Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
কাউন্টি অভিযান সফল করতে নেপথ্যে ভূমিকা ব্র্যাডম্যান ও গাওস্করের

সচিনের ঐতিহাসিক সেই চুক্তিতে আজও উচ্ছ্বসিত ইয়র্কশায়ার

ওয়াংখেড়েতে বিদায়ী টেস্ট খেলার সময় নিজের ক্রিকেট জীবনের সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিজে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তিনি। সেই তালিকায় একটি নাম বাদ যায়নি—সোলি অ্যাডাম। তিনি নিজে তবু সেরা প্রাপ্তি ধরেন অন্য এক স্বীকৃতিকে।

স্মরণীয়: সচিনকে নিয়ে এখনও গর্বিত ইয়র্কশায়ারের মানুষ। ফাইল চিত্র

স্মরণীয়: সচিনকে নিয়ে এখনও গর্বিত ইয়র্কশায়ারের মানুষ। ফাইল চিত্র

সুমিত ঘোষ
লিডস শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০১৯ ০৪:২৪
Share: Save:

হেডিংলে স্টেডিয়াম থেকে গাড়ি করে মিনিট পঁয়তাল্লিশের পথ। সুন্দর গাছপালায় ঘেরা মনোরম পরিবেশ মেজাজটাকেই ভাল করে দিতে পারে। পূর্ব ইয়র্কশায়ারের এই জায়গাটির নাম ডিউসবারি। হালফিলে যদিও খুব মনোরম জায়গা বলে নেই। অপরাধের মাত্রা এত বেড়ে গিয়েছে যে, উদ্বেগ বাড়িয়ে ঘনঘন বেজে ওঠে সাইরেন। কখনও পুলিশ ভ্যানের, কখনও অ্যাম্বুল্যান্সের।

সাতাশ বছর আগের এক গ্রীষ্মে এখানেই এসে উঠেছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটের বিস্ময় বালক। সেই ঝাঁকড়া চুল, শিশুসুলভ মুখ আর মিষ্টি হাসি নিয়ে হাজির হয়েছিলেন কাউন্টি ক্রিকেটকে জয় করতে। ইতিহাস পাল্টে দেওয়া এক আবির্ভাব। ইংল্যান্ডের সব চেয়ে গোঁড়া এবং রক্ষণশীল কাউন্টি ক্লাব হিসেবে পরিচিত ইয়র্কশায়ার তাদের নিয়মের বই নতুন করে লিখে ফেলেছিল তাঁকে আনার জন্য।

একটা গল্পই আছে ইয়র্কশায়ার ক্রিকেট নিয়ে যে, কিশোর ছেলেকে নিয়ে সেলুনে গিয়েছেন বাবা। পাশে বসা এক বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করলেন, এ ছেলে কি ক্রিকেট খেলে? বাবা: হ্যাঁ, ওই আর কী। সবে শুরু করেছে। বৃদ্ধ: ও কি ইয়র্কশায়ারেরই ছেলে? মানে এখানেই জন্মেছে? বাবা: হ্যাঁ। বৃদ্ধ: আমার বাবা বলতেন, ইয়র্কশায়ারের হয়ে খেলতে গেলে শুধু ইয়র্কাশায়ারে জন্মালেই হবে না, স্ট্রেট ব্যাট হাতে জন্মাতে হবে।

সেই কট্টর মনোভাব ছেড়ে কী করে নিয়ম পরিবর্তন করল ইয়র্কশায়ার? তা-ও এক অ-শ্বেতাঙ্গ ক্রিকেটারের জন্য? বৃহস্পতিবার সচিনের কাউন্টি আস্তানার পাড়ায় গিয়ে অজানা সব কাহিনি শোনা গেল। ‘‘আমার সঙ্গে এক বার ফ্রেড ট্রুম্যানের দেখা হয়েছিল। ওঁকে আমি পরিষ্কারই বলেছিলাম, ইয়র্কশায়ার কাউন্টি ক্রিকেট ক্লাবের এই বাজে নিয়মটা বদলানো উচিত। জেফ বয়কটের সঙ্গে এক বার একটা ম্যাচে দেখা হল। ওঁকেও বললাম।’’ যাঁর মুখ থেকে বৃহস্পতিবার বিকেলে কথাগুলো শোনা গেল, তিনি সোলি অ্যাডাম। গুজরাতের সিমলাকে জন্ম নেওয়া এক ভারতীয়। প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে পূর্ব ইয়র্কাশায়ারে আছেন। উনিশ বছরের তেন্ডুলকরকে ইয়র্কশায়ারে নিয়ে আসার নেপথ্যে আসল কারিগর ছিলেন তিনিই। তেন্ডুলকর কাউন্টি খেলার সময়ে সেই সাড়ে চার মাস স্থানীয় অভিভাবকের কাজ করতেন সোলি অ্যাডাম।

স্মৃতি: সোলি অ্যাডাম এবং তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে সচিন এবং অঞ্জলি। নিজস্ব চিত্র

ডিউসবারিতে স্যাভিল রোডে তাঁর খেলার সরঞ্জামের দোকান। সেখান থেকে পাঁচ মিনিট দূরে তাঁর বাড়ি। চতুর্দিকে ছড়িয়ে রয়েছে আরও কিছু পেট্রল পাম্প এবং গাড়ির গ্যারাজ। এই সব জায়গা বহন করছে বিস্ময়বালকের কাউন্টি অভিযানের চিহ্ন। ‘‘তিন রুমের একটা অ্যাপার্টমেন্টে থাকত সচিন। তখন একেবারেই শিশু ও। আমি আর আমার স্ত্রী ওকে নিজের ছেলের মতোই দেখে এসেছি। ও প্রথমেই বলে দিয়েছিল, আমি খেলতে আসতে পারি কিন্তু তোমার বাড়ির আশেপাশে বাড়ি খুঁজে দিতে হবে,’’ স্পোর্টস শপে বসে বলছিলেন সোলি।

সচিনের সঙ্গে সোলি অ্যাডাম।

এর পরেই শোনালেন, সচিনের ইয়র্কশায়ারে আসা নিয়ে কী রকম নাটক হয়ে গিয়েছিল! ফ্রেড ট্রুম্যান পর্যন্ত বিদেশি আনার চরম বিরোধিতা করেছিলেন। জেফ বয়কটের উপস্থিতিতে অবশেষে ইয়র্কশায়ারের ক্রিকেট কমিটি সিদ্ধান্ত নিল, বিদেশি ক্রিকেটার আনা হবে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে ঠিক হয়ে থাকল, সেই ক্রিকেটার যেন শ্বেতাঙ্গ হয়। এশীয় কাউকে আনার কথা কেউ মাথাতেই আনেনি। কমিটি ঠিক করল একটি নাম। অস্ট্রেলীয় ফাস্ট বোলার ক্রেগ ম্যাকডারমট। তাঁরই ইয়র্কশায়ারের প্রথম বিদেশি ক্রিকেটার হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভাগ্যের এমনই পরিহাস যে, এক মাস আগে কুঁচকির চোটে সরে দাঁড়ালেন ম্যাকডারমট।

অগত্যা? ক্লাবের চেয়ারম্যান লরেন্স বাইফোর্ডের মুখ থেকে একটা বিকল্প বেরোল— সচিন তেন্ডুলকর। সেই নামটা শুনেই আসরে নেমে পড়লেন সোলি। তখন কমিটির অন্যান্যরা তীব্র আপত্তি শুরু করে দিয়েছেন। কেন এক জন এশীয়কে নিয়ে আসা হবে? সোলি তত দিনে সচিনকে চেনেন। সুনীল গাওস্করের সঙ্গে তাঁর অনেক দিনের পরিচয়। বেঙ্কটরাঘবনের নেতৃত্বে গাওস্কর যখন ইংল্যান্ডে খেলতে এসেছেন সোলির বাড়িতে সস্ত্রীক গিয়ে থেকেছেন। টিমের অন্যান্যরাও তাঁর বাড়িতে নৈশভোজে গিয়েছেন। আবার পূর্ব ইয়র্কশায়ারে লিগ ক্রিকেটেও খুব পরিচিত নাম তিনি। নিজে খেলেন এবং এশীয় ক্রিকেটারদের খেলাতে নিয়ে আসেন। কিন্তু সেই কাজ করেন ক্রিকেটের প্রতি ভালবাসায়। অর্থের বিনিময়ে কাজ করা কোনও পেশাদারী এজেন্ট ছিলেন না তিনি।

ইয়র্কশায়ারের অনেক কমিটি সদস্যদেরও খুব ভাল করে চিনতেন সোলি। তিনি তাঁদের বোঝাতে থাকলেন, সচিন তেন্ডুলকর দারুণ পছন্দ। তাঁকে আনতে পারলে ক্লাবের জনপ্রিয়তাই অনেক বেড়ে যাবে। কর্তারা পাল্টা প্রশ্ন করলেন, এত ছোট একটা ছেলে এসে কী-ই বা করতে পারবে? সোলি পাল্টা তাঁদের বললেন, আপনারা শোনেননি স্যর ডন ব্র্যাডম্যান কী বলেছেন? সচিনের খেলা দেখে স্ত্রীকে ডেকে স্যর ডন বলেছেন, ছেলেটা একদম আমার মতো ব্যাট করে।

হেডিংলেতেই ব্র্যাডম্যানের সেই জাদুকরি ৩৩৪। ইয়র্কশায়ার ক্রিকেট কমিটি তাঁর সেই ঐতিহাসিক মন্তব্য কী করে উপেক্ষা করে? ক্লাব সবুজ সঙ্কেত দেওয়ার পরে সচিনের সঙ্গে কথা বললেন সোলি। কিন্তু সেখানে অপ্রত্যাশিত বিপত্তি। ‘‘সচিনকে প্রথম যখন বললাম, খুব একটা আগ্রহই দেখাল না। বলল, আমি যেতে চাই না। ওকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, ইতিহাস পাল্টে দেওয়া একটা ঘটনার সাক্ষী হতে যাচ্ছ তুমি। প্লিজ এসো। অনেক চাপাচাপিতে আমাকে বলল, ভেবে দেখবে।’’ কিন্তু সোলি বসে না থেকে ধরলেন বন্ধু গাওস্করকে। তাঁকে পুরো পরিকল্পনা বলে অনুরোধ করলেন, সচিনকে বোঝানোর জন্য। গাওস্করই বোঝালেন সচিনকে, ‘‘তোমার উচিত ইয়র্কশায়ারে গিয়ে খেলা। ওরা নিয়ম পাল্টাচ্ছে তোমাকে নেবে বলে। এই সুযোগ ছেড়ো না।’’

গাওস্করের কথাতেই রাজি হলেন সচিন। এখানেই শেষ নয়। সচিনের ইয়র্কশায়ার অভিযানের কাহিনিতে আরও অনেক মশলা রয়েছে। সোলি অনেক ক্রিকেটার দেখেছেন। ইমরান খানকে সাসেক্সে আসতে সাহায্য করেছিলেন তিনি। ভারতের গাওস্কর থেকে বেদী সকলকে চেনেন। ভি ভি এস লক্ষ্মণ এ দিন ঘুরে গেলেন তাঁর বাড়িতে। ধারাভাষ্য দিতে সচিনও এলে তাঁর সঙ্গে দেখা করবেন না এমন হতেই পারে না। সোলি মাঝে অবাক করে দিয়ে এ-ও বললেন, ‘‘আপনাদের বাংলা থেকে প্রণব রায়, বরুণ বর্মণ এসে আমার এখানে খেলে গিয়েছে। ওরা খুব ভাল বন্ধু আমার।’’

এত ক্রিকেটার দেখেছেন সোলি। কিন্তু সচিনের মতো জিনিয়াস দেখেননি। কেন? সোলির ব্যাখ্যা, ‘‘এক বার স্নুকার খেলতে গিয়েছিলাম আমরা কয়েক জনে। সচিনও ছিল। ও বলল, খেলতে পারে না। কোনও দিন খেলেনি। আমার চাপাচাপিতে খেলতে শুরু করল। আধ ঘণ্টার মধ্যে আমাদের সকলের চেয়ে ও ভাল খেলতে লাগল। একই জিনিস দেখেছিলাম ওকে টেনিস খেলাতে নিয়ে গিয়ে।’’ বিস্ময়বালক হিসেবে রঞ্জি এবং দলীপ ট্রফিতে অভিষেকেই সেঞ্চুরি করেছিলেন সচিন। মনেপ্রাণে চেয়েছিলেন, ইয়র্কশায়ারের হয়েও প্রথম ম্যাচে সেঞ্চুরি করবেন। আশির ঘরে আউট হয়ে যাওয়ায় সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। ‘‘সে দিন সচিনকে খুব হতাশ দেখেছিলাম। কিছুতেই যেন ওর আক্ষেপ মিটছিল না। আমাকে সেই সময়ে একটা কথা বলেছিল ও। সোলি ভাই, আমার গুরু আচরেকরের শিক্ষা। কখনও উইকেট ছুড়ে দিই না। উনি আমাকে উইকেটের মূল্য বুঝতে শিখিয়েছিলেন।’’

ক্রিকেটের ‘ঈশ্বর’ হয়ে সচিন যেখানে গিয়েছেন, ভক্তদের ভিড় তাঁকে ঘিরে ধরেছে। কিন্তু সোলির স্মৃতিতে এমন সব দুষ্প্রাপ্য ছবি আর স্মৃতি ধরা আছে, যা হ।য়তো কারও কাছে নেই। বিশ্বের জনপ্রিয়তম ক্রিকেটারকে নিয়ে গবেষণা করতে বসলে তাঁর অন্তরাত্মাকে বুঝতে যা সাহায্য করবে। এখানেই জমে উঠতে শুরু করে সচিন-অঞ্জলি প্রেম। সপ্তাহান্তে প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন ইংল্যান্ড নিবাসী হবু ডাক্তার। সোলির গ্যারাজে যেতে যেতে তাঁর গাড়ি-প্রেমও বাড়ছিল। সচিনের ইয়র্কশায়ার অভিযানে সব চেয়ে স্মরণীয় ঘটনা? সোলি বললেন, ‘‘এক রাত্রে এগারোটার সময় দরজায় টোকা পড়ল। আমি তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ি। তা হলে এত রাতে কে এল? দরজা খুলে দেখি, সচিন দাঁড়িয়ে আছে। বলল, সোলি ভাই, আমি কাল চলে যাচ্ছি। ইয়র্কশায়ার আমার জীবনের সেরা সাড়ে চার মাস হয়ে থাকবে। সব কিছুর জন্য কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।’’ গলা বুজে আসে সোলির, ‘‘এর পরেই আমার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। আমার স্ত্রীকে প্রণাম করল। আমি আজও ভুলতে পারিনি। সে-দিন সত্যিই মনে হয়েছিল, নিজের ছেলে যেন পরদেশে চলে যাচ্ছে।’’

ওয়াংখেড়েতে বিদায়ী টেস্ট খেলার সময় নিজের ক্রিকেট জীবনের সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিজে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তিনি। সেই তালিকায় একটি নাম বাদ যায়নি—সোলি অ্যাডাম। তিনি নিজে তবু সেরা প্রাপ্তি ধরেন অন্য এক স্বীকৃতিকে। কী সেটা? সোলি বলেন, ‘‘আজও এখানকার ক্রিকেট মাঠে গেলে বয়স্ক দর্শকেরা এসে বলেন, সোলি থ্যাঙ্ক ইউ। আমাদের তুমি সচিন তেন্ডুলকর উপহার দিয়েছিলে। আহা, যেমন অসাধারণ ক্রিকেটার, তেমনই দুর্দান্ত এক মানুষ!’’ ইয়র্কশায়ারে সচিন তেন্ডুলকর এমন এক ফুল, যার সুন্দর ঘ্রাণ আজও চারদিকে ছড়িয়ে!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy