আমিরশাহিতেও আরসিবি অধিনায়ককে কি এমনই দিশেহারা দেখাবে? —ফাইল চিত্র।
এমনিতে সাফল্যেই বরাবরের অধিকার তাঁর। ধারাবাহিকতাই মূলধন। ব্যাটসম্যান বা নেতা— দেশের হয়ে একের পর পর শৃঙ্গ জয় করেছেন। তিন ফরম্যাটেই বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যানদের তালিকায় তিনি। শুধু ব্যাট হাতেই নয়, নেতৃত্বের মুকুট মাথায়ও তিনি ঝলমলে। টেস্ট ক্রিকেটে জয়ের হার ৬০ শতাংশ। পাঁচদিনের ফরম্যাটে দেশের সফলতম অধিনায়ক। ওয়ান ডে ফরম্যাটেও নেতা হিসেবে উজ্জ্বল। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটেও রেকর্ড ঈর্ষণীয়। অথচ, সেই ফরম্যাটের কোটিপতি লিগে বিরাট কোহালির কোনও ট্রফি নেই।
আইসিসি টুর্নামেন্টেও অবশ্য ট্রফি নেই তাঁর। গত বছর ইংল্যান্ডে ওয়ান ডে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে হেরেছেন। বিলেতেই চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে হারতে হয়েছে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের কাছে। যদিও এমন একটা-দুটো ম্যাচ ছাড়া সব ফরম্যাটেই তেরঙা পতাকা তুলে ধরেছেন তিনি। উপহার দিয়েছেন গর্বের সব মুহূর্ত।
কিন্তু আইপিএলে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরের অধিনায়ক হিসেবে তাঁকে বিবর্ণ দেখাচ্ছে। পরিসংখ্যানে যা আরও ক্যাটক্যাটে হয়ে উঠছে। এ বারের আইপিএলে প্রথম বার নেতৃত্ব দিতে তৈরি লোকেশ রাহুলকে বাদ দিলে সমস্ত অধিনায়কের মধ্যে জেতার হারে কোহালির স্থান তলানিতে। ২৯ ম্যাচে নেতৃত্ব দেওয়া রাজস্থান রয়্যালসের অধিনায়ক স্টিভ স্মিথের জয়ের হার সবচেয়ে বেশি। ৬৫.৫ শতাংশ। ১৭৪ ম্যাচে নেতৃত্ব দেওয়া মহেন্দ্র সিংহ ধোনির৫৯.৮ শতাংশ। আইপিএলের সফলতম অধিনায়ক, মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের রোহিত শর্মা নেতৃত্ব দিয়েছেন ১০৪টি ম্যাচে। জয়ের হার ৫৭.৭ শতাংশ। সানরাইজার্স হায়দরাবাদের ডেভিড ওয়ার্নারের ৫৫.৩ শতাংশ। এমনকি, মাত্র ২৪ এবং ৩৬ ম্যাচে নেতৃত্ব দেওয়া যথাক্রমে দিল্লি ক্যাপিটালসের শ্রেয়াস আইয়ার ও কলকাতা নাইট রাইডার্সের দীনেশ কার্তিকের জয়ের হারও বেশি। শ্রেয়াসের ৫৪.২ শতাংশ। কার্তিকের ৪৭.২ শতাংশ। সেখানে কোহালির জয়ের হার ৪৪.৫ শতাংশ। অথচ, অধিনায়ক হিসেবে ধোনির পরই সবচেয়ে বেশি, ১১০টি ম্যাচে টস করতে নেমেছেন তিনি। কিন্তু তার অর্ধেক ম্যাচও জেতেননি!
আরও পড়ুন: ‘শাহরুখ নিয়ে আমার ভাল স্মৃতি নেই’, প্রথম আইপিএলের বিস্ফোরক স্মৃতিচারণে প্রাক্তন সিএবি প্রেসিডেন্ট
অথচ, ব্যাটসম্যান কোহালি যথারীতি এক নম্বর ভরসা হয়ে উঠে টেনেছেন দলকে। ফ্র্যাঞ্চাইজির তরফেও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, অধিনায়ক হিসেবে তিনিই যোগ্যতম। তবু একটা অস্বস্তি রয়েই গিয়েছে। তা মেনেও নিচ্ছে আরসিবি অধিনায়কের ঘনিষ্ঠ মহল। ছোটবেলার কোচ রাজকুমার শর্মা যেমন। কোহালির সঙ্গে যাঁর সম্পর্ক নিছক গুরু আর ক্রিকেট-শিক্ষার্থীর রুটিন পথে এগোয়নি। বরং তা অনেক গভীর। মাঠে যত ডাকাবুকোই দেখাক, কোহালির কাছেও কোচের জায়গাটা পরম শ্রদ্ধার। নইলে এই সেদিনও শিক্ষকদিবসে রাজকুমারের সঙ্গে ছবি পোস্ট করে কোহালি টুইট করতেন না, ‘চলার পথে একজন শিক্ষকের থেকে অনেক মহামূল্যবান পরামর্শ মেলে। আমার কোচের থেকে পাওয়া শিক্ষাগুলোর জন্য আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব’। এবং সেই কোচের গলাও গম্ভীর। আনন্দবাজার ডিজিটালকে রাজকুমার বললেন, “বিরাটের কাছে এটা বাড়তি গুরুত্বের। আরসিবি এক বারও চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। এ বার তাই জেতার জন্য ওরা মরিয়া। আর বিরাটকে খুব আত্মবিশ্বাসীও লাগছে। ও ভাল ভাবে তৈরি হয়ে নামছে। আরসিবি দলটাতেও ভারসাম্য আছে বলে মনে হচ্ছে। আমার তো আশা, এ বার খুব ভাল খেলে ব্যাঙ্গালোর ট্রফি জেতার প্রবল দাবিদার হয়ে উঠবে।”
এক ফ্রেমে গুরু-শিষ্য। শিক্ষক দিবসে রাজকুমার শর্মার সঙ্গে নিজের এই ছবি টুইট করেছিলেন কোহালি।
আইপিএলে অধিনায়ক কোহালির ট্রফি-খরার রহস্য কী?
প্রাক্তন ক্রিকেটারদের একাংশ মনে করেন, বাকিদের থেকে সেরাটা বার করে আনার ক্ষেত্রে কোথাও একটা সীমাবদ্ধতা থেকে যাচ্ছে। অনেকের মতে, অধিনায়ক হিসেবে স্কোয়াডের সঙ্গে তাঁর আরও সময় কাটানো দরকার। বিশেষত, অন্যান্য দলের ভারতীয় ক্রিকেটারদের শক্তি-দুর্বলতার ভাল রকম আন্দাজ তাঁর থাকা প্রয়োজন। যাতে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ভরসা রাখা যায় স্থানীয়দের উপর। রাজকুমার অবশ্য বলছেন, “আইপিএল একেবারে অন্য ফরম্যাট। এখানে দলগুলোর চেহারা আলাদা। জাতীয় দলের সঙ্গে কোনও মিল নেই। অন্য দেশের ক্রিকেটারদের নিয়ে দল গড়া হয়। অনেক ক্ষেত্রেই কম্বিনেশন ঠিকঠাক হয়নি। ফলে বিরাটের উপর নির্ভরতা প্রচণ্ড বেশি। বাকিদেরও তো অবদান রাখতে হবে। এ বার আইপিএল জিততে হলে কিন্তু একা বিরাটের উপর নির্ভর করলে চলবে না।”
রোহিত চারবার জিতেছেন আইপিএল। ধোনি তিনবার। গৌতম গম্ভীর দু’বার। কিন্তু, কোহালি এখনও খাতাই খুলতে পারেননি। আমিরশাহিতে এই তথ্য কি তাঁর মনে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-সংশয়ের জন্ম দিতে পারে প্রবল টেনশনের মুহূর্তে! কোহালির কোচের কথায়, “ও হয়তো এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকবে না। তবে সব ক্যাপ্টেনই তো জিততে চায়। কে আর হারতে মাঠে নামে! এত বড় দল নিয়ে সব ফ্র্যাঞ্চাইজিই ট্রফি পেতে চায়। কোহালির ক্ষেত্রেও সেটা অন্যরকম কেন হবে? আমি অবশ্য আশা করি, আরসিবি এ বার দারুণ খেলবে আর বিরাটের হাতে ট্রফি উঠবে।”
আরও পড়ুন: ‘আইপিএলে ভাল করলে তা লোকের চোখে পড়বেই’
ঘটনা হল, শুধু নেতা কোহালিই নয়, মরুদেশে ব্যাটসম্যান কোহালির উপরও চাপ থাকার কথা। কোভিড-আতঙ্ক আর লকডাউনের আগে নিউজিল্যান্ডে দুই টেস্টের সিরিজে তাঁর ব্যাটে এসেছিল মোটে ৩৮ রান। গড় ১০-ও স্পর্শ করেনি। ২০১৭ সালে ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজে তাঁর গড় ছিল আরও কম। ৯.২০। এমন বিপর্যয় কোহালির টেস্ট জীবনে আরও একবার এসেছিল। ২০১৪ সালের ইংল্যান্ড সফরে। যেখানে পাঁচ টেস্টের ১০ ইনিংসে করেছিলেন ১৩৪। গড় ছিল ১৩.৪০।
নিউজিল্যান্ড সফরের ব্যর্থতা প্রভাব ফেলবে না তো কোহালির ব্যাটিংয়ে? —ফাইল চিত্র।
আইপিএল তাই ব্যাট হাতেও ছন্দে ফেরার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে কোহালিকে। কোচ যদিও ভরসাই রাখছেন ছাত্রের উপরে। বললেন, “দুশ্চিন্তা বা উদ্বেগের কোনও কারণ নেই। একটা-দুটো ম্যাচে এমন ঘটতেই পারে। কিন্তু এটা ভুললে চলবে না যে তিন ফরম্যাটে ৫০-এর উপরে গড় একমাত্র ওরই আছে। তাই চিন্তা নেই। অনেক মেহনত করে ও আইপিএল খেলতে গিয়েছে। কোনও চাপের ব্যাপার নেই।” টেকনিক্যাল কোনও সমস্যা? কোচের সওয়াল, “টেকনিক্যালি কোনও সমস্যা নেই। ও খুব ভাল ফর্মে রয়েছে। নেটে দারুণ ব্যাট করছে। যথাযথ প্রস্তুতি নিয়েই গিয়েছে। আর আন্তর্জাতিক স্তরে নিজেকে যে পর্যায়ে ও তুলে নিয়ে গিয়েছে, তাতে এখন আর খুব একটা কিছু বলতে হয় না। নিজেই বুঝতে পারে কী করতে হবে।”
কোহালির পক্ষে কতটা কঠিন হতে চলেছে লকডাউন পরবর্তী কেরিয়ার? কোচ আবার শোনালেন আস্থার কথা, “এরা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার। পেশাদারও। এরা মানিয়ে নিতে পারে। খুব তাড়াতাড়ি মানিয়েও নেয়। অস্ট্রেলিয়ায় আগের সফরে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স ছিল ভারতের। এ বার মানসিক দিক দিয়ে নিশ্চয়ই চাঙ্গা থাকবে দল। আগের বার ওদের হারানোর সুখস্মৃতি নিশ্চয়ই সঙ্গী হবে দলের। আমার তো আশা, বিরাটরা চমৎকার ক্রিকেট উপহার দেবে।”
আরও পড়ুন: ‘কলকাতা আমার, ইডেন আমার, কিন্তু কেকেআর কখনওই আমার নয়’
করোনা অতিমারি কেড়ে নিয়েছে কয়েক মাসের ক্রিকেট। ফেব্রুয়ারি-মার্চের পর আবার ডিসেম্বরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে দেখা যাবে ভারতকে। কার্যত, একটা বছরই গায়েব হয়ে গেল কোহালিদের কেরিয়ার থেকে। এটা কতটা ছন্দপতন? এর ফলে কি সচিন তেন্ডুলকরের রেকর্ড ভাঙার দৌড়ে খানিক পিছিয়ে পড়লেন কোহালি? রাজকুমারের কণ্ঠে এ বার তীব্র প্রতিবাদ, “বিরাট কোনওদিনই রেকর্ডের কথা মাথায় নিয়ে খেলে না। ও সবসময় টিম ইন্ডিয়ার সাফল্য চায়। নিজের কীর্তির কথা মাথায় নিয়ে ব্যাট করতে যায় না। আর কোভিড তো বিশ্বব্যাপী একটা সমস্যা। এর বিরুদ্ধে কারওরই কিছু করার ছিল না। তাই এটা নিয়ে ভাবার কিছু নেই। ভেবে লাভও নেই।” কিন্তু, এই কয়েক মাসের রান তো হারালেন কোহালি? বাস্তবে থাকতে চাওয়া কোচের যুক্তি, “পুরো বিশ্বই তো থমকে ছিল। এমন তো নয় যে, বিরাটের চেয়ে বাকিরা এগিয়ে গিয়েছে। এটাও নয় যে বাকিরা খেলছিল। একমাত্র বিরাটই খেলতে পারেনি। যা হয়েছে, তা সকলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। দুনিয়া যে ভাবে চলছে, সে ভাবেই তো চলতে হবে। মনে হয় না, বিরাটের ক্ষেত্রে এটা কোনও সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy