কীর্তি: ঝুলন প্রেরণা দিচ্ছেন তরুণ প্রজন্মকে। ফাইল চিত্র
কে বলল, ভারতে পেস বোলার হয় না?
ওই তো লম্বা মেয়েটা। কাঁধে ক্রিকেটের বিশাল কিটব্যাগ। চাকদহ স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠে পড়ল। ভিড় ট্রেনে ঠেলাঠেলি করে এক কোণে কোনও রকমে ঠেসেঠুসে দাঁড়িয়ে।
জায়গা করে দেওয়া দূরে থাক, উল্টে নিত্যযাত্রীদের কটাক্ষ ভেসে আসে। মেয়ে হয়ে ক্রিকেট খেলবে? কেন সময় নষ্ট করছ? পড়াশোনা নেই বাপু তোমার! কিশোরী তবু অদম্য। কিটব্যাগের উপরে হাতের বন্ধন আরও দৃঢ় হয়।
শিয়ালদহ এসে গিয়েছে। কিশোরীর যাত্রা তখনও শেষ হয়নি। এ বার বাস ধরে বিবেকানন্দ পার্ক। আরও অন্তত আধঘণ্টার পথ। সকাল সাতটার মধ্যে পৌঁছতেই হবে। এক মিনিটও দেরি মানে শৃঙ্খলাপরায়ণ কোচ ব্যাট-বল ধরতেই দেবেন না। পত্রপাঠ বাড়ি পাঠিয়ে দেবেন।
কে জানত, প্রবল ধস্তাধস্তি আর কটাক্ষ সহ্য করে ট্রেনযাত্রার সওয়ার হতে হতে তিনি— ঝুলন গোস্বামী নিজেই হয়ে উঠবেন ভারতীয় বোলিংয়ের সুপারফাস্ট ট্রেন। চাকদহ এক্সপ্রেস হয়ে দুরন্ত গতিতে ছুটবেন দেশ-বিদেশের সব মাঠে! ঝুলন সেই চাকদহ থেকে ভোরবেলায় বেরিয়েও কোনও দিন ক্রিকেট প্রশিক্ষণ শিবিরে দেরিতে পৌঁছননি। কখনও তাঁকে বিবেকানন্দ পার্ক থেকে বিনা অনুশীলনে ফেরত পাঠাতে পারেননি কোচ।
সেই সংকল্প, দায়বদ্ধতা, পরিশ্রমের ছবিই যেন ঠিকরে বেরোল অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে। দ্বিতীয় ম্যাচের শেষ ওভারে শিশিরে ভেজা বল হাত থেকে পিছলে বেরিয়ে কোমরের উপরের উচ্চতার কারণে ‘নো বল’ হল। ক্যাচ হয়েছে ভেবে জেতার আনন্দ করছে তখন গোটা দল। আম্পায়ার ‘নো’ ডাকলেন, ম্যাচটাই ফস্কে গেল। কিন্তু মর্মান্তিক হারও দমাতে পারল না তাঁকে।
চাকদহ থেকে ট্রেনে ঠেলা খেতে খেতে আসার কৃচ্ছ্রসাধন ঝুলনদের হারতে শেখায় না। বক্সারের মনন তৈরি করে দেয়। মাঝে মাত্র ছত্রিশ ঘণ্টা। আরও একটা শেষ ওভার। হতাশার অন্ধকার থেকে উৎসবের আলোয় নিজেকে এবং দলকে ফিরিয়ে আনলেন ঝুলন ‘হার-না-মানা’ গোস্বামী। আন্দাজ করার চেষ্টা করছি, ম্যাচ হারার পরে হোটেলে ফিরে নিজেকে তাতানোর জন্য কার আত্মজীবনী পড়ছিলেন ঝুলন? স্বামী বিবেকানন্দ? মারিয়ন জোন্স? নাকি তাঁর সব চেয়ে প্রিয় দিয়েগো মারাদোনা?
আবার মনে হচ্ছে, অন্য কারও জীবনীই বা কী দরকার? তিনি নিজেই তো জ্বলন্ত উদাহরণ। ‘চাকদহ থেকে চক দে’— তাঁর যে রূপকথার যাত্রা, সেটাই তো রোম খাড়া করে দেওয়ার মতো। লক্ষ লক্ষ মানুষকে জীবনের কঠিন রাস্তায় এগিয়ে চলার অনুপ্রেরণা জোগাবে।
কী অসাধারণ এক সন্ধিক্ষণ! আরও এক বার অস্ট্রেলিয়ার বিজয়রথ থামিয়ে দিল ভারত। তাতে ফের এক বাঙালির হাত। ২০০১-এর ইডেনে ঐতিহাসিক টেস্ট ম্যাচে স্টিভ ওয়ের দলের অশ্বমেধের ঘোড়া থামিয়ে দিয়েছিল সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের ভারত। এ বার অস্ট্রেলিয়ার মাটিতেই পাল্টা কুচকাওয়াজে অস্ট্রেলীয় মেয়েদের রুখে দিল মিতালি রাজের দল। ঝুলন ৩৭ রানে তিন উইকেট তো নিলেনই, শেষ ওভারে ব্যাট হাতে চার মেরে জেতালেন। সঙ্গে ছ’শো উইকেটের বিরল কীর্তি। রবিবার ছিল ভারতীয় ক্রিকেটে ঝুলন পূর্ণিমার দিন।
অবশ্য নজিরের স্বাদ নতুন কিছু নয় তাঁর জীবনে। প্রায় দুই দশকের ক্রিকেটজীবনে একটার পর একটা পালক যোগ হয়েছে মুকুটে। বিশ্বের দ্রুততম মহিলা পেসার। আইসিসির বর্ষসেরা ক্রিকেটার। সেরা অলরাউন্ডার। বিশ্বের সর্বোচ্চ উইকেটসংগ্রাহক। কপিল দেবের রেকর্ড হাতছাড়া হয়েছে কিন্তু ঝুলনেরটা ভাঙা কঠিন হবে।
ব্যাটসম্যান হিসাবে শেষ ওভারে চার মেরে জেতানো দেখে অনেকের মনে পড়ে যাচ্ছিল শুরুর দিনের কথা। স্বপনবাবুর কাছে প্রথম দিন এসে অপেক্ষা করেছিলেন সেই কিশোরী, স্যর কখন ব্যাট করতে দেবেন। কিন্তু কোচ বুঝে যান, লম্বা মেয়েটিকে দিয়ে বলই করাতে হবে। হাতে বলটা তুলে দিয়ে বলেন, ‘‘মনে রাখবে বোলারের জীবন মানে পরিশ্রমীর জীবন। এই যে ছোটা শুরু করলে, দৌড় যেন না থামে।’’ ক্রিকেট বিশ্ব রবিবার ফের দেখে নিল থামেনি, সেই দৌড় থামেনি। ছুটছে চাকদহ এক্সপ্রেস।
ক্রিকেটে আসাটাও এক চমকপ্রদ কাহিনি। দাদাদের ক্রিকেট ম্যাচে এক দিন ছেলে কম পড়ায় তাঁকে খেলতে নেওয়া হয়। ঝুলন সেই যে ক্রিকেটের চৌকাঠে ঢুকে পড়লেন, আর বেরোননি। আন্তর্জাতিক আকাশে স্বপ্নের উড়ান ধরে ফেললেন। পনেরো বছর বয়সে স্কুল থেকে ফ্রি টিকিটে অস্ট্রেলিয়া বনাম নিউজ়িল্যান্ড মেয়েদের বিশ্বকাপ ফাইনাল দেখার সুযোগ ঝুলনের মনে ক্রিকেটকে গেঁথে দিয়ে যায়। সেই সন্ধ্যাতেই বাড়ি ফেরার পথে নিজের মধ্যে শপথ নেন তিনি— এক দিন ভারতের হয়ে বিশ্বকাপ খেলতে হবে!
মেয়েদের ক্রিকেট আজ হয়তো সরাসরি সম্প্রচার হচ্ছে, অর্থ এসেছে। একটা সময়ে দুয়োরানির সন্তান হয়ে পড়ে থাকত। তখন কোনও ফ্লাইটের বিজ়নেস ক্লাস অপেক্ষা করত না। ট্রেনে চেপে খেলতে যেতে হত। অনেক সময় বসবাসযোগ্য হোটেলও জোটেনি। মাটিতে চোদ্দো-পনেরো জন একসঙ্গে শুয়ে রাত কাটিয়েছেন। অনুষ্কা শর্মারা একদম ঠিক চরিত্র বেছে নিয়েছেন বায়োপিকের জন্য। এমন রোমহর্ষক জীবনকাহিনি খুব কমই আছে ভারতীয় ক্রিকেটে!
অস্ট্রেলিয়ায় রবিবার শুধু ভারত জেতেনি। ঝুলন একা জেতেননি। জিতেছে তাঁর এই অদম্য ক্রিকেট যাত্রাও!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy