ময়াঙ্ক আগরওয়াল। নায়ক হতে হতেও যিনি হয়ে উঠলেন ট্র্যাজিক হিরো। ছবি টুইটার থেকে নেওয়া।
অতলান্ত খাদের মুখে দাঁড়িয়ে মরিয়া লড়াই। একক সংগ্রামে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়ানো। দলকে জয়ের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া। এবং তার পর আচমকাই জঘন্য শটে উইকেট ছুড়ে দেওয়া। যার পরিণতিতে মুঠো থেকে জয় বেরিয়ে গিয়ে ‘টাই’। এবং তার পর সুপার ওভারে হার। যার দায় কোনও ভাবেই এড়াতে পারেন না তিনি— ময়াঙ্ক আগরওয়াল।
এটা ঘটনা যে, রবিবার রাতে দুবাইয়ে নায়ক হয়ে ওঠার সব মশলা মজুত ছিল তাঁর ব্যাটিংয়ে। কিন্তু মুহূর্তের ভুলে ম্যাচ জিতিয়ে ফিরতে পারলেন না। ছয় মেরে ম্যাচ শেষ করার চেষ্টায় ফুলটস জমা দিলেন অফে বৃত্তের বাইরে থাকা একমাত্র ফিল্ডারের হাতে। দুরন্ত ইনিংসে লেগে গেল ম্যাচ হেরে ফেরার কালির ছিটে। ‘ট্র্যাজিক হিরো’ হয়ে মাঠ ছাড়তে হল।
সুনীল গাওস্করের মতে মার্কাস স্টোয়নিসের বলে ‘গ্লোরি শট’ মারতে যাওয়াই কাল হল ময়াঙ্কের। অনায়াসেই খুচরো ১ রান নিয়ে ম্যাচ শেষ করতে পারতেন। কিন্তু তুলে মারতে গিয়েছিলেন। বিশেষজ্ঞদের কারও কারও মতে, এটা একেবারে ‘ব্রেনফেড’। যে শব্দ কয়েক বছর আগে ভারত সফরে আসা অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক স্টিভ স্মিথের মুখে শোনা গিয়েছিল। প্রাক্তন অজি ক্রিকেটার ডিন জোন্সের মতে, মানসিক ক্লান্তি বা শারীরিক ক্লান্তি যে কারণেই হোক না কেন, ওই শট মারার সময় নিশ্চিত ভাবেই ‘ব্রেনফেড’ ছিলেন ময়াঙ্ক। সঞ্জয় মঞ্জরেকরের মতে, এই ধরনের পরিস্থিতিতে অতীতে পড়েননি বলেই পেশাদারিত্বের সঙ্গে তা সামলাতে পারেননি ময়াঙ্ক। বিরাট কোহালির মতো কেউ থাকলে তুলে মারার পথে যেতেনই না।
আরও পড়ুন: আম্পায়ারের ‘ওয়ান শর্ট’ রানের সিদ্ধান্তে শুরু বিতর্ক
ময়াঙ্ক কেন ওই শটটা নিলেন? ছোটবেলার কোচ আরএক্স মুরলীধরও ব্যাখ্যা খুঁজছেন। আনন্দবাজার ডিজিটালকে সোমবার তিনি বললেন, “ওকে যতটা চিনি, তাতে নিশ্চিত করেই বলতে পারি, যে তুলে মারতে ও চায়নি। ও জানত, শেষ ৩ বলে মাত্র ১ রান করতে হবে। ফাঁকায় ঠেলে একটা রান নিলেই হয়ে যাবে। আমি নিশ্চিত ও মানসিক ভাবে সেটাই করতে চাইছিল। যে শটে ও আউট হল, তা কতটা মারতে চেয়েছিল তা নিয়ে আমার সংশয় রয়েছে। ও যদি তুলেই মারতে চাইত, তা হলে মাঠ পার করে দিত। ও কিন্তু পুরো শট খেলেনি। পুরো জোরের সঙ্গে মারেনি। নির্ঘাত ১ রানের জন্যই চেষ্টা করতে গিয়েছিল। কিন্তু ব্যাটটা ও ভাবে চালিয়ে ফেলেছে। তবে বাস্তবটা মেনে নিতেই হবে যে, ওই ১টা রান করে মাঠ ছাড়তে পারেনি।”
ধোনির মন্ত্রেই ইনিংস গড়েছেন ময়াঙ্ক। ছবি টুইটার থেকে নেওয়া।
কিংস ইলেভেন পঞ্জাব শিবিরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ম্যাচ জিতিয়ে না ফেরার গ্লানিতে আচ্ছন্ন ময়াঙ্ক। ঘনিষ্ঠ মহলে সেই হতাশা এবং যন্ত্রণার কথা প্রকাশও করেছেন। যাবতীয় প্রতিকূলতা টপকে জয়ের স্টেশনের কাছে দলকে নিয়ে আসার পরও এ ভাবে বেলাইন হয়ে পড়া হজম হচ্ছে না তাঁর। ময়াঙ্ককে নিয়ে আরও একটা বিস্ময় তৈরি হয়েছে। কেন সুপার ওভারে তাঁকে নামতে দেখা গেল না। আউট হয়ে ফেরার পরও কয়েক মিনিট সময় ছিল। ক্লান্তি অপনোদনের জন্য। জোন্স যেমন বলেছেন, উইকেটের গতির সঙ্গে পরিচিত হওয়া ছাড়াও সদ্য কাগিসো রাবাদাকে খেলার অভিজ্ঞতাও কাজে আসত ময়াঙ্কের। আরেক প্রাক্তন, অজিত আগরকরেরও মনে হয়েছে, সুপার ওভারে লোকেশ রাহুল-নিকোলাস পুরান জুটি নয়, পঞ্জাবের প্রয়োজন ছিল ময়াঙ্কের। এর উত্তর অবশ্য নেই ময়াঙ্কের কোচের কাছেও। তবে তাঁর কাছে জানা গেল ছাত্রের এত পরিণত ইনিংস খেলার রহস্য। ১৫৮ রানের জয়ের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে এক সময় ১০ ওভারে ৫৫ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে ধুঁকছিল প্রীতি জিন্টার দল। মনে হচ্ছিল, স্টোয়নিসের ধুমধাড়াক্কাই তফাত গড়ে দিয়েছে। ময়াঙ্ক তা ভাবেননি। তখন তিনি চলছিলেন লোকাল ট্রেনের গতিতে। ২০ বলে মাত্র ১৩। সেই তিনি শেষ পর্যন্ত থামলেন ৬০ বলে ৮৯ রানের বিস্ফোরক ইনিংস খেলে। ৭টি চার ও ৪টি ছয় দিয়ে সাজানো ইনিংসের স্ট্রাইক রেট প্রায় দেড়শো!
ময়াঙ্কের কোচ মুরলীধর বললেন, “আইপিএলের আগে আমরা প্রচুর খেটেছি। ওকে গতে বাঁধা অনুশীলন করাইনি। জোর দিয়েছি চাপের মুখে রান করার দিকে। ওকে ম্যাচ পরিস্থিতিতে ফেলে প্র্যাকটিস করিয়েছিলাম। যেমন, রান তাড়া করার সময় শেষ ৬ ওভারে ৫৮ রান চাই, এমন অবস্থায় নেটে ব্যাটিং করানো।। প্রথম ৬ ওভারের পাওয়ার প্লে-র সময় কী ভাবে এগোতে হবে, সেটা নিয়েও অনেক সময় খরচ করেছি। নতুন বলে ১২ বলে ৪৫ করে ফিরব, এমন মানসিকতা যেন না থাকে, সেটা বার বার বুঝিয়েছি। বলেছি, ম্যাচটাকে শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে। শুরুতে ঝুঁকির রাস্তায় না গিয়ে আস্তে আস্তে রানের গতি বাড়াতে। ধরা যাক শেষ ৩০ বলে ৪৬ রান বাকি। এমন তো নয় যে, ১ ওভারেই ওই রানটা উঠে আসবে। তাই লক্ষ্যের কাছাকাছি পৌঁছতে হবে।”
আরও পড়ুন: আজ অবধি আইপিএলে এই বোলারের রহস্যভেদ করতে পারেননি বিরাট
মানে সেই মহেন্দ্র সিংহ ধোনির পেটেন্ট নেওয়া রান তাড়ার নীতি। যার সারমর্ম, গভীরে যাও। ম্যাচকে শেষ পর্যন্ত টানতে থাকো। তার পর বোলারকে চাপে ফেলে দাও নকআউট পাঞ্চে। ময়াঙ্কের কোচ তা মেনেও নিলেন। বললেন, “ইয়েস, টেক দ্য ম্যাচ ডিপ। লড়াইয়ে থাকতে হবে শেষ পর্যন্ত। আর ধোনি যা বলেছে, সেটাই ঠিক। তখন চাপ বোলারের উপরেও থাকে। দু’পক্ষই যখন টেনশনে, তখনই ব্যাটসম্যানকে সুবিধা নিতে হবে। দিল্লির মোহিত শর্মা, স্টোয়নিসরাও কিন্তু মারাত্মক চাপে ছিল শেষের দিকে। স্টোয়নিসের কপাল ভাল যে ময়াঙ্ক আউট হওয়ার পর শেষ বলে জর্ডনের শট স্কোয়ার লেগে রাবাদার হাতে চলে গিয়েছিল। শটটা ১ মিটার এদিক-ওদিক হলেই জিতে যেত পঞ্জাব।”
অন্য প্রান্তে ক্রমাগত উইকেট পড়তে থাকা অবস্থায় দলকে একাই টানার এহেন ইনিংস ময়াঙ্কের কেরিয়ারে নতুন। এমন নয় যে, আইপিএলের দুনিয়ায় তিনি আগন্তুক। বরং এর আগে ৭৭ ম্যাচ খেলে ফেলেছিলেন কোটিপতি লিগে। সর্বোচ্চ রান ছিল ৬৮। মাত্র ৫ বার পেরিয়েছিলেন ৫০ রানের গণ্ডি। আর এ বার গোড়াতেই দায়িত্বশীল ৮৯। ছাত্রের রূপান্তরের নেপথ্যে কী? মুরলীধরের মতে, “আসল হল নিজের প্রতি বিশ্বাস। যে, আমি পারব। আগে ও কম বলে বেশি রানের টার্গেট দেখলে উল্টোপাল্টা শট খেলে ফেলত। এখন ৬ ওভারে ৬০ রান করতে হলে ও জানে যে, প্রত্যেক ওভারে ১টা বাউন্ডারি আর ৫টা সিঙ্গলসেও কাজ চলবে। লক্ষ্যকে ছোট ছোট টার্গেটে ভেঙে ফেলা, পরের বলে মনসংযোগ রাখা আর মারাত্মক চাপেও ফোকাস না হারানোর চেষ্টা চালিয়েছে ও। ব্যাপারটা থিওরিতে সহজ। বাস্তবে কিন্তু নয়!”
বাস্তবের ২২ গজে যে সেটা কত কঠিন, সেটাই প্রতিফলিত শেষ ওভারের ফুলটসে ময়াঙ্কের আউটেই!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy