গিয়েছিল। এ বারও খেললে যে সিন্ধুর সামনে পড়ার আগেই হেরে যেত না কে বলতে পারে।
এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলি, খেলোয়াড়দের জীবনে কিন্তু ওঠা-পড়া থাকেই। গত মরসুমের শেষে টুর ফাইনালসে জেতার পরে চলতি মরসুমে এই প্রথম ট্রফি জিতল সিন্ধু। তার আগে শুধু ইন্দোনেশিয়া ওপেন ছাড়া আর কোনও প্রতিযোগিতায় ফাইনালে উঠতে পারেনি। এ সব দেখে অনেকেই সিন্ধুর এ মরসুমের পারফরম্যান্সের সমালোচনা করতে ছাড়েননি। সিন্ধুর র্যাকেট আজ সমালোচকদের জবাবটা দিয়ে দিল। সমালোচকরা ভুলে যান, এক জন খেলোয়াড়ের ধারাবাহিকতা ধরে রাখা সোজা কথা নয়। তা ছাড়া এখন প্রতি মাসেই দুটো করে প্রতিযোগিতা খেলতে হয়। তার জন্য প্রস্তুতি নিতে হয়। সেই চাপটা সামলানো বেশ কঠিন। তাই ব্যর্থতার পরে খেলোয়াড়দের সমালোচনা করা ঠিক নয়। বরং তাদের আরও উৎসাহ দেওয়া উচিত। যাতে দ্বিগুণ ভাবে তারা পরের প্রতিযোগিতায় ফিরে আসতে পারে।
তার সঙ্গে আরও একটা কথা বলব সিন্ধুর ধারাবাহিকতা এখন অনেক বেড়েছে। খেলোয়াড় জীবনের শুরুর দিকে আন্তর্জাতিক সার্কিটে যখন ও খেলতে নামত, তখন একটাই স্ট্র্যাটেজি নিয়ে নামত। আক্রমণ আর আক্রমণ। এখন সিন্ধু অনেক পরিণত। বিপক্ষ অনুযায়ী ছক কষে সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী খেলতে নামে। সেই কারণেই বহুদিন বিশ্বের এক নম্বরে থাকা তাই জু ইং বা এখন বিশ্বের চার নম্বর চেন উফেই এর মতো প্রতিদ্বন্দ্বীদের হারিয়ে ফাইনালে উঠতে পেরেছে।
আসলে সিন্ধু বড় মঞ্চের খেলোয়াড়। সেই কারণেই বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে পাঁচ-পাঁচটা পদক জিতে নিল। টানা তিন বার ফাইনালে উঠল। অনেকে জানতে চাইতে পারেন এই ফর্মে খেললে আগামী বছর টোকিয়ো অলিম্পিক্সে সিন্ধুর সোনা জেতার সম্ভাবনা কতটা?
উত্তরটা দিতে গিয়ে লেখার শুরুতে উল্লেখ করা ঘটনাটা আবার মনে পড়ে যাচ্ছে। একাধিক প্রতিযোগিতায় ব্রোঞ্জ জেতার পরে সিন্ধুকে সান্ত্বনা দেওয়ার সময়ও আমার বিশ্বাস ছিল, এই মেয়ে এক দিন বিশ্বজয় করবে। তার পরে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ২০১৩-’১৪-এ দু’বার ব্রোঞ্জ পাওয়ার পরে সিন্ধু অলিম্পিক্সে রুপো জিতল। এর পরে ২০১৭-’১৮-তে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে পেল পরপর দুটো রুপো। সেই মঞ্চেই রবিবার সোনা জেতার পরে মনে হচ্ছে ব্রোঞ্জ, রুপোর পরে শুরু হয়ে গেল সিন্ধু সভ্যতার স্বর্ণযুগ। এই ফর্মে খেললে টোকিয়োতেও সিন্ধুর হাতে সোনাই দেখছি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy