Advertisement
২৭ ডিসেম্বর ২০২৪
PK Banerjee

পিকের শেষ যাত্রায় মিশে গেল সব দল

সবাই চেয়ারে গোল হয়ে বসে গিয়েছেন ‘দ্রোণাচার্য’ কোচের স্মৃতিচারণায়।

শোকস্তব্ধ: মালা দিয়ে শ্রদ্ধা প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের। নিজস্ব চিত্র

শোকস্তব্ধ: মালা দিয়ে শ্রদ্ধা প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের। নিজস্ব চিত্র

রতন চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০২০ ০৩:৩৬
Share: Save:

বাষট্টির জাকার্তা এশিয়ান গেমসের সোনাজয়ী দলের ব্লেজার পরে নিজের বাড়ির উল্টোদিকের মাঠে তৈরি অস্থায়ী মঞ্চে চিরনিদ্রায় শায়িত প্রদীপ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়।

কয়েক ফুট দূরে গোল হয়ে বসে ষাট-সত্তর-আশির দশকের অসংখ্য ফুটবলার তারকা। দেশ, রাজ্য বা ক্লাবের জার্সিতে কোনও না কোনও সময় পিকে-র কোচিংয়ে যাঁরা সফল হয়েছেন। প্রচুর ট্রফি জিতেছেন। উঠেছেন গৌরবের শিখরে।

তাঁরা সবাই চেয়ারে গোল হয়ে বসে গিয়েছেন ‘দ্রোণাচার্য’ কোচের স্মৃতিচারণায়। সুরজিৎ সেনগুপ্ত, রঞ্জিত মুখোপাধ্যায়কে সুভাষ ভৌমিক বলছিলেন, ‘‘মনে আছে সেই কোরিয়ার ডকরো গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে মাঠে নামার আগে প্রদীপদা কী করেছিলেন? বাজার থেকে শাঁখা-চুড়ি কিনে এনে বলেছিলেন, বিদেশি দল দেখে ভয় পেয়েছো। তা হলে এগুলো পরে বসে থাকো, মাঠে নামতে হবে না।’’ কয়েকটা চেয়ার পরেই কম্পটন দত্ত গল্প শোনাচ্ছিলেন ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়, মিহির বসুদের, ‘‘প্রদীপদার খুব সংস্কার ছিল। হাতে অনেকগুলো তাবিজ পরতেন। মাঠে নামার আগে সেগুলো ছুঁইয়ে দিতেন আমাদের মাথায়। নিজে সব ম্যাচে একই জামা-প্যান্ট পরে আসতেন। ডুরান্ডে যা করেছিলেন, জীবনে ভুলব না। বিরতিতে প্রদীপদা হঠাৎ আংটি দিয়ে নিজের বুক চিরে রক্ত বের করলেন। আমাদের মাথায় তা মাখিয়ে বললেন, ‘এই রক্তের সম্মান রেখে ফিরো।’ ম্যাচটা জিতেছিলাম আমরা।’’ ভিড়ে প্রয়াত পিকে-র প্রায় সমসাময়িক একজন ফুটবলারই হাজির ছিলেন, তিনি সুকুমার সমাজপতি।

রীতিমতো শোকসভা বসে গিয়েছে সবুজ কার্পেটের উপরে। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো অসংখ্য স্মৃতি উথাল-পাথাল করছিল সেখানে। ভারতীয় ফুটবলের বর্ণময় ব্যক্তিত্ব ছিলেন পিকে। ফুটবলের বাইরেও সিনেমা, নাটক, রাজনীতির জগতের মানুষ-- সবার সঙ্গেই ছিল সখ্যতা। শুধু ফুটবলার হিসেবে নন, কোচ হিসেবেও ছিলেন ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যক্তিত্ব। খেলার বাইরেও যে কোনও বিষয় নিয়েই কথা বলতেন অনর্গল। পিকে-র কথা বলার ধরনের মধ্যে এমন একটা আকর্ষণ থাকত যে, যেখানেই যেতেন রামধনুর মতো রং ছড়াতেন। তাঁর ছাত্ররা শুক্রবার সন্ধ্যায় সেই রাস্তাতেই হাঁটলেন গুরু তর্পণে এসে।

পিকে-র ছাত্ররা যখন ‘মহাগুরু’-র মহাপ্রস্থানের দিনে ক্লাবের রং মুছে জড়ো হয়েছেন, তখন অন্তিম শয্যায় শায়িত তিরাশি বছরের মানুষটির শরীর ঢেকে যাচ্ছিল নানা রং-য়ের পতাকায়। লাল-হলুদ, সবুজ-মেরুন, সাদা-কালো পতাকা দিয়ে গেলেন ময়দানের তিন প্রধানের কর্তারা। তিন ক্লাবেই কোনও না কোনও সময় কোচিং করিয়ে ট্রফি জিতিয়েছেন পিকে। তিন ক্লাবের পতাকার উপরেই দেওয়া হল জাতীয় পতাকা। হঠাৎ-ই দেখা গেল দুই যুবক একটি বল নিয়ে হাজির। তাঁরা পিকে-র পায়ের সামনে রেখে গেলেন নতুন বল। ফুল নয়, বল দিয়ে শ্রদ্ধা। মনে হল, শেষের দিনে এটাই সোনাজয়ী এশিয়ান গেমস অধিনায়ককে সেরা শ্রদ্ধার্ঘ্য।

গত এক মাসের চিকিৎসার ধকলে সদা হাস্যময় মানুষটির মুখ অনেকটাই বদলে গিয়েছিল। চশমা এবং ব্লেজার পরানোর পরে সেই মুখাবয়বে কিছুটা হলেও যেন ফিরে এসেছিল পিকে-র সেই পুরনো সপ্রতিভ মেজাজ। শুক্রবার দুপুর দুটোর পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সরকারি ভাবে জানিয়ে দেন, কিংবদন্তির প্রয়াণ ঘটেছে। সঙ্গে সঙ্গেই হাসপাতালে ছুটে আসেন তাঁর ভাই প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, দুই মেয়ে পলা ও পিক্সি। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষকৃত্য সম্পন্ন হলেও করোনাভাইরাস ছড়াতে পারে, সে জন্য রাজ্য সরকার কোথাও সাধারণের দেখার জন্য মরদেহ রাখার ব্যবস্থা করেনি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে রাজ্যের ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস শোকযাত্রার সব ব্যবস্থা করেন। সল্টলেকে পিকে-র বাড়ির সামনের মাঠ সংস্কার করে মঞ্চ তৈরির দায়িত্ব দেন বিধাননগরের মেয়র কৃষ্ণা চক্রবর্তীকে।

হাসপাতাল থেকে বিশাল কনভয় সল্টলেকের উদ্দেশ্যে বেরোয় বিকেল পাঁচটা নাগাদ। যে বাড়িতে পিকে-র পদ্মশ্রী, অর্জুন, এশিয়াডের সোনার পদক-সহ অসংখ্য গৌরবের স্মারক রয়েছে, সেই ঘরে শেষ বার তাঁকে আনা হয় সাড়ে পাঁচটা নাগাদ। তারপর নিয়ে যাওয়া বাড়ির সামনে মাঠে। মনে করা হয়েছিল এখানে মানুষ কম আসবেন। কিন্তু তা হয়নি। প্রয়াত ফুটবলারের সামাজিক ব্যপ্তি এতটাই ছিল যে, কয়েকশো গুণগ্রাহী হাজির হন সেখানে। করোনা-আতঙ্ক সত্ত্বেও। মঞ্চে দু’ঘণ্টা রাখা হয়েছিল পিকে-র মরদেহে। শ্রদ্ধা জানানোর জন্য এসেছিলেন রাজ্যপাল, কলকাতার মেয়র, রাজ্যের জনা ছয়েক মন্ত্রী-বিধায়ক, বিরোধী দলনেতা।

পিকে-র শেষ ইচ্ছে ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যেখানে অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছিল, সেই নিমতলা শশ্মানেই যেন তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়। পরিবারের পক্ষ থেকে তা জানানো হয় রাজ্য সরকারকে। রাত সাড়ে সাতটা নাগাদ পুলিশের ব্যান্ড এবং গান স্যালুটে বিদায় জানানো হয় তাঁকে। সেই সঙ্গে শেষ হয়ে যায় ভারতীয় ফুটবলের এক গৌরজনক অধ্যায়। এদেশের ফুটবলে যা অমলিন হয়ে থাকবে চিরদিন।

অন্য বিষয়গুলি:

PK Banerjee Death Footballer
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy