অদম্য: রঞ্জি ট্রফিতে এখনও নজির গোয়েলের ৬৩৭ শিকার। ফাইল চিত্র
বিশ্বের কোনও ক্রিকেটারকে জেল থেকে কোনও ডাকাত চিঠি লিখে অভিনন্দন জানাচ্ছে, এ রকম ঘটনা কখনও শুনেছেন? ভারতেই ঘটেছিল এই অদ্ভুত ঘটনাটি।
যে ক্রিকেটারের জীবনে এই বিরল ঘটনাটি ঘটেছিল, তিনি রাজিন্দর গোয়েল। আমার ‘গোয়েল সাব’। রবিবার তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।
গোয়েল যখন রঞ্জি ট্রফিতে ৬০০ উইকেট পান, তখন গ্বালিয়র সংশোধনাগার থেকে বুখা সিংহ যাদব নামে এক কুখ্যাত ডাকাত চিঠি লিখে তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছিল। সেই ডাকাতের প্রিয় বোলার ছিলেন রাজিন্দর গোয়েল।
এই ঘটনাই বুঝিয়ে দেয়, দুরন্ত প্রতিভা নিয়ে ভারতের হয়ে কোনও দিন খেলতে না পারলেও গোয়েলের জনপ্রিয়তা কোন পর্যায়ে ছিল। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ১৫৭ ম্যাচে ৭৫০ উইকেট। যার মধ্যে রঞ্জি ট্রফিতেই তাঁর শিকার ৬৩৭। এখনও যা রেকর্ড।
প্রয়াত এই বাঁ হাতি স্পিনারের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ছিল দাদা-ভাইয়ের। ইডেনে ও হরিয়ানায় ওঁর বিরুদ্ধে অনেক বার খেলেছি। টেস্ট না খেলার প্রসঙ্গ উঠলেই অজাতশত্রু মানুষটি বলতেন, ‘‘আরে সম্বরণ, এ সবই ভাগ্যের খেলা রে!’’ সহজ, সরল মানুষটি কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ করেননি। ১৯৭৪-৭৫ মরসুমে ভারত সফরে আসা ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে দলে ঢুকলেও প্রথম একাদশে জায়গা পাননি। ১৯৭৯-৮০ মরসুমে ভারত সফরে এসেছিল কিম হিউজের অস্ট্রেলিয়া। তাদের বিরুদ্ধে প্রস্তুতি ম্যাচে উত্তরাঞ্চলের হয়ে প্রথম ইনিংসে ছয় ও দ্বিতীয় ইনিংসে তিন উইকেট নিলেন গোয়েল। তার পরেও ভারতীয় দলের দরজা খোলেনি তাঁর জন্য। কিন্তু হতাশ না হয়ে ১৯৫৮-৫৯ থেকে ১৯৮৪-৮৫ মরসুম দাপিয়ে বেরিয়েছেন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে।
ক্রিকেট মহলে অনেকেই বলে থাকেন, বিষাণ সিংহ বেদী স্বমহিমায় থাকার জন্যই রাজিন্দর গোয়েলের টেস্ট খেলা হয়নি। প্রায় একই রকমের বোলিং অ্যাকশন ছিল রাজিন্দর গোয়েলের। কিন্তু বেদীর বৈচিত্র ছিল অনেক বেশি। বেদীর হাতে ফ্লাইট, লুপ বা আর্মার (যে বলটা ভিতরের দিকে ঢুকে আসে) ছিল বড় অস্ত্র। আর গোয়েল লড়েছিলেন নিখুঁত লাইন ও লেংথকে প্রধান অস্ত্র করে।
ভারতীয় দলে গোয়েলের সুযোগ না পাওয়ার যন্ত্রণাটা আমি ভাল ভাবে উপলব্ধি করতে পারি। ক্রিকেটার জীবনে আমি চার বার জাতীয় দলের প্রথম ১৮-তে থেকেও ১৫ জনে ঢুকতে পারিনি। আমাদের সময়ে দলে দু’জন উইকেটরক্ষক নেওয়া হত। ১৯৮১ সালে সৈয়দ কিরমানির সঙ্গে আমার জাতীয় দলে থাকার কথা ছিল। সেখানে প্রথম বার সুযোগ দেওয়া হয় ভরত রেড্ডিকে। তার পরে সুরিন্দর খন্নাকে। নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝতে পারি, কী অসীম যন্ত্রণা বয়ে বেড়াতেন গোয়েল সাব।
একটা ঘটনার কথা বলি। রঞ্জি ট্রফিতে বাংলা বনাম হরিয়ানা ম্যাচ। আমি যখন ব্যাট করতে এলাম, তখন দুই প্রান্ত থেকে বল করছিলেন রাজিন্দর গোয়েল ও সরকার তলোয়ার। আমার সঙ্গী অরূপ ভট্টাচার্যকে বললাম, তুই বাঁ হাতি। আমি একটা সিঙ্গলস নিচ্ছি। গোয়েলকে তুই খেল। কিন্তু গোয়েল আমাকে পরের ৫৯ বলে একটা রানও নিতে দেননি। আমি সামনে পা বাড়িয়ে রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে ওঁকে দু’ঘণ্টা সামলানোর পরে ৬০তম বলে খুব কষ্ট করে একটা সুইপ মেরে সিঙ্গলস নিয়ে প্রান্ত বদল করেছিলাম। লাইন ও লেংথে তিনি এতটা নিখুঁত ছিলেন যে, ড্রাইভ মারাই যেত না।
১৯৭৭ সালে মাদ্রাজে (বর্তমানে চেন্নাই) বসেছিল জাতীয় দলের শিবির। সেখানে বাংলা থেকে দিলীপ দোশী, বরুণ বর্মনের সঙ্গে আমিও ছিলাম। ছিলেন গোয়েলও। সেবারই প্রথম ভারতীয় ক্রিকেটের অনুশীলনে ফিজিক্যাল ট্রেনিং শুরু হয়। এটা রাজিন্দর গোয়েলের অপছন্দের বিষয় ছিল। প্রথম দিনেই উনি পড়ে গেলেন মাটিতে। তার পরে তিন দিন অনুশীলনে যাননি। কিন্তু বিকেলে ঠিক নেটে বল করতে আসতেন। আর ওই তিন দিন আমাকে দেখলেই তিনি রসিকতার সঙ্গে বলতেন, ‘‘সম্বরণ, আজ কি কেউ মাটিতে পড়েছে?’’
এখন ১০-১২ বার প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে পাঁচ উইকেট পেলেই সে বড় বোলার হয়ে যায়। গোয়েল এই কাজটাই করেছেন ৫৯ বার! অবসরের পরে কলকাতায় ক্লাব ক্রিকেট খেলতে এসেছিলেন মোহনবাগানের হয়ে। সেখানেও সেই একই রকমের নিষ্ঠা দেখেছি। গোয়েল সাব যে ছিলেন ক্রিকেটের সাধক!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy