Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Cricket

‘কোলে সরফরাজের ছেলে, ওই একটা ছবিই ধোনিকে পাকিস্তানে জনপ্রিয় করে তুলেছিল’

কেরিয়ারের গোড়াতেই পাকিস্তানের নজর কেড়ে নিয়েছিলেন মাহি। লম্বা চুলের ধোনির প্রশংসায় মেতে উঠেছিলেন প্রাক্তন পাক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশারফও।

এই ছবিই ভেঙে দেয় সীমান্তের বেড়াজাল। জিতে নেয় পাক মুলুকের হৃদয়। ছবি—টুইটার।

এই ছবিই ভেঙে দেয় সীমান্তের বেড়াজাল। জিতে নেয় পাক মুলুকের হৃদয়। ছবি—টুইটার।

কৃশানু মজুমদার
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ অগস্ট ২০২০ ১৪:২৪
Share: Save:

ফুটফুটে এক শিশুকে কোলে নিয়ে মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। চোখ জুড়ানো সেই ছবি মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল নেট দুনিয়ায়। বছর তিনেক আগের সেই ছবি ওয়াঘার ওপারে ‘রাঁচীর রাজপুত্রের’ জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে দিয়েছিল বেশ কয়েক গুণ।

ধোনির অবসর নিয়ে গোটা দেশ যখন বিস্মিত, অদ্ভুত একটা ঘোরের মধ্যে, ঠিক সেই সময়ে পাক-মুলুক থেকে ধোনির জন্য শ্রদ্ধা-ভালবাসা উজাড় করে দিলেন ইমরান খানের দেশের প্রাক্তন ক্রিকেটার বাসিত আলি। আনন্দবাজার ডিজিটালকে বললেন, “একটা ছবি ধোনিকে অসম্ভব জনপ্রিয় করে তুলেছিল পাকিস্তানে। ২০১৭ সালে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সময়ে আমাদের ক্যাপ্টেন সরফরাজ আহমেদের ছেলেকে নিয়ে একটা ছবি তুলেছিল ধোনি। তার পর থেকেই আমার দেশের মানুষ ধোনিকে আপন করে নেয়। ওকে দেখে আমাদের মনে হত খুব কাছের এক জন। ধোনির প্রতি ভালবাসা বেড়ে যায় সবার।”

ভারত-পাক ম্যাচ মানেই কি শুধু টেনশনের চোরা স্রোত, কথার লড়াই, প্রতিপক্ষকে বুঝে নেওয়া, বদলার শপথ? তা বোধহয় নয়। এর বাইরেও রয়েছে আরও একটা পৃথিবী। সেই পৃথিবীই বুঝিয়ে দেয় ক্রিকেট ‘জেন্টলম্যানস গেম’। সে বারের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল ভারত-পাকিস্তান। সেই হাই ভোল্টেজ ফাইনালের আগে টিম হোটেলে ধোনি কোলে তুলে নেন পাক অধিনায়ক সরফরাজ আহমেদের ছেলে আবদুল্লাকে। ওই একটা ছবি দিয়েই ধোন‌ি যেন ভেঙে দেন সীমান্তের বেড়াজাল। বিদায়বেলায় তাই সীমান্তের ওপার থেকে ‘ক্যাপ্টেন কুল’-এর জন্য বর্ষিত হচ্ছে ভালবাসা-আবেগের স্রোত। শোয়েব আখতার, সাকলিন মুস্তাক, ইনজামাম উল হকের মতো তারকার মুখে ধোনির জন্য ‘জয়-ধ্বনি’।

আরও পড়ুন: ‘ধোনিই ভারতের সর্বকালের সেরা অধিনায়ক’

কেরিয়ারের গোড়াতেই পাকিস্তানের নজর কেড়ে নিয়েছিলেন মাহি। লম্বা চুলের ধোনির প্রশংসায় মেতে উঠেছিলেন প্রাক্তন পাক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশারফও। স্মৃতির সরণি ধরে হেঁটে বাসিত বলছেন, ‘‘সৌরভের নেতৃত্ব ভারত যখন পাকিস্তান সফরে এসেছিল, তখন ধোনির খেলা প্রথম দেখি। তবে আমি আরও আগে ধোনির খেলার কথা শুনেছিলাম আমার বন্ধু আমির বশিরের কাছ থেকে। বশিরই আমাকে প্রথমে ধোনির কথা বলেছিল। পাকিস্তানের হয়ে সিঙ্গাপুরে সুপার সিক্স খেলতে গিয়েছিল বশির। ধোনিও সিঙ্গাপুরে খেলতে গিয়েছিল। ধোনিকে সিঙ্গাপুরে খেলতে দেখার পরে আমির আমাকে বলেছিল, ভারতের একটা লম্বা চুলের ছেলে দারুণ ছক্কা হাঁকাতে পারে। ওর নাম মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। এক দিন ও সুপারস্টার হবে।”

ধোনির বিখ্যাত হেলিকপ্টার শট।

ভারতের পাকিস্তান সফরে ধোনিকে দেখার পরে বাসিত আলিরও একই উপলব্ধি হয়েছিল। তিনি বলছিলেন, ‘‘ধোনির কেরিয়ার তখন শুরুর দিকে। সেই সময়তেই বোঝা গিয়েছিল ধোনি এক দিন বিশ্ব কাঁপাবে।’’ ঠিক সেটাই ঘটল। সাধারণ প্লেয়ার থেকে দেশের অন্যতম সফল অধিনায়ক হন তিনি। অধিনায়ক ধোনিকে দেখে মিডাস রাজার কথা মনে পড়াই স্বাভাবিক। যা ধরেছেন, তাতেই সোনা ফলিয়েছেন। নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর পরেও তিনিই ছিলেন দলের মস্তিষ্ক। উইকেটের পিছনে ধোনি রয়েছেন বলে নিশ্চিন্ত থাকতেন বর্তমান অধিনায়ক বিরাট কোহালিও। প্রাক্তন পাক ব্যাটসম্যান বলছেন, ‘‘উইকেটের সঙ্গে লাগোয়া মাইক্রোফোনের মাধ্যমে টুকরো টুকরো শব্দ ভেসে আসত। তাতেই বুঝতে পারতাম বোলারকে লাইন-লেন্থ বলে দিচ্ছে ধোনি। বোলারের জন্য ফিল্ডার সাজিয়ে দিচ্ছে। তার ফলে নিশ্চিন্ত থাকতে পারত বিরাটও।’’

শুধু তো উইকেটের পিছনে দাঁড়ানো নয়, ব্যাট হাতেও তো বহু বার ঝড় তুলেছেন ধোনি। পাকিস্তানের বিরুদ্ধেই তো তুফান তোলা সেঞ্চুরি করে নজর কেড়ে নিয়েছিলেন বিশাখাপত্তনমে। সেই ম্যাচে ব্যাটিং অর্ডারে তাঁকে উপরের দিকে তুলে আনা হয়েছিল। বাসিত বলছেন, “যারা উইকেট কিপিংয়ের পাশাপাশি ব্যাটিংও ভাল করতে পারে, তাদের অলরাউন্ডার বলা হয়। ধোনি সে রকমই এক জন অলরাউন্ডার। বিশ্ব ক্রিকেটে ধোনির সঙ্গে এক বন্ধনীতে থাকতে পারে কেবল অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। এ ছাড়া কাউকেই তো আমি দেখছি না।’’

ছোট শহর থেকে উঠে এসেছিলেন ধোনি। সামনে সচিন-সৌরভ-দ্রাবিড়ের মতো মহাতারকাদের দেখেও ঘাবড়ে যাননি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেই হয়ে উঠেছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটের মহীরুহ। বাসিত বলছেন, “মেহনত, পরিশ্রমের জোরেই ধোনি ওই উচ্চতায় পৌঁছেছে। ছোট শহর থেকে উঠে আসার জন্যই ওর ভিতরে তাগিদ ছিল। কিছু করে দেখানোর জেদ ছিল।’’

দলের মস্তিষ্ক আসলে ধোনিই।

সেই জেদ এমএসডি-কে ভারতীয় ক্রিকেটের চিরকালের ফ্রেমে জায়গা করে দিয়েছে। তা তিনি যতই বলুন, আমি তো অল্প কয়েক মুহূর্তের ‘কবি’। আগামী দিনে তাঁর থেকেও বড় কোনও তারকা হয়তো আসবেন। কিন্তু অতীতেও কি তাঁর মতো ‘মেগাতারকা’ উইকেট কিপারের জন্ম হয়েছে এই উপমহাদেশে? বাসিত বলছেন, ‘‘সহজাত উইকেট কিপার বলতে যা বোঝায়, ধোনি সে রকমই এক জন। কোনও ম্যাচে একগাদা ক্যাচ ফেলতে, স্টাম্পিং মিস করতে দেখেছেন ধোনিকে? ওকে ভারতের সেরা উইকেট কিপার বললেও কোনও ভুল হবে না। পাকিস্তানেও ওর মতো উইকেট কিপার আসেনি। পাকিস্তানে জন্মালেও ধোনি সুপারস্টারই হত। হাসতে হাসতে পাকিস্তানের প্রথম একাদশে জায়গা করে নিত।’’

‘নো লুক’ রান আউট, বিদ্যুৎগতিতে স্টাম্পিং উইকেট কিপার ধোনিকে অন্য এক উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিল। ‘ফিনিশার’ ধোনি বিশ্বক্রিকেটে সম্ভ্রম আদায় করে নিয়েছিল। যত কঠিন চ্যালেঞ্জই হোক না কেন, ক্রিজে ধোনি থাকা মানেই সব সময়ে শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক থাকা। কখনও মনে হবে না ভেন্টিলেশনে ঢুকে গেল সিস্টেম। খেলাকে দীর্ঘায়িত করতেন ধোনি। জেতার আশা টেনে নিয়ে যেতেন শেষ বল পর্যন্ত। তার পরেই তাঁর ব্যাট ম্যাজিক দেখাতো। কী ভাবে স্নায়ু শান্ত রাখতেন তিনি? নিজের ক্রিকেট অভিজ্ঞতা থেকে বাসিত বলছেন, “আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আসার আগে ধোনি টেপ বলে প্রচুর ম্যাচ খেলেছে। আর সেই সব খেলাই ওকে আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে। কঠিন পরিস্থিতিতে ও ভেঙে পড়ত না। শেষ ওভারে ১৬ রান দরকার হলেও ধোনি বিশ্বাস রাখত, ম্যাচ ও ঠিক বের করে নেবে। আর কঠিন পরিস্থিতি থেকে বহু ম্যাচ বের করে ধোনি তো দেখিয়ে দিয়েছে ও সত্যিকারের ফিনিশার।’’

আরও পড়ুন: শাস্ত্রীয় মতে এভারেস্টে মাহি, সাদা বলের রাজা

সেই ‘ফিনিশার’-এরই তো রথের চাকা বসে গেল গত বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে। মোক্ষম সময়ে রান আউট হয়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল গোটা দেশের হৃদস্পন্দনও। ৭২ বলে ৫০ রান ফিনিশার ধোনির সঙ্গে মোটেও মানানসই নয়। বাসিত মানেন না। প্রতিবাদ করে বলেন, ‘‘নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে সেমিফাইনালে রান আউট না হলে ধোনি ম্যাচ ঠিকই বের করে দিত। ও আগেই ক্যালকুলেট করে ফেলেছিল। জাদেজা যখন ছিল, তখন ধোনি ওকে স্ট্রাইক দিচ্ছিল। কারণ জাদেজা মারছিল। জাদেজা চলে যাওয়ার পরে ধোনি স্ট্রোক খেলতে শুরু করে। ওর দুর্ভাগ্য রান আউট হয়ে গেল। না হলে ম্যাচটা জেতাতই।’’

ঘটনাক্রমে ম্যাঞ্চেস্টারের সেই হৃদয়বিদারক ম্যাচটা হয়ে থাকল ধোনির শেষ ম্যাচ। খেলার মাঠ এক দিন সবাইকেই ছাড়তে হয়। তাই বলে এ রকম অচম্বিতে। সেন্ড অফ পেলেন না, থাকল না ফেয়ারওয়েল ম্যাচ। সবাইকে অবাক করে দিয়ে জানিয়ে দিলেন, তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে ব্যাট-প্যাড খুলে রাখছেন। বাসিত বলছেন, ‘‘ধোনির তুলনা ধোনি নিজেই।’’

এ ছাড়া আর কী-ই বা বলা যায়!

অন্য বিষয়গুলি:

MS Dhoni Basit Ali
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy