অভিষেক টেস্টে লর্ডসের মাঠে শতরান ডেভন কনওয়ের। ছবি: টুইটার থেকে
শতরান করলেই গুরুদক্ষিণা দিতে হবে। ডেভন কনওয়ের সঙ্গে এমনই চুক্তি করেছিলেন তাঁর ভারতীয় প্রশিক্ষক শ্রীরাম কৃষ্ণমূর্তি। তবে বেশি দিন সেই দক্ষিণা নিতে পারেননি তিনি। দক্ষিণা নিয়ে বিপদ ঘটেছিল তাঁরই। তাই কনওয়ের শতরান না থামলেও গুরুদক্ষিণা থামাতে বাধ্য হয়েছেন শ্রীরাম।
চুক্তি ছিল কনওয়ে শতরান করলে শ্রীরামকে ওয়েলিংটনের মিসেস হিগিনসের চিনাবাদামের মাখন দিয়ে তৈরি কুকিজ খাওয়াতে হবে। লম্বা অনুশীলন শেষে একদিন কনওয়ে এবং তাঁর প্রশিক্ষক খুঁজে পেয়েছিলেন এই কুকিজ। দু’জনেরই ভাল লেগে গিয়েছিল সেটা। সেই সময়ই দু’জনের চুক্তি হয়, কনওয়ে শতরান করলে এই কুকিজ দিতে হবে শ্রীরামকে। ২০১৯ সাল থেকে সব ধরনের ক্রিকেটে একের পর এক শতরান করতে থাকেন কনওয়ে। কিন্তু বেশিদিন কুকিজ খাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি শ্রীরামের। কারণ কুকিজ খেতে খেতে শরীরটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল তাঁর। বাধ্য হয়ে থামাতে হয় কুকিজ খাওয়া।
ডেভন কনওয়ে, নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটে এই মুহূর্তে সবথেকে আলোচিত নাম। অভিষেক টেস্টে লর্ডসের মাঠে শতরান করে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের রেকর্ড ভেঙে ভারতীয়দের কাছেও পরিচিত তিনি। তবে কনওয়ের উত্থান এক ভারতীয়র হাত ধরেই। শেষ ৪ বছরে উল্কার গতিতে এগিয়েছেন নিউজিল্যান্ডের এই ব্যাটসম্যান।
Now to sit back and watch you play all 3 forms of the game for a good period of time to come Dev.. Well done and much deserved.. life's risk paying off, a risk that could have been too huge, yet you mitigated it due to your wonderful attitude #devonconway pic.twitter.com/6U9ZqRZk0L
— Sriram Krishnamurthy (@sriram219) June 3, 2021
২০১৮-১৯ মরসুমে নিউজিল্যান্ডের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে কনওয়ের গড় ছিল ৮২.৩৭। সুপার স্ম্যাশ টি২০-তে গড় ছিল ৪৫.৩৭। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিউজিল্যান্ডের হয়ে নামার সম্ভাবনা তৈরি হয় তখন থেকেই। ছাত্রের উদ্দেশে শ্রীরাম বলেন, “শতরান তোমাকে পরচিতি দেবে। তবে বড় শতরান করলে সব সময় আলোচনায় থাকবে তুমি।” পরের মরসুমেই সেটা করে দেখালেন কনওয়ে। ৩৫২ বলে অপরাজিত ৩২৭ রান করেন তিনি। আলোচনায় উঠে আসেন কনওয়ে। টেস্ট অভিষেকে লর্ডসে দ্বিশতরানের পর তাঁকে নিয়ে যে আলোচনা চলতেই থাকবে, তা বুঝতেই পারছেন শ্রীরাম।
শ্রীরাম এবং কনওয়ের দেখা যেন হতই। দু’জনের জীবনের কাহিনিই মিলে যায়। চেন্নাইয়ে বয়সভিত্তিক ক্রিকেট খেলে বড় হয়ে ওঠা শ্রীরাম মানবসম্পদ পরামর্শ (হিউম্যান রিসোর্স কনসাল্টিং) নিয়ে পড়াশোনার জন্য পাড়ি দেন ইংল্যান্ডে। তবে ঢেঁকি স্বর্গে গিয়েও ধান ভানে। ইংল্যান্ডে গিয়ে তিনি গবেষণামূলক কাজ করতে শুরু করলেন। কী ভাবে খেলাধুলা, বিশেষত ক্রিকেটের উন্নতিতে 'নলেজ ম্যানেজমেন্ট'-কে কাজে লাগানো সম্ভব। সেখান থেকেই প্রশিক্ষকের দায়িত্বে চলে আসা। তিনি ১৮ মাস ল্যাঙ্কাশায়ার দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অস্ট্রেলিয়াতেও বিভিন্ন দলে প্রশিক্ষণ দেন তিনি। পরে তাঁর স্ত্রী অদিতির কাজের সুবিধার জন্য ২০১৫ সালে নিউজিল্যান্ডে চলে আসেন। পাকাপাকি ভাবে সেখানেই থাকতে শুরু করেন।
জীবনের কাহিনি কিছুটা মিলে যায় গুরু এবং শিষ্যর। দক্ষিণ আফ্রিকার কনওয়ে ক্রিকেট খেলতে চলে যেতেন ইংল্যান্ডে। এর পর নিউজিল্যান্ড পাড়ি দেন তাঁর সঙ্গিনী কিমের জন্য। কিমের কাজের সুযোগ বেশি ছিল ওয়েলিংটনে। সেই জন্যই সেখানে আসা এবং শ্রীরামের সঙ্গে দেখা হওয়া।
কনওয়ের সঙ্গে শ্রীরামের দেখা করিয়ে দিয়েছিলেন ক্রিকেট ওয়েলিংটনের প্রধান রবি কের। অনুশীলন শেষে কনওয়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বাড়ি ফিরেছিলেন শ্রীরাম। বুঝে গিয়েছিলেন এই যোগাযোগ হয়তো চিরকালীন। শ্রীরাম বলেন, “বাড়ি ফিরেই অদিতিকে কনওয়ের কথা বলি। এমন একজন ক্রিকেটারের সঙ্গে পরিচয় করে প্রচণ্ড উত্তেজিত ছিলাম। রবি জানতে চেয়েছিল নিউজিল্যান্ডে এসে পাকাপাকি থাকতে হওয়া নিয়ে কনওয়ের মাথায় কী চলছে।”
তবে কিম না থাকলে হয়তো কনওয়েকে পেতই না নিউজিল্যান্ড। কিমের ভিসার সাহায্যেই নিউজিল্যান্ডে আসতে পেরেছিলেন এই ওপেনার। নিউজিল্যান্ডের হয়ে খেলার সুযোগ পাওয়ার জন্যেও কিমের ভিসাই মূল্যবান হয়ে ওঠে। শ্রীরাম বলেন, “কনওয়ে কতটা ভাল ক্রিকেট খেলছে সেটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল, ততটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল কিম তার কাজের জায়গায় কেমন কাজ করছে।”
দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে অনেক ক্রিকেটারই খেলার জন্য নিউজিল্যান্ডে আসে। এক মরসুম খেলে আবার ফিরে যায় নিজের দেশে। তাই যাচাই করে নেওয়াটাও জরুরি ছিল শ্রীরামদের জন্য। তিনি বলেন, “কনওয়ে শুরু থেকেই অন্যরকম ছিল। ৪ বছর আগে নিউজিল্যান্ড এসে প্রথম থেকেই ওর লক্ষ্য ছিল পাকাপাকি ভাবে এই দেশে থেকে যাওয়া। সেই লক্ষ্য নিয়েই কাজ করে যেত ও আর কিম। বাইরের দেশ থেকে এসে এখানে খেলতে গেলে চুক্তিপত্রে সই করতে হয়। দুই বছর খেলার পর তবেই জাতীয় দলে খেলার জন্য বিবেচনা করা হয় তাদের নাম। পুরোটা শুনে কনওয়ে জানিয়ে দিয়েছিল ও শর্টকাটে কিছু করতে এখানে আসেনি।”
সত্যিই কোনও শর্টকাট নেননি কনওয়ে। ২০১৭ সালের অগস্টে ওয়েলিংটনে আসার পর তাঁকে ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিকেট ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত করে দেন শ্রীরাম। কনওয়ের থাকা, খাওয়া-সহ সব কিছুর দায়িত্ব নেয় এই ক্লাব। শুধু মাঠে রান করেই তাদের দাম দিচ্ছিলেন, তেমনটা নয়। নিজেকে ভাল ক্রিকেটার হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন স্কুলের পড়ুয়াদের সঙ্গে অনুশীলন করতেন কনওয়ে। শ্রীরাম বলেন, “৫-৬ ঘণ্টা ধরে প্রশিক্ষকদের সঙ্গে অনুশীলন করার পর নিজের মতো করেও অনুশীলন করত কনওয়ে। ভাল ক্রিকেটার হয়ে ওঠার জন্য যা যা করা উচিত, সব করছিল ও। তবে তখনও জানত না নিউজিল্যান্ডে ওর ভবিষ্যৎ আদৌ নিশ্চিত কি না।”
কনওয়ের ক্রিকেটীয় দক্ষতা নিয়ে কোনও সন্দেহ ছিল না শ্রীরামের। তিনি বলেন, “দক্ষিণ আফ্রিকায় ওর খেলার ভিডিয়ো দেখতে গিয়েই বুঝেছিলাম যে ওর মধ্যে বড় ক্রিকেটার হয়ে ওঠার গুণ রয়েছে। বাউন্সের বিরুদ্ধে ও ভাল খেলবে বলেই মনে হয়েছিল।” গুরুর কথাকেই সত্যি প্রমাণ করলেন কনওয়ে। প্রথম শ্রেণির খেলায় ১২টি ম্যাচে ৫টি শতরান করেন তিনি। গড় ছিল ১০৩.০৭।
২০১৮ সালে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটে কোনও ওপেনার প্রয়োজন ছিল না। একদিকে টম লাথাম, অন্য দিকে বাঁহাতি জিত রাভাল। এক বার ওয়েলিংটনে খেলা থাকার সময় শ্রীরামের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন রাভাল। সেই সময় উপস্থিত ছিলেন কনওয়ে। কনওয়ে সেদিন অবাক চোখে দেখছিলেন রাভালকে। পাশে দাঁড়িয়ে সেই দিনের ঘটনা দেখেছিলেন শ্রীরাম। তিনি বলেন, “অবাক চোখে রাভালকে দেখছিল কনওয়ে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সুযোগ পেতে তখনও অনেক দিন বাকি তাঁর। অন্য দিকে রাভাল তখন শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে টেস্ট খেলার জন্য ওয়েলিংটনে। কনওয়ের অনেক প্রশংসা করে রাভাল। আর আজ রাভাল হারিয়ে গিয়েছে, কনওয়ে মধ্যমণি হয়ে উঠেছে নিউজিল্যান্ডের।”
২০১৯-২০ মরসুমে আরও কাছাকাছি চলে আসেন শ্রীরাম এবং কনওয়ে। সেই সময় ফায়ারবার্ডসের হয়ে খেলছেন কনওয়ে। সেই দলের ব্যাটিং প্রশিক্ষক হিসেবে যোগ দেন শ্রীরাম। টেস্ট ক্রিকেটের জন্য তৈরি হওয়া কনওয়েকে টি২০ ক্রিকেটে খেলার জন্য তৈরি করতে শুরু করেন তিনি। লক্ষ্য বেঁধে দেন দ্রুত গতিতে রান নয়, পুরো ২০ ওভার খেলতে হবে। সেটাই করতে শুরু করেন কনওয়ে। ৫০ ওভারের ক্রিকেটেও একই কাজ করতেন তিনি। টি২০ ম্যাচে ১১টি ইনিংসে করেন ৫৪৩ রান। একটি শতরান এবং ৫টি অর্ধশতরান আসে তাঁর ব্যাট থেকে। টি২০ ক্রিকেটের জন্যেও তৈরি হয়ে ওঠেন কনওয়ে। ঘরোয়া ক্রিকেটে আলোচনা চলতে থাকে তাঁকে নিয়ে। প্রতি ম্যাচেই রান করতে থাকেন।
শ্রীরাম বলেন, “এক বার ৯৬ রান করে আউট হয়েছিল কনওয়ে। ক্ষমা চেয়েছিল। প্রতিজ্ঞা করেছিল এই ভাবে শতরান ফেলে আসবে না। পরের সপ্তাহেই শতরান করে ও।” কোকাবুরা বলে খেলতে কোনও অসুবিধা হত না কনওয়ের। অনুশীলন শুরু করেন ডিউক বলে। নিজের জন্যই কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করতেন অনুশীলনের জন্য।
নিউজিল্যান্ডের প্রশিক্ষক গ্যারি স্টিডের কানে পৌঁছে যায় কনওয়ের নাম। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে নেটে কনওয়েকে দেখেন স্টিড। শ্রীরাম বুঝে যান আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কনওয়ের খেলা এ বার শুধুই সময়ের অপেক্ষা। শ্রীরামকে স্টিড বলেন, “কিছু নির্দিষ্ট জায়গায় বল পড়লে কনওয়ের সমস্যা হয়। কিন্তু তাতে কী, সেই বলে ও আউট তো হচ্ছে না। সেই বিষয় নিয়ে কথা না বললেও চলবে।”
আন্তর্জাতিক মঞ্চে ইতিমধ্যেই ১৪টি টি২০, ৩টি একদিনের ম্যাচ এবং ৩টি টেস্ট খেলে ফেলেছেন কনওয়ে। টি২০ ম্যাচে ৪৭৩ রান করেছেন তিনি। সর্বোচ্চ অপরাজিত ৯৯ রান। গড় ৫৯.১২। রয়েছে ৪টি অর্ধশতরান। অপরাজিত ছিলেন ৩টি ম্যাচে। একদিনের ক্রিকেটে ইতিমধ্যেই শতরান করে ফেলেছেন তিনি। ৩ ম্যাচে তাঁর রান ২২৫, গড় ৭৫। শুধু ঘরোয়া ক্রিকেট নয়, আন্তর্জাতিক মঞ্চেও যে তিনি সফল হওয়ার জন্যই এসেছেন সেটাই যেন বলতে শুরু করেছে তাঁর ব্যাট।
সাফল্য কিন্তু মাটি থেকে তাঁর পা তুলে দেয়নি। শ্রীরাম বলেন, “বদলে যায়নি কনওয়ে। আজও কিছু লিখে পাঠালে সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করে। আর যদি না পারে, তা হলে বুঝব ও ব্যাট করছিল বলে উত্তর দিতে পারেনি। মানুষ হিসেবেও এতটাই ভাল ও। দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গের সেন্ট জনসের ছাত্রদের কাছেও শুনেছিলাম কতটা ভাল মানুষ ও।”
প্রায় ৩০ বছর বয়সে পৌঁছে শুরু হল কনওয়ের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কেরিয়ার। শ্রীরাম জানেন আরও বেশ কিছু বছর তাঁর ছাত্র খেলবেন। ক্রিকেট জীবনের সব চেয়ে কঠিন সময় যে ভাবে তিনি পাশে ছিলেন, তাতে প্রশিক্ষক নয়, অনেক বেশি বন্ধু হয়ে উঠেছেন তাঁরা। শ্রীরাম চাইবেন তাঁর বন্ধুর মেসেজের উত্তর যাতে দেরি করেই আসে। ব্যাট করুক কনওয়ে। আর দেখা হলে কী উপহার দেবেন বন্ধুকে? শ্রীরাম বলেন, “ওয়েলিংটনের মিসেস হিগিনসের চিনাবাদামের মাখন দিয়ে তৈরি কুকিজ।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy