(বাঁ দিকে) প্রথম গেম জিতেও পদকহীন লক্ষ্য। আত্মসমালোচনার বার্তা কিংবদন্তি প্রকাশের। ছবি: পিটিআই এবং এক্স।
এত আশা জাগিয়েও শূন্য হাতে ফিরছে ব্যাডমিন্টন। পি ভি সিন্ধু এবং সাত্ত্বিক-চিরাগের দৌড় আগেই থেমে গিয়েছিল। ব্রোঞ্জ জিতে মুখরক্ষা করার জন্য টিমটিম করে জ্বলছিলেন শুধু লক্ষ্য সেন। তিনিও পারলেন না। প্রথম গেম জিতে গিয়েও হেরে গেলেন মালয়েশিয়ার লি জি জিয়ার কাছে ২১-১৩, ১৬-২১, ১১-২১। ব্রোঞ্জ লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার দিনে ক্ষুব্ধ দেখাল প্রকাশ পাড়ুকোনকে। ভারতের ব্যাডমিন্টন কিংবদন্তি তির নিক্ষেপ করলেন একই সঙ্গে ফেডারেশন ও খেলোয়াড়দের দিকে। ফেডারেশনের উদ্দেশে বললেন, পরের প্রজন্মের উপরে মনোনিবেশ করো। যে রকম চিন করে। আর খেলোয়াড়দের জন্য তাঁর বার্তা, ‘‘যা চাইছ, সব পাচ্ছ। এ বার দায়বদ্ধতা দেখাও, আরও দায়িত্ববোধ দেখাও।’’
সেমিফাইনালে ডেনমার্কের ভিক্টর অ্যাক্সেলসেনের সঙ্গে এগিয়ে গিয়েও হারেন লক্ষ্য। এ দিনও একই রোগ তাড়া করল। অ্যাক্সেলসেন সোনা জিতলেন। ফাইনালে তুড়ি মেরে জিতলেন তিনি। প্রকাশ বললেন, ‘‘আগে আমরা চতুর্থও হতে পারছিলাম না। এখন হচ্ছি। সে দিক দিয়ে হয়তো এগিয়েছি। কিন্তু আমাদের বেশি করে মনের ট্রেনিং দরকার।’’ যোগ করছেন, ‘‘খেলায় মনোবিদ্যাটাও খুব জরুরি। আমরা একদম ভাবি না এটা নিয়ে। আসলে বিষয়টা খুব একঘেয়ে। অনেকের ভাল লাগবে না। তবু দরকার। বিশেষ করে অলিম্পিক্সে।’’
ভারতীয় ব্যাডমিন্টনে যিনি জোয়ার এনে দিয়েছিলেন ১৯৮০-তে অল ইংল্যান্ড চ্যাম্পিয়ন হয়ে, তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ বা অন্য ইভেন্ট আর অলিম্পিক্সের মধ্যে অনেক তফাত। এত চাপ কোথাও থাকে না। আমি সব সময় বলেছি, অলিম্পিক্সের চাপ অন্যরকম।’’ তাঁর মতে, ‘‘ব্যাডমিন্টনে অনেক সেরা খেলোয়াড় হেরে গিয়েছে। তার কারণ তাদের টেকনিক্যাল ত্রুটি নয়। কারণ তারা চাপ সামলাতে পারেনি। অলিম্পিক্সে আসল হচ্ছে, চাপ সামলানো। তাই আরও বেশি করে মানসিক দাওয়াইয়ের উপরে জোর দিতে হবে।’’ কী ভাবে সেটা সম্ভব? প্রকাশের উত্তর, ‘‘যোগব্যায়াম করো, ধ্যান করো। এবং, আমি বলব বিদেশি মনোবিদ রাখো। এখন আমাদের সঙ্গে অনেক বিদেশি কোচ, বিদেশি ফিজিয়ো রয়েছে। বিদেশি মনোবিদও আনা হোক। দেশি বিশেষজ্ঞদের ছোট করছি না কিন্তু বিদেশি আনাই ভাল।’’ মনু ভাকের এই অলিম্পিক্সে এখন পর্যন্ত ভারতের সেরা মুখ। তাঁর উদাহরণ টেনে প্রকাশ বলেন, ‘‘আমার মনে হয়, মনুকে নিয়ে বেশি হইচই হয়নি শুরুতে। খুব প্রত্যাশার চাপ ছিল না। তাই মনু সফল হয়েছে। যাদের ফেভারিট ধরা হচ্ছে, তারাই পারছে না। এটা নিয়ে ভাবা দরকার।’’
ভারত এখনও পর্যন্ত তিনটি ব্রোঞ্জ পেয়েছে। তাতেই অনেকে উৎসব করছে। অথচ ঘটনা হচ্ছে, পদক তালিকায় দূরবিনেও চোখে পড়ছে না ভারতকে। অলিম্পিক্সের নিয়ম হচ্ছে, সোনা জয়ের ভিত্তিতে পদক তালিকার স্থান নির্ধারণ হয়। যারা যত বেশি সোনা জেতে, তারা তত উপরে থাকে। মোট পদকের সংখ্যা ধার্য হয় না। তার পর আসে রুপো। ভারত সোনা তো দূরের কথা, রুপোও জেতেনি। তাই পদক তালিকায় তাদের খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না। প্রকাশ পাড়ুকোনের কথা শুনে মনে হল তিনি একেবারেই প্রসন্ন নন। বললেন, ‘‘পরের অলিম্পিক্সে যদি ভাল করতে হয়, তা হলে এখন থেকেই তার প্রস্তুতি নিতে হবে।’’ তার পরেই তার তোপ, ‘‘সমস্যা হচ্ছে, ভারতে এক জন তারকা হয়ে গেলেই তাকে নিয়েই শুধু মাতামাতি হয়। কিন্তু মাত্র এক জন খেলোয়াড়কে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকলে কী করে হবে? পরবর্তী তারকা তৈরি করার উপরেও তো জোর দিতে হবে।’’
ক্রিকেটকে উদাহরণ করতে বলেন তিনি। ‘‘ক্রিকেটে এ দল, অনূর্ধ্ব-১৯, অনূর্ধ্ব-১৬ দল রয়েছে। তাই সাপ্লাই লাইনের প্রক্রিয়া রয়েছে। সেটা অলিম্পিক ইভেন্টের জন্যও
ভাবতে হবে।’’
দেশের নামী খেলোয়াড়দের পথ দেখানোর আর্জি জানান ব্যাডমিন্টন কিংবদন্তি। ‘‘সিন্ধু এই কাজটা করেছে ব্যাডমিন্টনে। অন্যদেরও করতে হবে। তা ছাড়া ফেডারেশনও পরের প্রজন্ম তৈরি করা নিয়ে ভাবুক। চিনকে দেখুন। ওদের প্রধান খেলোয়াড় যখন অবসর নেয়, তখন পরের প্রজন্মের চার-পাঁচ জন তৈরি। তাদের ওরা চ্যাম্পিয়ন হতে উৎসাহ দেয়।’’
লক্ষ্যকে নিয়ে কী বলবেন? প্রকাশের জবাব, ‘‘লক্ষ্যকে দুটো দিক নিয়েই ভাবতে হবে। মনের দিকটা এবং খেলার টেকনিক্যাল ত্রুটি সংশোধন করা। হাওয়ার পক্ষে খেলার সময় ঠিক করতে হবে। মালয়েশিয়ার খেলোয়াড়ও সমস্যায় পড়ছিল। কিন্তু দ্রুত মানিয়ে নিল। লক্ষ্যের অনেক কাজ এখনও বাকি।’’ টেনিসে লিয়েন্ডার, মহেশের পরে আর কেউ আসেনি। ব্যাডমিন্টনও কি সেই দিকে যাচ্ছে? সাইনা, সিন্ধুর পরে আর কাউকে তো সে ভাবে উঠে আসতে দেখা যাচ্ছে না। প্রকাশ বললেন, ‘‘টেনিসের মতো অত খারাপ অবস্থা হয়েছে, বলব না। ছেলেদের মধ্যে লক্ষ্য আছে। আরও দু’তিনজন রয়েছে। মেয়েদের ক্ষেত্রে একটা শূন্যতা তৈরি হচ্ছে। তবে আমি কয়েক জন ভাল প্রতিভা দেখেছি। বলছি তো নতুন প্রজন্মকে তৈরি করার উদ্যোগ নিতে হবে।’’
প্যারিসে আসা ইস্তক ভারতের অলিম্পিক্স অভিযানে আশা আর উৎসবের হিড়িক চলছিল। এই প্রথম কেউ বাস্তবের রুক্ষ জমিতে
দাঁড় করালেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy