Advertisement
E-Paper

বিদায়ের আঁধার থেকে প্যারিস অলিম্পিক্সে পদকের সামনে মনু ভাকের

মনু ভাকের। নামটা যত বার শুনছি, টোকিয়োর সেই চোখের জল মুছতে মুছতে বেরিয়ে যাওয়ার ছবিটা মনে পড়ছে। শুক্রবার গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের দিন থেকেই প্যারিসের আকাশ ভারী।

মনুর সামনে পদকের হাতছানি। শনিবার।

মনুর সামনে পদকের হাতছানি। শনিবার। ছবি: পিটিআই।

সুমিত ঘোষ

শেষ আপডেট: ২৮ জুলাই ২০২৪ ০৭:৩৯
Share
Save

কোভিডের পৃথিবীতে টোকিয়ো অলিম্পিক্স। কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে যাওয়া এক শুটার। কে জানত, তিনিই ফিরে আসবেন চার বছর পরে।

ঘনঘন মেজাজ হারিয়ে ফেলা এক তরুণী। যে বদমেজাজ এক জন শুটারের চরম শত্রু। যা দেখে কেউ কেউ পরামর্শ দিয়েছিল, মনোবিদের ক্লাস করো। কে ভেবেছিল, তিনিই মেজাজকে বশ মানিয়ে ১৪০ কোটি ভারতীয়ের প্রত্যাশার মুখ হয়ে উঠবেন!

কোচের সঙ্গে রাগারাগি করে বিচ্ছেদ ঘটানো বিতর্কিত এক অলিম্পিয়ান। কে অনুমান করেছিল, তিনিই সব দূরত্ব মিটিয়ে কোচের সঙ্গে পুনর্মিলন ঘটিয়ে পদকের প্রদীপ জ্বালিয়ে তুলবেন।

মনু ভাকের। নামটা যত বার শুনছি, টোকিয়োর সেই চোখের জল মুছতে মুছতে বেরিয়ে যাওয়ার ছবিটা মনে পড়ছে। শুক্রবার গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের দিন থেকেই প্যারিসের আকাশ ভারী। সাড়ে তিন ঘণ্টার উপরে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে অভিনব বোধন উপভোগ করেছে সকলে। শনিবার গেমসের ইভেন্টের শুরুর দিনেও আকাশ বিদ্রোহী। সকাল থেকে বৃষ্টি চলছে। একটা সময় মনে হচ্ছিল, প্রকৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভারতীয় অভিযানও কি শুরু হল কালো আকাশ মাথায় নিয়ে? শুটিংয়ে এ বার সব চেয়ে বড় দল পাঠানো হয়েছে। সব চেয়ে বেশি প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু সকাল থেকে একের পর এক ভরাডুবির খবর। একেবারে শেষ বেলায় আঁধার থেকে আলোয় ফেরালেন মনু ভাকের। সুড়ঙ্গের শেষে আলোর রেখা খুঁজে পাওয়ার মতো। ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে ফাইনালে উঠে পদকের আশা বাঁচিয়ে রেখেছেন তিনি। কুড়ি বছরের ব্যবধানে কোনও মেয়ে অলিম্পিক্সের ব্যক্তিগত শুটিং ইভেন্টের ফাইনালে উঠল। যোগ্যতা অর্জন পর্বের ৬০ শটের পরে ৫৮০ পয়েন্ট নিয়ে তৃতীয় হয়েছেন মনু। রবিবার ভারতীয় সময় দুপুরের দিকে শতেরুর শুটিং রেঞ্জে পদকের পরীক্ষায় নামবেন তিনি। কোনও সন্দেহ নেই, সেখানে অনেক কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বীরা অপেক্ষা করবেন। যেমন হাঙ্গেরির ভেরোনিকা মায়র। যিনি যোগ্যতা অর্জন পর্বে প্রথম হয়েছেন। কোরিয়ার ও ইয়ে জিন দ্বিতীয় স্থানে শেষ করেছেন। ভারতীয় শুটারের সব চেয়ে বড় প্রতিপক্ষের তালিকায় এই দু’জন তো আছেনই, মাথায় রাখা দরকার চিনের জিয়ান রান সিন। টোকিয়োতে ১০ মিটার এয়ার পিস্তলের এই বিভাগেই ব্রোঞ্জ পেয়েছিলেন। মিক্সড টিম ইভেন্টে সোনা জিতেছিলেন। এগুলো ভারতীয় ক্রীড়াপ্রেমীদের উদ্বেগে রাখলে, উৎসাহিত করার মতো তথ্যও রয়েছে। ভেরোনিকা এখনও পর্যন্ত অলিম্পিক্সে কোনও পদক পাননি। রাশিয়ার শুটারররা এই অলিম্পিক্সে নেই। গ্রিসের আনা কোরাকাকি, যাঁর ঝুলিতে শুটিংয়ে একাধিক পদক রয়েছে, তিনি এ দিন ফাইনালে উঠতে পারেননি।

মনু ভাকের।

মনু ভাকের। ছবি: রয়টার্স।

আবার এক-একটা সময় মনে হচ্ছে, এমন দুঃসাহসিক প্রত্যাবর্তনের পরে উদ্বেগ-আতঙ্কের কথা ভাবব কেন? নেতিবাচক চিন্তায় আচ্ছন্ন থাকব কেন? মনু ভাকের তা হলে কী শেখাল? কিশোরীর কাছে ‘বার্বি ডল’ যা, মেয়ে শুটারের কাছে বন্দুক বা পিস্তলও তো তাই। দুনিয়া বিপক্ষে যেতে পারে, কিন্তু প্রিয় খেলনা সঙ্গে থাকবে। আর মনুর কাছে পিস্তল আরও বেশি করে প্রিয় খেলনা হওয়ার কথা। মা স্কুলের প্রিন্সিপাল। সেই স্কুলে শুটিং রেঞ্জ ছিল। মনু মায়ের স্কুলে গিয়ে শুটিং শুরু করেন। তার আগে মার্শাল আর্টসে নাম লিখিয়েছিলেন। ভাল লাগেনি বলে ছেড়ে দেন।

টোকিয়োয় সেই পিস্তলই যে বিদ্রোহ করে বসল তাঁর সঙ্গে। হঠাৎ গোলযোগ দেখা দিল। একেই অলিম্পিক্সের মতো বড় মঞ্চে প্রত্যাশার চাপ। তার উপরে হাতিয়ার বিকল হয়ে গিয়েছে। মনুর জন্য সেদিন ডুকরে ওঠা কান্নাই অপেক্ষা করে ছিল। কেউ বলেন, ভাগ্যের পরিহাস। কেউ দোষ দেন, মনুর একগুঁয়েমিকে। পিস্তল বা বন্দুক বিকল হতেই পারে। তার জন্য শুটারদের বিকল্প তৈরি রাখতে হয়। দ্বিতীয় একটা পিস্তল আগে থেকে পরীক্ষা করিয়ে নিয়ে বিচারকদের সবুজ সঙ্কেত নিয়ে রাখতে হয়, যাতে ইভেন্টের মধ্যে কিছু ঘটলে সামাল দেওয়া যায়। মনু তা করতে চাননি। টোকিয়োয় একটা পিস্তলের উপরেই ভরসা রেখেছিলেন, দ্বিতীয়টা আর তৈরি রাখতে চাননি। অনেক শুটার অভ্যস্ত হওয়ার জন্য দুটি পিস্তলই ব্যবহার করেন, যাতে একদম বেমানান না লাগে। মনু তা করেননি। মাঝপথে বিকল হয়ে যাওয়া হাতিয়ার সারাতে যান। আর তা করতে গিয়ে অনেকটা সময় নষ্ট করে ফেলেন। তার পরে আর ফিরে আসতে পারেননি। তখন এমনকি প্রশ্ন ওঠে, কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়েই কি নিজের বিপদ ডেকে আনলেন মনু?

টোকিয়োর যন্ত্রণা এখানেই শেষ হল না। ফিরে এসে এশিয়ান গেমসে সোনা জয়ী প্রাক্তন শুটার, কোচ যশপাল রানার সঙ্গে ঝামেলা শুরু হয়ে গেল। মনু বলে দিলেন, যশপালের অধীনে আর থাকবেন না। এর পর থেকে ব্যক্তিগত কোচ রেখে তিনি সব প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে থাকলেন। টোকিয়োর ব্যর্থতার জন্য ঘনিষ্ঠ মহলে যশপাল রানাকেও দায়ী করতে থাকেন তিনি। কিন্তু দ্রুতই বুঝতে পারেন, রাগারাগি করে নিজের সর্বনাশই আরও বেশি করে ডেকে আনছেন। গত বছর ফের রানার সঙ্গে জুটি বাঁধেন। দু’জনে সামনা-সামনি বসে অন্তর্কলহ মেটান। নতুন উদ্যমে পথ চলা শুরু হয় গুরু-শিষ্যার। আর বদমেজাজকে বশ মানানো? সেটা কী ভাবে সম্ভব করলেন মনু? বাদ্যযন্ত্র হাতে তুলে নিয়ে। বেহালা বাজানো শিখছেন যাতে শুটারের মনঃসংযোগ ও বরফশীতল মস্তিষ্ক তৈরি করতে পারেন।

এ দিনই আবার দু’বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন সরবজ্যোৎ সিংহ দারুণ লড়েও ছিটকে গেলেন অঙ্কের সামান্য হেরফেরে। মাত্র একটা গুলির লক্ষ্যভেদের তফাতে, কার্যত ফটোফিনিশে বেরিয়ে গেলেন জার্মানির রবিন ওয়াল্টার। মনুর সঙ্গে একই বিভাগে থাকা রিদম সাঙ্গওয়ান পারলেন না। তিনি শেষ করলেন ১৫নম্বর স্থানে।

কিন্তু শুক্রবার শতেরুতে সব চেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ছবি বোধ হয় মনু তৃতীয় হওয়ার পরে যশপালের চোখে জল। টোকিয়োয় ছাত্রী কেঁদেছিলেন। সেটা ছিল স্বপ্নভঙ্গের চোখের জল। শতেরুতে গুরু কাঁদছেন। এটা স্বপ্নপূরণের আশার জল। আবার মনে হচ্ছে, এটা দারুণ আবেগের মুহূর্ত হতে পারে ঠিকই। কিন্তু আরও গভীর ছবি হচ্ছে, মনুর সাংবাদিকদের সামনে না আসা। অলিম্পিক্সে প্রতিযোগীরা মিক্সড জোনে এসে তাঁদের দেশের সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। সেই অনুযায়ী, আজ মনুর আসার কথা ছিল। কিন্তু তিনি এলেন না। গুরু যশপালও বলে দিলেন, আজ কথা বলবেন না।

যুদ্ধজয়ের যে এখনও বাকি। প্রিয় খেলনা চার বছর আগে কাঁদিয়ে ছেড়েছে। আগে তো পদকের হাসি ফিরিয়ে দিক। অলিম্পিক্স যতই শান্তির বার্তা প্রচার করুক, কাকে কখন দু’হাত ভরে দেবে, কখন নিঃস্ব করে দেবে, কে বলতে পারে! তার চেয়ে রবিবারের দুপুর পর্যন্তই না হয় অপেক্ষা করি।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Paris Olympics 2024 Manu Bhaker shooter

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}