Advertisement
E-Paper

প্যারিস অলিম্পিক্সে বিস্ময় শটে বড় অঘটন লক্ষ্যের, সামনে প্রণয়, শেষ ষোলোয় সিন্ধু

মনু ভাকের ও সরবজ্যোৎ সিংহের পরে কোনও ভারতীয়কে নিয়ে সব চেয়ে বেশি আলোড়ন দেখা গেল বুধবার। পোর্ত দে লা শ্যাপেল এরিনায়, যেখানে ব্যাডমিন্টন হচ্ছে।

প্যারিস অলিম্পিক্সে ব্যাডমিন্টনে মন মাতাচ্ছেন লক্ষ্য সেন।

প্যারিস অলিম্পিক্সে ব্যাডমিন্টনে মন মাতাচ্ছেন লক্ষ্য সেন। ছবি: পিটিআই।

সুমিত ঘোষ

শেষ আপডেট: ০১ অগস্ট ২০২৪ ০৮:৩৪
Share
Save

প্যারিস অলিম্পিক্সে শুটিং যদি ভারতীয় দলের সচিন তেন্ডুলকর হয়, তা হলে ব্যাডমিন্টন নিশ্চয়ই রাহুল দ্রাবিড়। সব চেয়ে বেশি আস্থা রাখা যায় যে, এরা চাপের মুখে ডোবাবে না।

মনু ভাকের ও সরবজ্যোৎ সিংহের পরে কোনও ভারতীয়কে নিয়ে সব চেয়ে বেশি আলোড়ন দেখা গেল বুধবার। পোর্ত দে লা শ্যাপেল এরিনায়, যেখানে ব্যাডমিন্টন হচ্ছে। লক্ষ্য সেন হারিয়ে দিলেন অলিম্পিক্সে তিন নম্বর বাছাই জোনাথন ক্রিস্টিকে। যাঁর বিরুদ্ধে খেলতে হবে শুনে অনেকে বলে ওঠে, ওরে বাবা জোনাথন ক্রিস্টি!

এ বারের অল ইংল্যান্ড ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়নকে হারালেন লক্ষ্য। শুধু তাই নয়, শেষ ষোলোয় লড়াই এ বার স্বদেশীয় এইচ এস প্রণয়ের বিরুদ্ধে, যিনি এ দিন হারালেন ভিয়েতনামের ডুক ফ্যাট লে-কে। ম্যাচের ফল ভারতীয় তারকার পক্ষে ১৬-২১, ২১-১১, ২১-১২। ম্যাচ জিতে প্রণয় বলে যান, ‘‘কয়েকটা ভুলের জন্য প্রথম গেম হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল। পরের দুটো গেমে মাথা ঠান্ডা রেখে প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করেছি। বিশেষ জোর দিয়েছিলাম নেট গেমের উপরে। ডুক বারবার করে লম্বা র‌্যালির দিকে যেতে চাইছিল। আমিও পাল্টা ওকে নেটের কাছে নিয়ে এসে ওর ছন্দটা নষ্ট করার চেষ্টা করছিলাম। সেই লক্ষ্যে আমি সফল হয়েছি।’’ যোগ করেন, ‘‘এই ছন্দটাই ধরে রাখতে হবে।’’

কিন্তু লক্ষ্য দেখিয়ে দিলেন, ক্রিকেটের দেশে ব্যাডমিন্টন এমন জোয়ার এনে দিয়েছে যে, তাঁদের আর বুক কাঁপে না। সামনে যে কোনও প্রতিপক্ষই আসুক না কেন। এমনিতেই ‘জায়ান্ট কিলার’ হিসেবে সুনাম আছে তাঁর। অতীতে অনেক বড় বড় গাছ উপড়ে ফেলেছেন। বুধবারের পরে সেই তকমায় আরও রং লাগল। একই দিনে পি ভি সিন্ধু জিতেছেন আর বেশি চর্চা হচ্ছে অন্য কাউকে নিয়ে, রোজ রোজ এমন জিনিস দেখা যায় না। বুধবার ছিল সেই ব্যতিক্রমী দিন। স্থানীয় সময় সকালে সাড়ে ন’টায় ছিল সিন্ধুর ম্যাচ। শুটিংয়ে জোড়া পদক পেয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করা মনু ভাকের বলেছেন, তিনি সমাজমাধ্যমে ভুয়ো অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন সিন্ধুর আক্রমণকারীদের শায়েস্তা করবেন বলে। এ দিন এস্টোনিয়ার ক্রিস্টিন কুবাকে ২১-৫, ২১-১০ উড়িয়ে দিয়ে শেষ ষোলোতে পৌঁছে যাওয়া সিন্ধু বলে গেলেন, ‘‘মনুর সাফল্যে আমি ভীষণ খুশি। কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়।’’ জানালেন, ম্যাচ ছিল বলে ফোনে কথা বলে উঠতে পারেননি এখনও। বিশেষ ভাবে সাজিয়ে তুলেছেন হাতের আঙুলের নখগুলিকে। তাতে লেখা ‘প্যারিস অলিম্পিক্স ২০২৪’।

তখনও বোঝা যায়নি, লক্ষ্য এসে সিন্ধুর উপস্থিতিকেও ঢেকে দেবেন! ২১-১৮, ২১-১২ ফলাফল দেখে কে ধরতে পারবে, কী মেঘাচ্ছন্ন আকাশ মাথায় নিয়ে লক্ষ্য শুরু করেছিলেন! ঠিক যেমন গতকাল চড়া রোদের পরে বুধবার সকালে বৃষ্টি হল প্যারিসে। আর হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন প্রতিযোগীরা। না হলে পঁয়ত্রিশ ডিগ্রি গরমে এয়ার কন্ডিশনার ছাড়া গেমস ভিলেজে থাকা নিয়ে চরম বিতর্ক শুরু হয়েছে। সিন্ধু অবশ্য অভিযোগ করার রাস্তায় হাঁটলেন না। বললেন, ‘‘ফ্যান পাচ্ছি। যথেষ্ট। আমার কোনও অভিযোগ নেই।’’ শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, এত বড় তারকা। তাঁর কত ঠাটবাট থাকতে পারে। কিন্তু অলিম্পিক্স ভিলেজে দিব্যি নন-এসি রুমে ঘুমোচ্ছেন। তার জন্য কোনও অভিযোগ, অনুযোগ নেই।

লক্ষ্যের মুখেও কোনও বিরক্তি দেখা গেল না এ নিয়ে। শুরুতে ০-৫ পিছিয়ে পড়েছিলেন তিনি। কিন্তু এই অলিম্পিক্সে যে বারবার একটা শব্দ লিখতে হচ্ছে। ‘প্রত্যাবর্তন’। কে আর লেখার সাহস দেখায়, লক্ষ্যচ্যুত সেন! প্যারিস শেখাচ্ছে, ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করো। এটা ফিরে আসার অলিম্পিক্স। বৃষ্টি থেমে প্যারিসের আকাশে রোদ উঠল। লা শ্যাপেল ইন্ডোরে লক্ষ্যের র‌্যাকেটও ততই ঝলমল করতে থাকল। পিছিয়ে পড়ার পরে দ্রুত রণনীতি পাল্টে আগ্রাসী হয়ে উঠলেন তিনি। লক্ষ্যকে জাগিয়ে তুলল ভারতীয় জনতাও। লা শ্যাপেল প্যারিসের কেন্দ্রস্থল থেকে বেশ খানিকটা দূরে। তবু প্রচুর ভারতীয় উপস্থিত হয়ে গিয়েছিলেন। সিন্ধুর ম্যাচে কয়েক জনকে পাওয়া গেল ইউরোপের বিভিন্ন দেশে থাকেন। কাজকর্ম ফেলে ছুটি বাড়িয়ে নিয়েছেন ভারতের ব্যাডমিন্টন অভিযান দেখবেন বলে। লক্ষ্য পিছিয়ে পড়ার সময়ে তাঁরা চিৎকার করে বারবার উৎসাহ দিয়ে গেলেন। ঘনঘন ‘জিতেগা ভাই জিতেগা, ইন্ডিয়া জিতেগা’ ধ্বনি উঠল। সঙ্গে ‘ভারত মাতা কী জয়’।

সেই টনিকেই কি না কে জানে, অভাবনীয় সব শট খেলতে শুরু করলেন লক্ষ্য। তার মধ্যে একটা কোমরের পিছন দিয়ে হাত ঘুরিয়ে খেলা। সমাজমাধ্যমে যা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। বিরাট কোহলি দুর্ধর্ষ কোনও শট খেলে ভারতকে জেতালে যেমন হইচই পড়ে যায়। অনেকে লিখেছেন, ‘‘ঈশ্বর প্রদত্ত শট। বিশ্বাস করতে পারছি না।’’ কেউ কেউ আরও এগিয়ে গিয়ে দাবি তুলেছেন, ব্যাডমিন্টনের ইতিহাসে অন্যতম সেরা শটের আখ্যা পাওয়া উচিত। টেনিসে রজার ফেডেরার দু’পায়ের ফাঁক দিয়ে মারতেন টুইনার। এটা তেমন কোমরের পিছন দিয়ে হাত ঘুরিয়ে মারা ব্যাকহ্যান্ড। যাঁরা সমাজমাধ্যমে ভিডিয়োয় দেখতে পেলেন না, তাঁদের বোঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করা যাক। লক্ষ্যের ডান হাতে র‌্যাকেট ধরা। জোনাথনের শট পড়ছে তাঁর কোমরের বাঁ দিকের কাছাকাছি। চকিতে র‌্যাকেট ঘুরিয়ে রিটার্ন পাঠালেন লক্ষ্য। অবিশ্বাস্য! কী বলা হবে একে? ব্যাডমিন্টনের রিভার্স শট? নিশ্চয়ই লক্ষ্যের এই বিস্ময়-শটের নামকরণ করার জন্য অনেকে ছুটবে। আপাতত সব চেয়ে বিস্ময়কর হচ্ছে, প্রবল চাপের মধ্যে যে রকম তূরীয় মেজাজে তিনি শটটা খেললেন। যেন আইফেল টাওয়ার দেখতে বেরিয়েছেন। কে বলবে অলিম্পিক্সের মতো বৃহত্তম মঞ্চে কঠিনতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে খেলছেন!

কী করে খেললেন এমন শট? ম্যাচ জেতার আনন্দ মাখা মুখে লক্ষ্য বলে গেলেন, ‘‘রিফ্লেক্সেই খেলেছি মনে হয়।’’ শুরুতে পিছিয়ে পড়েও ফিরে আসা? ‘‘ক্রিস্টির খেলাটা ধরতে ধরতে কয়েকটা পয়েন্ট চলে যায়। তার পর দ্রুত বুঝে যাই, ও কী করতে চাইছে। তার পর ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিই।’’ এমন প্রত্যয় নিয়ে কথাগুলো বললেন যে, মনেই হবে না অতীতে পাঁচ বারের মধ্যে চার বার একই প্রতিপক্ষের
কাছে হেরেছেন।

ইন্দোনেশিয়ার তারকা বেশ আকর্ষণীয় চরিত্র। সমাজকল্যাণমূলক কাজে ব্যস্ত থাকেন। কোভিডের সময় আক্রান্তদের সেবায় ব্যস্ত ছিলেন। কোর্টেও তেমনই দুর্দান্ত সব প্রাপ্তি। কিংবদন্তি লিন ডানকে হারিয়েছেন একাধিক বার। র‌্যাঙ্কিং, অভিজ্ঞতায় সব দিক দিয়ে লক্ষ্যের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন জোনাথন। এমন এক প্রতিপক্ষকে হারিয়ে শেষ ষোলোয় উঠে গেলেন। পদকের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুললেন। আর তাঁর কোচও নিশ্চয়ই হাসছেন। ভারতীয় খেলাধুলোর চিরকালীন হার্টথ্রব তিনি। তিরাশিতে কপিল দেবের ভারতের বিশ্বকাপ জয়। তার আগে আশিতে তাঁর অল ইংল্যান্ড জেতা। গোপীচন্দকে ছেড়ে সিন্ধু এখন যাঁর কাছে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। লক্ষ্য যাঁর ছাত্র এবং অল ইংল্যান্ড চ্যাম্পিয়নকে হারিয়ে বলে গেলেন, ‘‘স্যরের পরামর্শ কাজে লাগিয়ে সফল হচ্ছি।’’

এক-এক সময় মনে হচ্ছে, তিনি প্রকাশ পাড়ুকোন, এ বারের প্যারিস অলিম্পিক্সে ভারতীয় ব্যাডমিন্টনের মেঘনাদ। কোর্টে সিন্ধু, লক্ষ্যরা জিতছেন আর নেপথ্যে তাঁর মস্তিষ্ক। মেঘের আড়াল থেকে তির ছুড়ছেন!

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Paris Olympics 2024 badminton Lakshya Sen PV Sindhu

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}