ঐতিহাসিক: ২৫ জুন ১৯৮৩। লর্ডসে বিশ্বকাপ নিচ্ছেন কপিল দেব। পিছনে লেখক বিনু নাথ (লাল বৃত্তে চিহ্নিত)। ফাইল চিত্র
দিনটার কথা মনে পড়লে এখনও শিহরিত হই। ২৫ জুন, ১৯৮৩!
কে ভাবতে পেরেছিল, সারা জীবনের সংগ্রহশালায় রেখে দেওয়ার মতো একটা দিন দেখতে বেরোচ্ছি। কলকাতাতে বাড়ি থাকলেও পঞ্চান্ন বছর ধরে আমি ইংল্যান্ডের বাসিন্দা। লর্ডস থেকে আমার বাড়ি খুব দূরেও নয়। গাড়িতে মেরেকেটে দশ মিনিটের পথ। আমি এমসিসি-র সদস্যও। সেই সময়ে এমসিসি সদস্যপদের অধিকারী খুব বেশি ভারতীয় ছিল না।
‘মর্নিং শোজ দ্য ডে’ কথাটা সে দিন আর লর্ডসে বসে সত্যি বলে মনে হচ্ছিল না। বিশেষ করে যখন মাত্র ১৮৩ রানেই শেষ হয়ে গেলাম আমরা, সকলে ধরেই নিয়েছিলাম আর কোনও আশা নেই। আর কী দুর্ধর্ষ টিম ওয়েস্ট ইন্ডিজের! রিচার্ডস, লয়েড, গ্রিনিজ, হেনস, গোমস, ব্যাকাস, দুজোঁ। বল হাতে রবার্টস, মার্শাল, হোল্ডিং, গার্নার।
মনে আছে এমসিসি প্যাভিলিয়নে সে দিন আমার সঙ্গী ছিল টাইগার পটৌডি। ওর স্ত্রী শর্মিলা আমার খুব ভাল বন্ধু। শর্মিলার মাধ্যমেই টাইগারকে চিনতাম। তার পরে আমরা দু’জনে ভাল বন্ধু হয়ে যাই। লর্ডসে সে দিন যখন ভিভ রিচার্ডস খুব পেটাতে শুরু করল ভারতের বোলারদের, আমরা ভিতরের পানশালায় চলে গেলাম। কপিল দেব যখন প্রায় ৩০ গজ পিছনে দৌড়ে বিখ্যাত সেই ক্যাচটা নিয়ে ভিভকে ফিরিয়ে দিল, তখনও আমরা পানশালায়। ধরেই নিয়েছি, খেলার দফারফা যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে।
ভিভের আউটটাই ছিল টার্নিং পয়েন্ট ছিল। এর পর টাইগারই বলল, ‘‘চলো আমরা গিয়ে খেলা দেখি। মনে হচ্ছে ম্যাচে আকর্ষণীয় কিছু ঘটছে।’’ টাইগারের ক্রিকেট মস্তিষ্ক নিয়ে তো কারও কোনও প্রশ্ন থাকতে পারে না। ওঁর কথায় তাই ফের খেলা দেখতে এলাম এবং সারা জীবনের সেরা ইতিহাসের সাক্ষী থাকলাম। যত দূর মনে পড়ছে, ক্লাইভ লয়েডের হ্যামস্ট্রিংয়ে সামান্য চোট ছিল। তা না হলে পুরো শক্তির ওয়েস্ট ইন্ডিজকেই হারিয়েছিল কপিল দেবের ভারত। ক্রিকেটের ইতিহাসে সেরা অঘটন হিসেবেই যা থেকে গিয়েছে।
আরও পড়ুন: সেরার-তর্ক: ভোটে এগিয়ে সচিন, সাহসে গাওস্কর
ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১৮৩ টার্গেট নিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভুগেছিল। ওদের ব্যাটিংয়ে অকারণ ঔদ্ধত্য ছিল। বেপরোয়া মনোভাব নিয়ে চলতে গিয়ে ওরা ভুলে গিয়েছিল, এই ছোট টার্গেটগুলো খুব বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। বিশেষ করে ইংল্যান্ডের পরিবেশে। যেখানে হঠাৎ পাল্টে যেতে পারে আবহাওয়া। সে দিনও ওয়েস্ট ইন্ডিজ ব্যাট করার সময়ে বল ভাল সুইং করতে শুরু করে। আবহাওয়া পাল্টে গিয়েছিল। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিখ্যাত ব্যাটিং লাইন-আপ মনে রাখল না যে, ভারতের হাতে দারুণ সব সুইং-নির্ভর মিডিয়াম পেসার রয়েছে। যেমন বলবিন্দর সিংহ সাঁধু, রজার বিনি, মদন লাল। এঁরা ইংল্যান্ডের আবহাওয়ায় খুবই কার্যকরী বোলার ছিল। সাঁধুর বিখ্যাত ইনডিপারে গ্রিনিজের ‘জাজমেন্ট’ দিয়ে বোল্ড হওয়া কে ভুলবে! এবং, মোহিন্দর অমরনাথ। সেমিফাইনালের পরে ফাইনালেও ম্যান অফ দ্য ম্যাচ। আলতো মিডিয়াম পেসেও আবহাওয়াকে কাজে লাগিয়ে কী নিয়ন্ত্রিত সুইং বোলিং!
আমার যদিও মনে হয়, এই ভারতীয় দলের মধ্যে বিশ্বকাপ জয়ের বিশ্বাসটা তৈরি করে সকলকে পাল্টে দেওয়া ব্যক্তির নাম কপিল দেব। জ়িম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে টানব্রিজ ওয়েলসে কপিলের ১৭৫ নট আউট না ঘটলে ভারতের পক্ষে লর্ডসের ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছনোই সম্ভব হত না। তরুণ অধিনায়কের হার-না-মানা মনোভাব সংক্রমিত হয়েছিল দলের মধ্যে। সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডকে হারানোর সময়েও তাই ওদের মধ্যে খুব উদ্বেগ বা স্নায়ুর চাপ দেখা যায়নি। আমি বিশ্বকাপ জয় ছাড়াও লর্ডসে কপিলের আরও একটা কীর্তির সাক্ষী। এডি হেমিংসকে সেই পর-পর চার বলে চার ছক্কা মেরে ২৪ রান তুলে অভিনব ফলো-অন বাঁচানো!
কপিলের ভারত বিশ্বকাপ জয়ের পরে লর্ডসের যা চেহারা হয়েছিল, তা আর কখনও দেখিনি। হাজার, হাজার লোক নেমে পড়ে মাঠে। বাইরে আরও অনেক ভারতীয় জড়ো হয়েছিল। বাঁধনহারা উৎসব শুরু হয়ে যায়। ভারতীয় দল অবশ্য লর্ডসে নয়, হোটেলে ফিরে গিয়ে বিজয়োৎসব করেছিল। আর সেই উৎসব শেষ হয় পরের দিন ভোর তিনটের সময়। ওদের হোটেলের বাইরেও প্রচুর ভিড় ছিল। ১৯৮৩ সালের ২৫ জুন, লর্ডস ব্যালকনিতে যখন কপিল দেব প্রুডেনশিয়াল বিশ্বকাপ হাতে নিচ্ছে, আমি ঠিক ওর পিছনেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। এখনও ভারতীয় ক্রিকেটের সেরা রূপকথার সেই ছবিতে দেখা যাবে, কপিল ট্রফি নিচ্ছে আর আমি এমসিসি টাই পরে উচ্ছ্বসিত ভাবে ওঁর পিছনে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছি। তখন আমার বয়স ৩৭ বছর। সেই দিনটারও আজ ৩৭ বছর উদযাপন!
আরও পড়ুন: শাহরুখ বলেন, টিম এখন তোমার
ফাইনালের পরের দিন কপিলকে আমি ডিনারে নিয়ে গিয়েছিলাম। এখনকার টি-টোয়েন্টি আর আইপিএলের যুগে রাতারাতি ক্রিকেটারদের তারকা হয়ে ওঠা দেখি আর সে দিনটার কথা মনে পড়লে ভাবি, যুগ কতই না পাল্টে যেতে পারে! আমার সঙ্গে সদ্য বিশ্বকাপজয়ী এক ভারত অধিনায়ক। প্রথম বার দেশকে বিশ্বকাপ উপহার দেওয়া অধিনায়ক। কিন্তু অহঙ্কারী, উদ্ধত কপিল নয়, হাসিখুশি, তৃপ্ত কপিলকে দেখেছিলাম। সেই লাজুক, মাটিতে পা রেখে চলা এক মানুষ। লন্ডনের গ্রিক রেস্তরাঁ অ্যাঞ্জেলোসে গিয়েছিলাম আমরা। গ্রিক বলেই হয়তো কেউ খুব একটা নজর করল না সদ্য বিশ্বকাপ জেতা অধিনায়ক বসে আছে।
এখন এই টি-টোয়েন্টির রমরমা আর আইপিএলের যুগে আমরা যেন ভুলে না যাই, হরিয়ানা হারিকেনের হাত ধরে ভারতে ক্রিকেট নিয়ে ভাবনাটাই পাল্টে দিয়ে গিয়েছিল তিরাশির ২৫ জুনের সেই রাত!
(লেখক কলকাতার হলেও পঞ্চান্ন বছরের উপর লন্ডননিবাসী। তিরাশিতে কপিল দেবের দলের বিশ্বকাপ জয়ের দিন লর্ডসে হাজির ছিলেন এমসিসি সদস্য হিসেবে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy