নজরে: ম্যাচের পরে এ রকমই অসতর্ক ভাবে হাত মেলাতে দেখা গিয়েছে মর্গ্যান, কার্তিকদের। আইপিএল
যত সময় যাচ্ছে, ততই আইপিএলের জৈব সুরক্ষিত বলয় নিয়ে নানা প্রশ্ন এবং ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের গাফিলতি সামনে আসতে শুরু করেছে। এ নিয়ে কোনও সন্দেহই আর থাকছে না যে, ছ’মাস আগে সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে হওয়া আইপিএলে যতটা কঠোর ভাবে কোভিড সুরক্ষা বিধি মানা হয়েছিল, তা এ বারে অনুসরণ করা হয়নি।
আমিরশাহিতে যে সংস্থা জৈব সুরক্ষিত বলয় তৈরি করেছিল এবং কঠোরতম, আপসহীন সুরক্ষাবিধি সকলকে মানতে বাধ্য করেছিল, তাদের এ বারে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। এই সংস্থা গত বার এমনকি আইপিএলের মহাতারকা মালিক-মালকিনদের পর্যন্ত কোনও ছাড় দেয়নি। পরিষ্কার বলে দিয়েছিল, কোভিড স্বাস্থ্য বিধি এবং এসওপি (স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিয়োর) সকলকে মানতেই হবে। কোথাও সামান্যতম ফাঁকও রাখা হয়নি। যে কারণে শুরুতেই চেন্নাই সুপার কিংসের ১৩ জনের করোনা ধরা পড়লেও পরিস্থিতি সামলে নেওয়া গিয়েছিল। আমিরশাহিতে গত বার যখন আইপিএল হয়েছিল, তখন সেখানে দৈনন্দিন এক হাজার করোনা আক্রান্ত ছিল। এ বারে ভারতে এক লক্ষ থেকে তিন লক্ষ, এমনকি চার লক্ষে পৌঁছে যায় দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা। তার মধ্যে আইপিএল চালিয়ে গেলেও স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি নিয়ে সেই কড়াকড়ি ছিল না বলেই ওয়াকিবহাল মহলের মত।
এ বারে স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামলানোর জন্য একটি ভারতীয় সংস্থাকে দায়িত্ব দেয় বোর্ড। আইপিএল স্থগিত হয়ে যাওয়ার পরের দিন, বুধবার, নানা দলের সঙ্গে কথা বলে এই ভারতীয় সংস্থার প্রক্রিয়া নিয়ে দারুণ উৎসাহব্যঞ্জক মন্তব্য পাওয়া গেল না। উল্টে আঁতকে ওঠার মতো কিছু তথ্য শোনা গেল। যেমন গত বারে ক্রিকেটারদের মোবাইলে স্বাস্থ্য সুরক্ষা সম্পর্কিত অ্যাপ ডাউনলোড করতে বলা হয়েছিল। সারা ক্ষণ মেডিক্যাল অফিসারদের কাছে নিজেদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য জানাতে হত এই অ্যাপের মাধ্যমে। রোজ জানাতে হত, শরীরের তাপমাত্রা কত, কোনও রকম মাথাব্যথা, সর্দি-কাশি বা কোভিড সংক্রান্ত উপসর্গ আছে কি না। এই শারীরিক তথ্য সরবরাহ করা ছিল বাধ্যতামূলক এবং কেউ নিয়ম লঙ্ঘন করলে মোটা টাকা জরিমানার ব্যবস্থাও ছিল। এর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল, যদি কোনও দলের মধ্যে কোভিডের লক্ষণ দেখা দেয়, আক্রান্তদের দ্রুত চিহ্নিত করে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া যাতে আটকানো যায়। অভিযোগ উঠছে, এ বারে এই দৈনন্দিন মেডিক্যাল বুলেটিন জমা দেওয়ার রীতি অনেক ক্ষেত্রেই শিথিল হয়ে পড়েছিল। সেই আঁটসাঁট ব্যাপারটাই ছিল না। যার ফলে সন্দেহ তৈরি হয়, মৃদু উপসর্গ থাকলে তাঁকে কী ভাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে? সেই ক্রিকেটার তো অনেকের সঙ্গে মিশে গিয়ে সংক্রমণ ছড়িয়ে দিয়ে থাকতে পারেন।
ছ’মাস আগে আমিরশাহিতে ডাগআউট তৈরি করা হয়েছিল দূরত্ববিধি মেনে। একটা করে চেয়ার ছেড়ে বসছিলেন দলের সদস্যরা। এ বারে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে থাকতে দেখা গিয়েছে সব দলকে। যেন প্রাক-কোভিড পৃথিবীতে ফিরে গিয়েছি আমরা। ম্যাচের মধ্যে ক্রিকেটারদের গায়ে গা লাগিয়ে উৎসব করার নিষেধাজ্ঞা তো মানা হয়ইনি, উল্টে অন্য দলের খেলোয়াড়-কোচেদের সঙ্গে দূরত্ববিধি শিকেয় তুলে অনেককে মিশতে দেখা গিয়েছে। কোভিডের কারণে যে কোনও খেলাতেই এখনও হাত মেলানো বারণ। হাতের মুঠোয় মুঠো স্পর্শ করে দু’দলের অধিনায়কের সৌজন্য বিনিময় করার কথা। এ বারে ম্যাচের শেষে অনেক ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, হাত মেলাচ্ছেন দুই অধিনায়ক বা দু’দলের ক্রিকেটারেরা। এমন ছবিও দেখা গিয়েছে যে, ম্যাচের পরে দু’দলের বন্ধু ক্রিকেটারেরা একে অপরকে আলিঙ্গন করছেন, কেউ হয়তো কাউকে কোলে তুলে নিচ্ছেন, ঘনিষ্ঠ ভাবে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। কে বলবে, যে সব শহরে আইপিএলের মাঠে এই ধরনের ছবি দেখা যাচ্ছিল, সে সব জায়গায় কোভিডের চিতার আগুন জ্বলছে। দেশ জুড়ে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা যখন দৈনন্দিন চার লক্ষে পৌঁছে গেল, তখন অন্তত কড়াকড়ি করা যেত ‘এসওপি’ নিয়ে। অবুঝ, অপরিণত ক্রিকেট বোর্ড সে সব না করে চোখ-কান বন্ধ করে
বসে থাকল।
আমিরশাহিতে আইপিএলের সময় ‘জিপিএস ট্র্যাকার’ গলায় ঝুলিয়ে রাখতে হত সব দলের ক্রিকেটার, সদস্যদের। তা দিয়ে সারা ক্ষণ নজর রাখা যেত, কে কোথায় যাচ্ছে, কেউ কোনও ভাবে বলয় ভাঙছে কি না। কেউ যদি নির্দিষ্ট সীমানা অতিক্রম করে বলয়ের বাইরে পা রাখত, তা হলেই ‘জিপিএস ট্র্যাকার’ তা শব্দ করে জানান দিত। মেডিক্যাল অফিসারদের কাছে সঙ্কেত পৌঁছে যেত তৎক্ষণাৎ। এ বারে যে ভারতীয় সংস্থাকে নিযুক্ত করা হয়েছিল, তাদের দেওয়া ‘জিপিএস ট্র্যাকার’ অনেক ক্ষেত্রেই কাজ করছিল না বলে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। একাধিক ফ্র্যাঞ্চাইজি থেকে জানা গিয়েছে, এই যন্ত্র অনেক সময় বিভ্রান্তিকর তথ্য দিচ্ছিল। আরও ভয়ের কথা শোনা গেল যে, কেউ কেউ যন্ত্রটি ব্যবহার করাই বন্ধ করে দিয়েছিলেন। জৈব সুরক্ষার বেলুন যে ফুটো হয়ে গিয়েছে, তাতে আর আশ্চর্যের কী!
কোভিডের ‘হটস্পট’ ছ’টি শহরে আইপিএল করার সিদ্ধান্তেও আগাগোড়া অনড় রইলেন বোর্ড কর্তারা। দিল্লি, মুম্বই, চেন্নাই, বেঙ্গালুরু, আমদাবাদ এবং কলকাতা— কোভিড সুনামি চলা এই ছ’টি শহরে আইপিএল করার সিদ্ধান্ত একদিকে যেমন অমানবিক, তেমনই চূড়ান্ত অপেশাদারিত্বের পরিচয়। দিল্লিতে যখন তীব্র অক্সিজেন সঙ্কট, হাসপাতালে বেড নেই, তখন সেখানে খেলা হচ্ছে। দিল্লির ক্রিকেটারদের মনের অবস্থা কী হতে পারে? চেন্নাইয়ে ঘরের মাঠে খেলে চলেছেন অশ্বিন, তাঁর পরিবারে তখন দশ সদস্য কোভিড আক্রান্ত। অথচ তিনি পড়ে আছেন দলের হোটেলে! শেষ পর্যন্ত আইপিএল ছেড়ে যেতে বাধ্য হলেন অশ্বিন। আর অপেশাদারিত্বের নমুনা? বেশি শহরে খেলা হওয়া মানেই যে বার-বার উড়ানে করে ভ্রমণ করার ঝক্কি আর তাতে কোভিড সংক্রমণের সম্ভাবনা অনেক বেশি, তা বুঝতে তো ফেলু মিত্তির হওয়ার দরকার পড়ে না! মুম্বইয়ে মাঠের কর্মীরা কোভিড আক্রান্ত জেনেও বোর্ড বেপরোয়া, ওয়াংখেড়েতেই ম্যাচ হবে। দিল্লিতে পিচ-কর্মীদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়েছে শুনে বলা হল, ওঁরা গত দু’টি ম্যাচে কাজে নিযুক্ত ছিলেন না! দৈত্যের সামনে চোখ বন্ধ করে রাখলেই তো আর দৈত্য আক্রমণ করবে না, এমন নয়।
অহেতুক ঝুঁকিও নিয়েছে কেউ কেউ। যেমন কলকাতা নাইট রাইডার্স। তারা প্রথম তিনটি ম্যাচ খেলেছিল চেন্নাইয়ে। অথচ প্রাক-আইপিএল মহড়ার জন্য তাঁবু ফেলল মুম্বইয়ে। সেই সময় মুম্বইয়ের পরিস্থিতি বেশ উদ্বেগজনক। নাইটদের দল পরিচালকদের না হয় আজগুবি সব সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে ‘সুনাম’ আছে। কিন্তু এমন অযৌক্তিক ভ্রমণ-সূচি পাশ করাই বা হবে কেন? সবার প্রথমে আক্রান্ত হওয়ার খবর এল নাইট রাইডার্স শিবির থেকেই। তার পর চেন্নাই, তার পর হায়দরাবাদ, দিল্লি। স্থগিতই করে দিতে হল আইপিএল।
এক বছর আগে কোভিডের প্রথম মারণ স্রোতের সময় ইটালীয় সাংবাদিকের সেই প্রবল জনপ্রিয় উক্তিটা আবার মনে পড়ে গেল, ‘‘যখন পৃথিবীশুদ্ধ সকলের স্বাস্থ্য সুরক্ষা সঙ্কটে, তখন স্বাধীনতার অর্থ— ডাক্তারি নির্দেশিকা মেনে চলা!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy