প্রতিজ্ঞ: বাইশ গজে ধোনি এখনও বোলারদের কাছে দুঃস্বপ্ন। ছবি: রয়টার্স
ক্রিকেটার মহেন্দ্র সিংহ ধোনির প্রথম বিদেশ অভিযান ২০০৪ সালে, কেনিয়া এবং জিম্বাবোয়ে। ভারতীয় ‘এ’ দলের সেই সফরে তাঁর রুমমেট ছিলেন আকাশ চোপড়া।
দিল্লির ওপেনার তত দিনে ভারতের হয়ে খেলে ফেলেছেন। আর ধোনি পূর্বাঞ্চলের অনামী এক ছোট শহর থেকে সদ্য উঠে আসা লম্বা চুলের এক যুবক। রাঁচীতে বন্ধুর দোকানে বসে যিনি কয়েক দিন আগেই শুনেছেন, বিশ্বকাপের দলে সমবয়সি যুবরাজ সিংহ, মহম্মদ কাইফেরা আছেন। তাঁর জায়গা হয়নি।
ভদ্র এবং বিনয়ী আকাশ তাঁর অনুজ রুমমেটকে যথাসম্ভব স্বস্তিতে রাখতে চান। তাই প্রথমেই জেনে নিতে চাইলেন, তুমি রাতে কখন ঘুমোতে যাও আর সকালেই বা কখন ঘুম থেকে ওঠো? ধোনি যে-উত্তর দিয়েছিলেন, আজও ভোলেননি আকাশ— ‘‘তুমি যখনই লাইট নিভিয়ে দেবে, আমি ঘুমিয়ে পড়ব। সকালে যখনই জানলার পর্দা টেনে খুলে দেবে, আমি উঠে পড়ব।’’
ফুরফুরে: ওয়ান ডে সিরিজও চলে এল হাতের মুঠোয়। শুক্রবার মেলবোর্নে ম্যাচের পরে সিরাজ, জাডেজা, কুলদীপদের নিয়ে গল্পে মেতে উঠলেন তৃপ্ত অধিনায়ক বিরাট কোহালি। ছবি: গেটি ইমেজেস।
সৌরভের ভারতের হয়ে এক সময়ে অস্ট্রেলিয়ায় লড়াকু ইনিংস খেলা ওপেনার যখনই ফিনিশার ধোনিকে দেখেন, চোখের সামনে ভেসে ওঠে কেনিয়ার হোটেলের ঘরে বসে থাকা লম্বা চুলের সতীর্থের মুখ। অবিচল, ধীরস্থির, ভাবলেশহীন মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। ঘুমোনোর সময়ে চোখে আলো পড়া নিয়ে যেমন প্রতিক্রিয়াহীন, তেমনই নির্বিকার ব্যাট হাতে চাপের মুখে ম্যাচ জেতানোর চ্যালেঞ্জের মুখে!
মেলবোর্নে ফের ফিনিশার ধোনির জয়ধ্বনি টিভি-তে দেখতে দেখতে মনে হল, ক্রিকেটার ধোনি নয়। চরিত্র ধোনির জয় দেখছি। যিনি টেরিটোরিয়াল আর্মিতে যোগ দিয়ে ক্ষান্ত থাকতে চান না, সেনাবাহিনীর পুরোদস্তুর ট্রেনিংয়ে নেমে পড়ে সকলকে চমকে দেন। যিনি কলকাতায় কম্যান্ডোদের ডেরায় গিয়ে নিশানাবাজের মতো গুলি ছুড়ে শার্প শুটারদের চোখ ছানাবড়া করে দেন। যাঁর মোটরবাইকের গতি দেখে জন আব্রাহাম পর্যন্ত বলে উঠবেন, ‘ধুম ধুম ধোনি’! যাঁর জীবনের স্বপ্ন ছক্কা মারা নয়, যুদ্ধবিমান চালাতে শেখা!
যাঁর চাকরিজীবন শুরু খড়্গপুর স্টেশনে টিকিট চেকার হিসেবে। মানুষের ঠেলা খেতে খেতে, ক্লাস থ্রি রেলকর্মীর কাজ করতে করতে যিনি হয়ে উঠলেন ভারতীয় ক্রিকেটের ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট!
যিনি গীতার সেই স্থিতধী পুরুষ। অথবা রাডইয়ার্ড কিপলিংয়ের ‘ইফ’ কবিতার অভাবনীয় বাস্তব রূপ— ‘ইফ ইউ ক্যান ড্রিম অ্যান্ড নট মেক ড্রিমস ইয়োর মাস্টার/ইফ ইউ ক্যান থিঙ্ক অ্যান্ড নট মেক থটস ইয়োর এইম/ইফ ইউ ক্যান মিট উইথ ট্রায়াম্ফ অ্যান্ড ডিজাস্টার/অ্যান্ড ট্রিট দোজ টু ইমপস্টার্স জাস্ট দ্য সেম /ইফ ইউ ক্যান ওয়েট অ্যান্ড নট বি টায়ার্ড বাই ওয়েটিং(যদি স্বপ্ন দেখতে পারো স্বপ্নকে তোমার শাসক না হতে দিয়ে/যদি ভাবতে পারো ভাবনাকে নিজের লক্ষ্য না করে/যদি সাফল্য এবং ব্যর্থতার মুখোমুখি হয়ে থেকে যেতে পারো একই রকম/যদি অপেক্ষা করতে জানো কিন্তু অপেক্ষা তোমাকে ক্লান্ত না করে দেয়)। কিপলিংয়ের কবিতার শেষ দুই লাইন... তবে পৃথিবী তোমার হবে। তার চেয়েও বেশি করে তুমি হয়ে উঠবে সেই আদর্শ পুরুষ!
ধোনি যেন সেই আদর্শ পুরুষ। ছক্কা মেরে বিশ্বকাপ ফাইনাল জিতিয়েও যিনি নির্বিকার ভঙ্গিতে চলে যেতে পারেন মঞ্চের আড়ালে। আবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালে হেরেও তাঁর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে না। যিনি হেলায় বিশ্বের সেরা বোলারদের উড়িয়ে দিতেন গ্যালারিতে, তিনি এখন বড় স্ট্রোক মারতে গিয়ে হাঁসফাঁস করছেন। এক দিনের ক্রিকেটে যিনি ছিলেন খুচরো রান নেওয়ার রাজা, তিনি এখন এত ‘ডট বল’ (যে বলে কোনও রান হয় না) খেলেন যে, টিভি-র সামনে বসা ভারতীয় ক্রিকেট ভক্তদের পেসমেকারের খোঁজ করতে হয়। তবু এখনও চাপের মুখে সেই একই রকম নির্বিকার তিনি। জেফ থমসন এর মধ্যে বলছিলেন, ‘‘ধোনির বয়স ৩৭ হয়ে যাওয়ার জন্য ওকে বসানো যাবে না। ওর রানিং বিটুইন দ্য উইকেটস এখনও সব চেয়ে ভাল।’’ মেলবোর্ন দেখে নিল, ফিনিশার হিসেবে তাঁর ম্যাচ জেতানোর ক্ষমতার ক্ষয় হয়েছে, কিন্তু এখনও ফসিল হয়ে যায়নি। ভারতীয় দলের হেড কোচ রবি শাস্ত্রী বলছিলেন, ‘‘অস্ট্রেলিয়ায় ধোনির ইনিংসগুলো শুধু রান দিয়ে বিচার করলে চলবে না। কী রকম চাপের মধ্যে খেলছিল, সেটাও মাথায় রাখা দরকার। চাপের মুখে এত ভাল পারফর্মার পাওয়া যাবে না।’’
মেলবোর্নে শুক্রবারের ওয়ান ডে চলাকালীন টিভি-তে একটা হিসেব দেখানো হচ্ছিল। এক দিনের ক্রিকেটে সফল ভাবে রান তাড়া করায় সব চেয়ে ভাল গড় কাদের। সবার উপরে ধোনি। সফল ভাবে রান তাড়া করে জেতা ৭৩ ম্যাচে তাঁর ব্যাটিং গড় ১০৩.০৭। ‘চেজমাস্টার’ যাঁকে বলা হচ্ছে, সেই বিরাট কোহালি রয়েছেন দু’নম্বরে। কোহালির গড় ৯৭.৯৮। তিন নম্বরে অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন ওয়ান ডে স্পেশ্যালিস্ট মাইকেল বিভান।
এক-এক সময় মনে হয়, ফিনিশার ধোনির তুলনা ক্রিকেট পৃথিবীতে নেই। বরং তাঁর মধ্যে বাস্কেটবল কিংবদন্তি মাইকেল জর্ডানের ছায়া। শিকাগো বুলসের এমন অনেক রুদ্ধশ্বাস ম্যাচ পাওয়া যাবে, যেখানে ৩০ সেকেন্ড বাকি থাকতেও স্কোর সমান-সমান। ঠিক সেই সময়েই শুরু হত জর্ডানের ভেল্কি। এক জন, দু’জন, তিন জনকে পাশ কাটিয়ে বাস্কেটের নীচে পৌঁছে যেতেন তিনি। তার পরে বিখ্যাত সেই দৃশ্য। শূন্যে ভাসমান জর্ডান বাস্কেট করে দিয়ে চলে যাচ্ছেন।
প্রতিপক্ষ জানে, তিনি এ ভাবেই শেষ মুহূর্তে স্বপ্নভঙ্গ করে দিয়ে যাবেন। তবু আটকানোর ক্ষমতা নেই। প্রলয় ধেয়ে আসছে জেনেও মহাশক্তির সামনে শক্তিহীন। ধোনির ক্ষেত্রেও তা-ই। অস্ট্রেলিয়া জানত, এ ভাবেই তিনি স্লগ ওভার পর্যন্ত খেলা নিয়ে যাবেন। তার পরে একটা ছয় বা চার মেরে ম্যাচ ছিনিয়ে নিয়ে চলে যাবেন। মাত্র দু’দিন আগে অ্যাডিলেডেই তো একই জিনিস ঘটেছে। তবু অ্যারন ফিঞ্চরা কোনও কুইনাইন বার করতে পারেননি।
বিশ্বকাপের রাস্তায় ধোনিকে নিয়ে দু’টো প্রশ্ন বারবার উঠবে। এক) ব্যাটসম্যান ধোনি কি আগের দক্ষতা হারিয়েছেন? দুই) ধোনি কি এখনও ম্যাচ জেতাতে পারেন? চমকপ্রদ হচ্ছে, মেলবোর্নের পরে দু’টো প্রশ্নের উত্তরই ‘হ্যাঁ’! সাঁইত্রিশের ধোনি ফিনিশারের পাশাপাশি হয়তো এক ধাঁধারও নাম!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy