স্মরণীয়: কমনওয়েলথ গেমস থেকে সোনা জয়ের উচ্ছ্বাস লাভলি, পিঙ্কি, নয়নমণি ও রূপার। মঙ্গলবার। ছবি পিটিআই।
লন বোলস? আদৌ একটি খেলা নাকি? কমনওয়েলথ গেমসে এই খেলাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে? এ ধরনের প্রশ্নকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে প্রথম বারের মতো সোনা জিতে ইতিহাস গড়েছে ভারতীয় মহিলা দল। অন্যতম সদস্য, অসমের গোলাঘাট জেলার সরুপথারে টেঙা হোলা গ্রামের মেয়ে নয়নমণি শইকিয়া। পেশায় অসম বনদফতর সুরক্ষার কর্মী। এপ্রিলে বিহুর সময় তাঁর সাড়ে ছয় বছরের কন্যাকে আদর করেছিলেন। তার পরেই রওনা দেন গুয়াহাটিতে প্রস্তুতির উদ্দেশে। রওনা দেওয়ার আগে কন্যাকে বলে এসেছিলেন, ‘‘কমনওয়েলথ গেমস খেলতে যাচ্ছি। তোর জন্য কী আনব?’’ মেয়ে তনয়া বলেছিল, ‘‘একটা ভাল পুতুল এনো।’’
লন বোলসে সোনা জেতার পরে স্বর্ণপদক তো তিনি পেয়েইছেন, সঙ্গে করে নিয়ে আসছেন বার্মিংহাম গেমসের ম্যাসকট ‘পেরি দ্য বুল’-কে। যা মেয়ের হাতেই তুলে দেবেন ৩৩ বছরের তারকা। সোনা জয়ের পরে বার্মিংহাম থেকে আনন্দবাজারকে ফোনে নয়নমণি বলছিলেন, ‘‘আবেগ ধরে রাখতে পারছি না। ২০১০ কমনওয়েলথ গেমস থেকে লড়েই চলেছি। দীর্ঘ ১২ বছর পরে এল সাফল্য। তাও আবার সোনা।’’ যোগ করেন, ‘‘পদক গলায় পরিয়ে দেওয়ার পরে হাতে দেওয়া ম্যাসকটটি দেখে মেয়ের কথা মনে পড়ে গেল। চার মাস হয়ে গিয়েছে ওকে শেষ বার আদর করেছি। আমাকে বলেছিল, বিদেশ থেকে একটি পুতুল এনো। এই ম্যাসকট ওর জন্য।’’ বলতে বলতে গলা ধরে আসে তাঁর। আনন্দবাজারের সঙ্গে কথা বলারই মাঝে তাঁর স্বামী অভিনন্দন জানানোর জন্য ফোন করছিলেন নয়নমণিকে। কিন্তু তিনি বলেন, ‘‘ওর সঙ্গে কথা বলে নেব, আপনার যা জানার আছে জিজ্ঞেস করে নিন।’’
হঠাৎ এতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠবেন, ভাবতেও পারেননি নয়নমণি। গুয়াহাটিতে যেখানে অনুশীলন করেন, সেখানে পরিকাঠামোর অভাব। ঘাসের কোনও টার্ফ নেই। মাঝে মধ্যেই তাই কলকাতার ঘাসের টার্ফে এসে অনুশীলন করতে হত তাঁকে। কিন্তু বেশির ভাগটাই কাটত গুয়াহাটিতে। কন্যা, স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়িকে ছেড়ে একা থাকতে হত নয়নমণিকে। বলছিলেন, ‘‘সন্তান জন্মানোর পরে অনুশীলন করতে সমস্যা হত। কিন্তু আমার পরিবারের সকলে উৎসাহ দিতেন। কখনও খেলতে বাধা দেননি। আগে আমি ভারোত্তোলন নিয়ে এগোব ভেবেছিলাম। কিন্তু ২০০৮ সাল থেকে লন বোলসে যোগ দিই। চাকরিতে ঢোকার পরেও কোনও সমস্যা হয়নি। দেশের অনেকেরই এই খেলা সম্পর্কে কোনও ধারণা নেই। আমরা পদক জেতার পরে ধীরে ধীরে এই খেলার প্রতি আগ্রহ বাড়তে পারে।’’
তিনি আরও বলেছেন, ‘‘বার্মিংহামে এসে দেখি এখানের টার্ফ অত্যন্ত মসৃণ। হাত থেকে বল গড়ালেই পার হয়ে যাচ্ছে মাঠ। প্রস্তুতির তুলনায় অনেকটাই ধীর গতিতে বল ছুড়তে হয়েছে, যাতে মাঠ পার করে না চলে যায়।’’
সোমবারই নিশ্চিত হয়ে যায় নয়নমণিদের পদক। গ্রামের বাড়িতে ডাল, লাবড়া সবজি, থোড়ের ডালনা, টমেটো দিয়ে লোকাল রুই, আলু দিয়ে রাজ হাঁসের মাংস, পুদিনা ও কারি পাতার চাটনি দিয়ে নৈশভোজের আয়োজন করা হয়। কিন্তু সোনা জিতবেন কি না, ছিল প্রশ্ন। লাভলি চৌবে, পিঙ্কি, রূপা রানি তিরকে ও ঘরের মেয়ে নয়নমণি শেষ পর্যন্ত নিরাশ করেননি। সুদীর্ঘ ১২ বছর পরে কমনওয়েলথ গেমসে ফের পদক অসমসন্তানের, তাও আবার সোনা!
২০১৩ সালে সরুপথারের কাছমারি গ্রাম থেকে বিয়ে করে টেঙা হোলা গ্রামের বাসিন্দা হয়েছিলেন নয়নমণি। স্বামী ভাস্করজ্যোতি ব্যবসায়ী। বিয়ের পরেও খেলা চালাতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সাধারণত সন্দেহ, আশঙ্কা থেকেই যায় মেয়েদের। কিন্তু নয়নের কোনও সন্দেহই ছিল না। কারণ তাঁর পাশে বড় ভরসা হিসেবে ছিলেন শাশুড়ি নিজে। জাহ্নবীদেবী ১৯৭৯ সালে অ্যাথলেটিক্সে রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। কিন্তু বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার ফলে আর এগোতে পারেননি।
আজ বৌমা সোনা পাওয়ার পরে উচ্ছসিত জাহ্নবী বলেন, “২০১৫ সালের জাতীয় শিবিরে ডাক পায় নয়ন। মাত্র ৯ মাসের মেয়েকে আমার কাছে রেখে চলে যেতে হয় ঝাড়খণ্ডে। একজন মায়ের পক্ষেই এই দুঃখ বোঝা সম্ভব।”
বাইরে তখন ঢাক-ঢোল-নাচে বিহুর পরিবেশ। নয়নমণিকে নিয়ে বাঁধা হয়েছে গান। সেই তালে কোমর মিলিয়েছেন গ্রামের আবালবৃদ্ধবণিতা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy