স্নেহশীল: তাঁর বাগানে এ ভাবেই ঘোরে নানা পোষ্য। এমনই এক পোষ্যের সঙ্গে অরুণ লাল। শুক্রবার রাজকোট রওনা হওয়ার আগে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
‘টাইগার’ লাল। শুধু বাংলা নয়, এ ভাবেই তাঁকে ডাকে ভারতীয় ক্রিকেট মহল। এমন হার-না-মানা যোদ্ধা যে খুব কমই দেখা গিয়েছে! কী ক্রিকেটের বাইশ গজে, কী জীবনের ময়দানে! বাংলার কোচ হিসেবে দ্বিতীয় ইনিংসে দল তেরো বছর পরে রঞ্জি ফাইনালে। সোমবার থেকে শুরু সেই ফাইনালের জন্য শুক্রবার, নজর আলি লেনের বাড়ি থেকে বেরিয়ে বিমানবন্দর যাওয়ার পথে অরুণ লাল গাড়ির মধ্যে বসে একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন আনন্দবাজারকে। আজ প্রথম পর্ব...
প্রশ্ন: অভিজ্ঞতার সঙ্গে তারুণ্য মিশিয়ে টিম বাংলা গড়লেন কী ভাবে?
অরুণ লাল: ছেলেদের একটাই কথা বলেছিলাম। তোমরা সকলে সমান। কেউ বাংলার হয়ে একশো ম্যাচ খেলে থাকতে পারো এর আগে। কেউ প্রথম ম্যাচ খেলতে নামছ। টিমের কাছে দু’জনে একদম সমান। সেখানে কোনও সিনিয়র-জুনিয়র বাছবিচার নেই। নতুনকে যেমন রান করতে হবে, তোমাকেও করতে হবে। নবাগতকে যেমন উইকেট নিতে হবে, তোমাকেও নিতে হবে। তোমার অভিজ্ঞতা আছে, নতুনের আছে তারুণ্য। তোমার হয়তো ক্রিকেট জ্ঞান বেশি আছে, নতুনের আছে উদ্দীপনা, এনার্জি, ফিটনেস, ছটফটানি। কেউ বিশেষ সমাদর পাবে না। সবাই সমান।
প্র: বাস্তবে এই মন্ত্র প্রয়োগ করা কতটা কঠিন ছিল?
অরুণ: শুরুর দিকে কিছু সমস্যা হয়েছে। তার পরে কিন্তু আস্তে আস্তে লোকে বুঝতে পেরেছে যে, এর মধ্যে ব্যক্তিগত কোনও অভিসন্ধি নেই। টিমের ভাল এবং একমাত্র টিমের ভালই চাওয়া হচ্ছে। আমি ভুল করতে পারি কিন্তু আমার কোনও অভিসন্ধি নেই। কী করে থাকবে, বাংলা দলের এই ছেলেরা প্রত্যেকে আমার ছেলের মতো। সকলে সেটা আস্তে আস্তে বুঝতেও পেরেছে যে, এ লোকটা টিমের ভালর জন্যই এ সব করছে। আমি একটা জিনিস ঠিক করে নিয়েছিলাম যে, নিজের ফর্মুলায় দলটা চালাব। অন্যরা কেউ যখনই আমাকে বলতে এসেছে, এটা ঠিক হচ্ছে না, আমি তাই তাদের বলে দিয়েছি, ভাই, আমি চলে গেলে তো তোকেই কোচ করবে সিএবি। তখন তুই তোর মতো চালাস না। যত ক্ষণ আমি কোচ আছি, আমার ফর্মুলাই চলবে।
প্র: ফাইনালে ওঠার এই যাত্রাকে কী ভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
অরুণ: একটা কথা কী জানেন তো, পাঁচ দিনের ক্রিকেটে ম্যাচ জেতায় বোলাররা। ওয়ান ডে ক্রিকেট ব্যাটসম্যানদের দাপটে জিততে পারবেন। টি-টোয়েন্টি জিততে পারবেন। কিন্তু টেস্ট ম্যাচ বা চার অথবা পাঁচ দিনের খেলায় সফল হতে গেলে ভাল বোলিং লাগবেই। বলছি না, ব্যাটিং দরকার নেই। একটা ভদ্রস্থ রান তো তুলতেই হবে, না হলে বোলাররা কী নিয়ে লড়াই করবে! কিন্তু সব চেয়ে দরকারি কথাটা হচ্ছে, চার বা পাঁচ দিনের ম্যাচে প্রতিপক্ষকে দু’বার আউট করতে হবে। আমার মনে হয় এই মুহূর্তে আমাদের বোলিং আক্রমণ দেশের মধ্যে সেরা।
প্র: বলছেন, দেশের সেরা বোলিং?
অরুণ: ইয়েস, সেরা বোলিং। কাদের ফাস্ট বোলিং বিভাগ আমাদের চেয়ে ভাল, কেউ এসে আমাকে দেখিয়ে দিক। কী ফিটনেস এনে ফেলেছে আমাদের ফাস্ট বোলাররা! পোড়েলকে (ঈশান পোড়েল) দ্যাখো, উফ্! আমার তো মনে হয়, ও ভারতের হয়ে খেলার জন্য তৈরি। অন্য দু’জন মুকেশ আর আকাশ দীপ ভারতীয় ‘এ’ দলে খেলার জন্য তৈরি। ওরা কেউ সাধারণ বোলার নয়, অবিশ্বাস্য সব ডেলিভারি করতে পারে। কর্নাটকের বিরুদ্ধে মুকেশ যে স্পেলটা করেছে, এ বছরে রঞ্জি ট্রফিতে ক’জন পেস বোলার ও রকম স্পেল করতে পেরেছে? আমাকে এসে বুঝিয়ে দিয়ে যাক না কেউ। আর মুকেশ ওই স্পেলটা করতে পেরেছে কারণ সেরা ফিটনেসে নিজেকে নিয়ে গিয়েছে।
প্র: ফিটনেস এনেই ধারাবাহিকতা এসেছে বোলারদের মধ্যে?
অরুণ: একদমই তাই। আগে তিনটে ভাল বল করে একটা লেগসাইডে দিয়ে দিত আমাদের বোলাররা। ফলে ব্যাটসম্যানের উপরে যে চাপটা তৈরি হল প্রথম তিন বলে, সেটা নিজেই আলগা করে দিলাম আর একটা বাউন্ডারি খেয়ে গেলাম। এখন আমাদের বোলাররা আলগা বল-টল দেয় না। আয় ব্যাটসম্যানেরা, খেটে খা দেখি। হয়তো গোটা একটা স্পেলে একটা আলগা বল দিয়ে ফেলল। সেই কারণে প্রত্যেকটা টিম ব্যাট করতে নেমে আমাদের বিরুদ্ধে শ্বাসকষ্টে ভুগেছে। আর একটা ব্যাপার খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের পেস বোলারদের অস্ত্র কিন্তু সুইং নয়। সুইং ওরা করায় বল পুরনো হলে। রিভার্স সুইং। কিন্তু নতুন বলে আমাদের ফাস্ট বোলারদের সিমের ব্যবহার দেখবেন। আহা! চোখ জুড়িয়ে যাওয়ার মতো শিল্প আয়ত্তে এনেছে ওরা তিন জন।
প্র: কী ভাবে বাংলার পেসাররা শিকারে যায়, আপনার মুখে শুনি...
অরুণ: জাস্ট অসাধারণ! তিনটে বল সোজা যাবে, একটা দুম করে বাইরে চলে গেল, একটা দ্রুতগতিতে ভিতরে ঢুকে এল। কী করবি তুই ব্যাটসম্যান? সেই সঙ্গে এমন একটা লেংথে ওরা বল করে যাবে যে, ঠাওর করাই কঠিন হয়ে যায়, আগে খেলব না পিছনে! আমি তো বোলারদের কীর্তি দেখে ব্যাটসম্যান হয়েও হাসি! মনে হয় কতগুলো জাদুকর মাঠে নেমে ব্যাটসম্যানদের গোলকধাঁধায় পুরে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে! আমি দিন দুই আগেই হঠাৎ আবিষ্কার করলাম, কোনও টিমই গোটা মরসুমে এখনও পর্যন্ত আমাদের বিরুদ্ধে আড়াইশো রান তুলতে পারেনি! যেখানে রঞ্জি ট্রফি সকলে বলত, রানের খেলা। শুনছিলাম, কর্নাটক নাকি দারুণ ব্যাটিং সাইড। ওরা নাকি ফেভারিট। আমি দু’টো কথা বলেছিলাম তখন। এক) ফেভারিট আমরা, ওরা নয়। দুই) ওদের ব্যাটিং এখনও দেশের সেরা বোলিংকে খেলেনি। তাই অপেক্ষা করে দ্যাখো কী হয়। আমাদের বোলাররা ওদের ৬৬-৬ করে দিল। তার পর যে ভাবে হারাল, সেটা তো প্রায় ঘাড় ধরে ইনিংসে হারানো। ওদের টেলএন্ডাররা দু’ইনিংসেই অনেক রান করে গেল। না হলে আরও চুনকালি মেখে ফিরত।
প্র: ছেলেদের তৈরি করার নেপথ্যে যে প্রক্রিয়া, সেটা শুনতে চাই...
অরুণ: তিন-চারটে ব্যাপার ছিল, যা শুরুতেই আমি পরিষ্কার দিতে চেয়েছি। এক) আমার কাছে টিম সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। টিমের আগে কেউ নয়, কোনও কিছু নয়। ক্যাপ্টেনও আসবে পরে, আগে টিম। দুই) ফিটনেস। এই জায়গায় আমি কোনও আপস করতে চাইনি। যখন মরসুমের আগে থেকে আমি কঠোর ফিটনেস প্রক্রিয়া শুরু করি, অনেক সমালোচনা হয়েছিল। লম্বা মরসুম রয়েছে, অরুণ লাল খেলোয়াড়গুলোকে আগে থেকেই ক্লান্ত করে দেবে। এখন দ্যাখো কী হচ্ছে। আমাদের ফাস্ট বোলারেরা ১০-১২ ওভারের স্পেল করে দিচ্ছে। এবং কোনও আলগা বল ছাড়া। ফিটনেসে উন্নতির কোনও শেষ নেই। তিন) মানসিক কাঠিন্য। এটা ‘ওয়ার্ক ইন প্রগ্রেস’। কাজ চলছে। ছেলেরা শিখরে পৌঁছচ্ছে। মিলিয়ে নেবেন আমার কথা, আগামী দু’তিনটে মরসুমের মধ্যে বাংলা মানসিক ভাবে সব চেয়ে শক্তিশালী দলগুলোর একটা হয়ে যাবে। চার) টিম স্পিরিট। আমরা দু’মাস ধরে একসঙ্গে ছিলাম। প্রত্যেক দিন দু’ঘণ্টা ধরে ট্রেনিং করেছি, তার পর দু’ঘণ্টা ধরে নেট প্র্যাক্টিস। যা আগে কখনও হয়নি। সকলে হাতে হাত মিলিয়ে পরিশ্রম করেছি। প্রচণ্ড গরমের মধ্যে হাড়ভাঙা প্র্যাক্টিস করেছে। পরিশ্রম মানুষের মনে জেদ তৈরি করে দেয়। ওই দু’মাসের ট্রেনিং আর প্র্যাক্টিসও বাংলার ছেলেদের মধ্যে প্রতিজ্ঞার জন্ম দিয়ে গিয়েছে। একরোখামি তৈরি করে দিয়ে গিয়েছে যে, পারব না আবার কী! আমাকে পারতেই হবে! আমি তৈরি!
প্র: আর কোনও বিশেষ বার্তা দেওয়ার ছিল কোচের তরফে?
অরুণ: একটা ছিল, ফলের কথা বেশি ভেবে গুলিয়ে ফেলো না। তোমরা নিজেদের দু’শো শতাংশ দাও। তাতে ফল আপনিই আসবে। লক্ষ্যটা ঠিক রাখতে হবে। আর একটা ব্যাপার বলে দিয়েছিলাম, কেউ যেন নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য বাংলার জার্সি গায়ে চাপানোর কথা না ভাবে। রঞ্জি ট্রফিতে দারুণ খেলতে হবে কারণ আমি ভারতীয় দলে ঢুকতে চাই— এ সব ভাবনাকে আমি বাংলার ড্রেসিংরুমে ঢুকতে দেব না। তোর যদি এ রকম ছক থাকে, তা হলে যা এখান থেকে। বাংলা টিমকে ছোট করতে আসিস না। যত ক্ষণ বাংলার ড্রেসিংরুমে আছি, বাংলার স্বার্থ আর রঞ্জি ট্রফির উপরে কিছু হয় না। খেলতে হলে খেল, না হলে যাও। (হাত নেড়ে) যাও, যাও, যাও। আর বাংলা দলের কথা ভেবে ভাল করে খেল, পারফর্ম কর, সারাজীবন তোর গুণগান গাইব। যেমন এই টিমের গাইছি।
প্র: অনুষ্টুপ মজুমদারের পারফরম্যান্স নিয়ে কী বলবেন?
অরুণ: অনুষ্টুপ মজুমদারের থেকে বড় ক্রিকেটার এই মরসুমে আর কেউ আছে? চৌত্রিশ বছর বয়সেও কী অসাধারণ সব ইনিংস খেলছে। রঞ্জি ট্রফিতে কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনালে ম্যাচ জেতানো বড় সেঞ্চুরি। অথচ এই ছেলেটাই প্রথম তিনটে ম্যাচে বাইরে বসেছে। এক বারও কোনও অভিযোগ করতে শুনিনি। কখনও দেখিনি ড্রেসিংরুমে মনমরা হয়ে বসে রয়েছে। উল্টে সারাক্ষণ টিমকে সাহায্য করে যাচ্ছে। সতীর্থকে ড্রিঙ্কস এগিয়ে দিচ্ছে, উৎসাহ দিচ্ছে, পরামর্শ দিচ্ছে। আর যখন ওর সামনে সুযোগ এল? এমন খেলতে শুরু করল, যা কেউ পারেনি। স্বপ্নের সব ইনিংস খেলেছে। ৪৬-৫ হয়ে গিয়েছে দল, সেখান থেকে ১৫৭ করে ম্যাচ তৈরি করে দিল। কর্নাটকের বিরুদ্ধে টিম ৬০-৬ হয়ে গিয়েছে, অনুষ্টুপ ১৪৯ নট আউট! আমাকে কেউ যদি জিজ্ঞেস করে, আপনার কাছে নায়কের ব্যাখ্যা কী? আমি অনুষ্টুপ মজুমদারের নাম নেব। বলব, দ্যাখো, এই হচ্ছে নায়ক। যেমন পারফর্মার, তেমনই অসাধারণ মানুষ!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy