অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে দ্বিতীয় টেস্ট ম্যাচ জয়ের পরে অজিঙ্ক রাহানে-কে (ডান দিকে) জড়িয়ে ধরলেন শুভমন গিল। মঙ্গলবার মেলবোর্নে। ছবি: পিটিআই।
ভারতীয় ক্রিকেটকে অনেক সোনার মুহূর্ত উপহার দিয়েছে মেলবোর্ন। ১৯৭৭-এর সফরে ০-২ পিছিয়ে থাকা অবস্থায় ববি সিম্পসনের অস্ট্রেলিয়াকে ২২২ রানে উড়িয়ে দিয়েছিলাম আমরা। যে টেস্ট বিখ্যাত হয়ে আছে ‘মেলবোর্নে চন্দ্রোদয়’ নামে। ১২ উইকেট নিয়ে একাই অস্ট্রেলিয়াকে শেষ করে দিয়েছিল চন্দ্র। ১৯৮১-তে কপিল দেবের সেই কুঁচকির অসহ্য ব্যথা উপেক্ষা করে ইঞ্জেকশন নিয়ে পাঁচ উইকেট। জেতার জন্য ১৪৩ রানের টার্গেট নিয়ে খেলতে নেমে ৮৩ রানে শেষ হয়ে যায় গ্রেগ চ্যাপেলের শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়া। ১৯৮৫-তে পাকিস্তানকে ফাইনালে হারিয়ে বেনসন অ্যান্ড হেজেস বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ জয়। গত সফরেও বিরাট কোহালিরা মেলবোর্নে টেস্ট জিতেছিল। তার সঙ্গে যুক্ত হল মঙ্গলবার অজিঙ্ক রাহানের দলের আট উইকেটের এই স্মরণীয় জয়। কী বলা যায় একে? মেলবোর্নে ভারত উদয়? না কি বলা উচিত অ্যাডিলেডের অন্ধকার পেরিয়ে মেলবোর্নে সূর্যোদয়? যা-ই বলি না কেন, এমন একটা প্রত্যাঘাত করা জয় দেখার পরে সেই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। সব ভারতীয় ক্রিকেট ভক্তের মতো আমিও বরং রাহানেদের বলি, সেরা নিউ ইয়ার গিফ্ট দিলে তোমরা!
নিছক জয় বললে তো চলবে না, ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে অন্যতম সেরা প্রত্যাবর্তন দেখলাম মেলবোর্নে। একটা দল বিধ্বস্ত হয়ে ৩৬ অলআউট হয়েছে আগের টেস্টে। দেশের ইতিহাসে সর্বকালের সর্বনিম্ন টেস্ট স্কোরের লজ্জার রেকর্ড করেছে। অধিনায়ক এবং দলের সেরা ব্যাটসম্যান ফিরে গিয়েছে। তারকা পেসার ছিটকে গিয়েছে। সেই অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে পরের টেস্ট এমন শাসকের ভঙ্গিতে জিতে নিতে সিংহহৃদয় লাগে। সৌভাগ্যের কথা হচ্ছে, ভারতীয় ক্রিকেট এখন ভয়ডরহীন এমন সব ক্রিকেটারে ভর্তি। মাঠে যে এগারো জন খেলছে, তারা তো বটেই। এমনকি, রিজার্ভ বেঞ্চে যারা রয়েছে, তারাও চমকে দিতে পারে। অভিজ্ঞতার সঙ্গে তারুণ্যের জয়গান মিশে যাচ্ছে। যেমন রাহানে, অশ্বিন, জাডেজারা অবদান রাখছে তেমনই উজ্জ্বল শুভমন গিল, মহম্মদ সিরাজের মতো নতুন মুখেরা।
ভারতীয় ক্রিকেটের সেরা জয়গুলোর একটা দেখতে দেখতে আমার এটাও মনে হচ্ছিল যে, এখন আর এক জন-দু’জনের উপরে নির্ভর করে চলে না আমাদের জাতীয় দল। যে কারও বিকল্প তৈরি রয়েছে। কোহালি না থাকলে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য রাহানে আছে। ব্যাটিংয়ে তরুণ শুভমন গিল আছে। শামির মতো শিল্পী পেসার না থাকলে সিরাজ ফুল ফোটাবে। কে বলবে, ছেলেটা জীবনের প্রথম টেস্ট খেলছে! দেখে মনে হচ্ছিল, কুড়িটা টেস্ট খেলে ফেলার অভিজ্ঞতা নিয়ে মেলবোর্নে বল করতে নেমেছে!
প্রত্যাঘাত: মেলবোর্নে অস্ট্রেলিয়াকে উড়িয়ে দিয়ে ভারতীয় দল। বিসিসিআই
অস্ট্রেলিয়া-সহ অনেক দেশের বিশেষজ্ঞরাই তো বলতে শুরু করেছিল, কোহালি নেই, ৪-০ হারবে ভারতীয় দল। তাদের মুখের উপরে যোগ্য জবাব দিয়ে দিল রাহানেরা। এই জয়ের কারিগর হিসেবে প্রথমেই বেছে নেব বোলারদের। রাহানের অধিনায়কত্ব দেখে আমি মুগ্ধ, ঠিকই। ওর সেঞ্চুরিকে অনেকেই হয়তো টার্নিং পয়েন্ট বলবে। সত্যিই, ওই ইনিংসটা না থাকলে ফের একটা ব্যাটিং বিপর্যয় ঘটে টেস্টের মোড় ঘুরে যেতে পারত। কিন্তু ভারতীয় দলকে বিদেশের মাঠে এমন দাপুটে করে তুলছে দুরন্ত বোলিং বিভাগ। শামি আর ইশান্ত শর্মার মতো অভিজ্ঞ বোলার নেই। তাতেও থামছে না গতির রথ। সিরাজ অভিষেকেই চমকে দিল, উমেশ যাদব চোট পাওয়ার আগে পর্যন্ত দারুণ বল করে গেল। উমেশকে না পাওয়া গেলে নবদীপ সাইনি তৈরি আছে। সঙ্গে অশ্বিন এবং জাডেজার মতো দুই বিশ্ব মানের স্পিনার। আমি অ্যাডিলেড থেকে বলে যাচ্ছি, অশ্বিন-জাডেজা দু’জনকেই খেলানো উচিত। জাডেজা বিশ্বের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার। ওকে নিয়ে তারকাসুলভ হইচই হয় না ঠিকই, কিন্তু যখনই সুযোগ পেয়েছে, দলের কাজে এসেছে। মেলবোর্নের এই জয়ে বিরাট ভূমিকা রয়েছে অলরাউন্ডার জাডেজার। প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের ক্রমাগত চাপে রাখছে ভারতের এই বোলিং। স্টিভ স্মিথের কথাই ধরা যাক। বিশ্বের সেরা টেস্ট ব্যাটসম্যান বলা হয় ওকে। দুর্ধর্ষ ফর্মে ছিল। কিন্তু ভারতীয় বোলারেরা ঠিক ওর দুর্বলতা বার করে ফেলেছে। অশ্বিন ওকে বোকা বানাচ্ছে, বুমরা পায়ের পিছন থেকে বোল্ড করল, যা অনেক চেষ্টা করেও কখনও কেউ পারেনি।
আমার তাই মনে হয়, এই ভারতীয় দলের প্রধান অস্ত্র বোলিং। তার সঙ্গে নিশ্চয়ই যোগ করতে হবে রাহানের ব্যাটিং এবং অধিনায়কত্ব। ঠান্ডা মাথায় দলটাকে পরিচালনা করল। মাঠে দাঁড়িয়ে আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে জানে। ফিল্ডিং সাজানো এবং বোলার পরিবর্তন দুর্দান্ত। শুভমন গিলের মধ্যে আরও এক উদিত সূর্যের কিরণ দেখতে পেলাম। তেমনই সিরাজকে নিয়ে স্বপ্ন দেখাও শুরু হবে।
এর পরে তৃতীয় টেস্ট সিডনিতে। সেখানে স্পিনারদের জন্য আরও বেশি সাহায্য অপেক্ষা করে থাকবে। আরও ভয়ঙ্কর হতে পারে অশ্বিন-জাডেজা। ভারতীয় ক্রিকেটে এখন প্রতিভার অভাব না থাকলেও তারকা-প্রথা লুপ্ত হয়নি। তাই কে এল রাহুলের চেয়ে রোহিত শর্মাকে হয়তো অগ্রাধিকার দেওয়া হবে রানের মধ্যে না থাকা মায়াঙ্ক আগরওয়ালের পরিবর্ত হিসেবে। আমি মনে করি, এক মাসের উপরে অস্ট্রেলিয়ায় কাটিয়ে ফেলা রাহুলকে খেলানো উচিত। এ নিয়েও আমার মনে কোনও সংশয় নেই যে, সিরিজ জেতার সম্ভাবনা এখন ভারতেরই বেশি। সিডনিতে যদি রাহানেরা জয় ছিনিয়ে নিতে পারে, কেল্লা ফতে! মন বলছে ওরা পারবে! দেখেই তো নিলাম, এই দলটা মুখ থুবড়ে পড়তে পারে কিন্তু নক-আউট হবে না। গা ঝাড়া দিয়ে আবার উঠেও দাঁড়াবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy