সুনীল গাওস্করের সঙ্গে মিলিন্দ রেগের বন্ধুত্ব ছোটবেলা থেকেই।
সৌভাগ্য ছাড়া আর কী!
জন্ম ১৯৪৯ সালের ১০ জুলাই। শুক্রবার ৭১ পূর্ণ করলেন সুনীল গাওস্কর। প্রিয় বন্ধুর জন্মদিনে নিজের ভাগ্যকেই ধন্যবাদ দিচ্ছেন মিলিন্দ রেগে।
দু’জনের জন্মদিনের মধ্যে ফারাক মাত্র কয়েক মাসের। ছোটবেলায় ছিলেন প্রতিবেশী। যাকে বলে ‘নেক্সট ডোর নেবার’। একই স্কুলে ভর্তি হওয়া। একসঙ্গে ক্রিকেট খেলা, বেড়ে ওঠা। যোগাযোগ কখনও ক্ষীণ হয়নি। বন্ধন থেকে গিয়েছে অটুট। দু’জনে বন্ধু থেকে গিয়েছেন, সারা জীবনের জন্যই। আর এই কারণে নিজের কপাল ভাল বলে মনে করেন প্রাক্তন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটার।
আনন্দবাজার ডিজিটালকে মিলিন্দ রেগে সোজাসুজি বললেন, “আমি সৌভাগ্যবান যে একই সময়ে জন্মেছি। সুনীলের পাঁচ মাস আগে জন্ম হয়েছিল আমার। সৌভাগ্যবান যে, একই এলাকায় থাকতাম। দুই পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক ছিল। আমাদের ওখানে সব পরিবারই ছিল একে অন্যের বন্ধু। সুনীলের মা এক দিন আমাদের বাড়িতে এসে বলেছিল যে, আমরা দু’জন একই স্কুলে যাব। আমাদের দুই পরিবার ক্রমশ একটা পরিবার হয়ে উঠেছিল। এটা কপালেই ছিল যে আমরা সেরা বন্ধু হয়ে উঠব। আর আমরা বাকি জীবনও বন্ধু থেকেছি। যার মেয়াদ হয়ে গেল ৭১ বছর।”
আরও পড়ুন: শক্তি বাড়লেও ছন্দ হারানোর আশঙ্কায় শামি
সুনীল গাওস্করের নানা ভূমিকা পরিচিত ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে। সেই ১৯৭১ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজে আবির্ভাবেই সাড়া ফেলে দিয়ে শুরু। ধীরে ধীরে বিশ্বের সেরা ওপেনারদের তালিকায় ঢুকে পড়া। ১৯৮৫ সালে অধিনায়ক হিসেবে অস্ট্রেলিয়ায় বেনসন অ্যান্ড হেজেস সিরিজ জয়। ১৯৮৭ সালে ক্রিকেটপ্রেমীদের চোখের জলে ভাসিয়ে অবসর। তার পর ধারাভাষ্যের জগতে ঢুকে পড়া। লেখালেখি আগেই শুরু হয়েছিল। সেটাতে আরও মন দেওয়া। এবং প্রতি নিঃশ্বাসে ক্রিকেট নিয়েই বাঁচা।
ডিন জোন্স, অ্যালান বর্ডার ও গাওস্করের সঙ্গে আড্ডার মেজাজে মিলিন্দ রেগে।
কিন্তু এই গাওস্করকে তো সারা দুনিয়া চেনে। ব্যাটসম্যান, ধারাভাষ্যকার হিসেবে গাওস্কর কেমন, তা অজানা নয় কারও। অজানা অন্য দিক। বন্ধু হিসেবে কেমন তিনি? মিলিন্দ বললেন, “আমাদের বন্ধুত্বে কোনও চাওয়া-পাওয়ার স্বার্থ নেই। আমরা কেউ একে অন্যের থেকে কিছু চাই না। আমরা একে অন্যেকে শ্রদ্ধা করি এখনও। আর তাই কখনও সুনীলের কাছে কেউ আমার সম্পর্কে কিছু বললে বা আমার কাছে কেউ সুনীল সম্পর্কে কিছু বললে, দু’জনের কেউই তা গুরুত্ব দিই না। আমাদের বন্ধুত্ব এতটাই মজবুত। এটা দুই ভাইয়ের সম্পর্কের চেয়েও জোরালো। পারস্পরিক শ্রদ্ধা রয়েছে এই বাঁধনে। রয়েছে ভালবাসা। ওর সবচেয়ে বড় গুণ হল ধৈর্য। অসীম ধৈর্য ওর। মাথা ঠান্ডা রাখতে পারে। ও কখনও ভুল বোঝে না। এতটাই বুদ্ধিমান। নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নেয়। কারও কথায় প্রভাবিত হয় না। আগেই বলেছি, আমাদের যেমন প্রচণ্ড আত্মসম্মান রয়েছে, তেমনই অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাও রয়েছে।”
বাইশ গজে সাফল্যের রসায়নও কি এই ধৈর্য, মাথা ঠান্ডা রাখার ক্ষমতা? স্কুল, কলেজ জীবন থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ব্যাটসম্যান হিসেবে উত্তরণের সাক্ষী বললেন, “মারাত্মক মনসংযোগ আর ধৈর্য ছিল আগাগোড়াই। কিন্তু সুনীল ক্রমশ নিজেকে ছাপিয়ে গিয়েছে পরিশ্রমে। পাঁচ বছর বয়সে আমাদের সঙ্গে যখন মুম্বইয়ে গলি ক্রিকেট খেলত, তখনও আউট হতে চাইত না কিছুতেই। উইকেট দেবে না, এই মানসিকতা ছিল সেই সময়েই। সাত-আট বছর বয়সে যখন ব্যাট করত, তখন টেনিস বলে খেলতাম। ওই সময় টেনিস বলে দশ মিনিট ব্যাট করে যাওয়াও বিশাল ব্যাপার ছিল। ও কিন্তু অনায়াসে সেটা করে যেত। কোনও অবস্থাতেই আউট হলে তা মানতে পারত না। এটা ওর জন্মগত বৈশিষ্ট। ব্যাট করতে ভালবাসত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গুণ এটাই। ব্যাটিংকে ভালবাসা। বাকি সমস্ত কিছু কিন্তু ও নিজে নিজে শিখেছে। পরিণত হয়েছে ও। উন্নতির পথেও থেকেছে নিরন্তর। টেকনিক, ইন্টেলিজেন্স, গেম অ্যাওয়ারনেস আস্তে আস্তে উন্নত করেছে।”
৭০তম জন্মদিনে বন্ধুর সঙ্গে একান্তে মিলিন্দ রেগে।
শেষ টেস্ট ইনিংসে বেঙ্গালুরুর ঘূর্ণি পিচে ইমরানের পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ৯৬। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শেষের আগের ইনিংসে বিশ্বকাপের ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক সেঞ্চুরি। অবসরের সিদ্ধান্তে তাই কেঁদেছিলেন ভক্তরা। ফর্মে থাকতে থাকতে কেন বিদায়, উঠেছিল প্রশ্ন। গাওস্কর আবার এটাই চেয়েছিলেন শুনতে। যেন, উল্টোটা না কানে আসে কখনও!
বন্ধুর এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত মিলিন্দ রেগে। তাঁর মতে, “হি হ্যাজ হ্যাড এনাফ। ও জানত, কী করতে চলেছে। ওর সবচেয়ে বড় সম্পদ হল কখন কী করতে হবে, সেই টাইমিংটা নিখুঁত জানা। ব্যাটিংয়ের মতো এ ক্ষেত্রেও সময়জ্ঞান অসাধারণ। আর ও অসম্ভব বুদ্ধিমান। আপনাদের সৌরভ গঙ্গেপাধ্যায়ের মতোই। উচ্চশিক্ষিত, ভাল স্কুল ভাল কলেজ থেকে বেরিয়ে আসা, পর্যবেক্ষণ শক্তির অধিকারী, প্রচুর পড়াশোনার মধ্যে থাকা মানুষ।”
আরও পড়ুন: আইপিএলের জন্য ক্রিকেটারদের মানসিক ভাবে তৈরি থাকতে বলল অস্ট্রেলিয়া
ব্যাটসম্যান গাওস্করের মতো অধিনায়ক গাওস্করের রেকর্ড তত আকর্ষণীয় নয়। বরং ক্রিকেটমহলে ‘ডিফেন্সিভ ক্যাপ্টেন’ হিসেবেই পরিচিত তিনি। আর এই তকমা একেবারেই মানতে পারছেন না মিলিন্দ। মুম্বইয়ের নির্বাচকমণ্ডলীর চেয়ারম্যান মিলিন্দ রেগের যুক্তি, “এই তো কয়েক দিন আগে ডব্লু ভি রামনকে দেওয়া কপিল দেবের সাক্ষাৎকার দেখছিলাম। কপিল বলেছিল, গাওস্করের যদি সৌরভের দলের মতো বোলিং আক্রমণ থাকত, তবে ওই ভারতের সেরা ক্যাপ্টেন হতো। কপিল বলেছিল যে, সৌরভ অবশ্যই ব্রিলিয়ান্ট ক্যাপ্টেন। কিন্তু, সেই বোলিং শক্তি সুনীল পায়নি। কপিলের কথায়, অধিনায়ক হিসেবে সুনীল মোস্ট ক্লেভার ক্যাপ্টেন। তবে তেমন দল হাতে ছিল না ওর। কপিল যখন এ কথা বলছে, তখন আপনারাই বুঝে নিন। আরে, সুনীলের হাতে তো একটাই বোলার ছিল। সেটা হল কপিল। হরভজন, কুম্বলে, জাহিরদের পাশাপাশি যদি সহবাগ, সচিন, দ্রাবিড়দের দলে পেত, তবে ও নির্ঘাত বেস্ট ক্যাপ্টেন হতো। ব্যাটিংয়ে বিশ্বনাথ ছাড়া আর কাকে পেয়েছে ও? কাউকে না। বিশ্বনাথ ছিল একমাত্র ব্যাটসম্যান যাঁর গ্রেট ক্লাস ছিল। একমাত্র ওর উপরেই নির্ভর করা যেত। দল যতটা ভাল, অধিনায়কও ততটাই ভাল। আর সুনীল কিন্তু অসম্ভব বুদ্ধিমান অধিনায়ক ছিল। এই ধরনের কথাবার্তা আসলে অর্থহীন। বলুন তো, টেস্ট হারতে কে চায়? জিততে না পারার ক্ষমতা থাকলে হেরে যাওয়া একেবারে নির্বোধের কাজ।”
গত অর্ধ শতকে অনলাইন পোলে সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে রাহুল দ্রাবিড়কে। যা নিয়ে ক্রিকেটমহলে চলছে চর্চা। মিলিন্দ একেবারেই মানতে পারছেন না তা। বললেন, “তুলনা করা মুশকিল। আসলে তুলনা হয় না কোনও ভাবেই। কী ভাবে সুনীল, দ্রাবিড় বা সচিনের মধ্যে তুলনা হবে? গাওস্কর ওপেন করত। দ্রাবিড় নামত তিনে। চারে নামত সচিন। আমি তাই একেবারেই তুলনায় যাব না। প্রত্যেকেই গ্রেট। নিজের সময়ে সবাই সেরা ছিল।”
বোঝা গেল, তুলনায় তীব্র অপছন্দ। হয়তো ছোটবেলার বন্ধুকে যাবতীয় তুলনার বাইরেই রাখতে চান। দেখতে চান বাকিদের নাগালের বাইরে। মিলিন্দের কাছে গাওস্কর যে সারা জীবনের মতোই অতুলনীয় থেকেছেন, থেকে যাবেনও। জীবনের সবচেয়ে বড় ‘সৌভাগ্য’ যে এটাই!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy