হুঙ্কার: মানসিক দৃঢ়তায় প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে ফের রাজকীয় মেজাজে ফিরলেন শামি। ফাইল চিত্র
গরচা রোডের একটি বাড়ি। গরমকাল। বাতানুকূল যন্ত্র চলছে। কখন যে তা বিকল হয়ে আগুন ধরে গিয়েছে, খেয়ালই করেনি কেউ।
ধোঁয়া বেরোতে দেখে পাড়ার লোক জমতে শুরু করে দিল একটু পরে। ঘরের মধ্যে যিনি আছেন তাঁর কোনও হুঁশ নেই। বারবার দরজা ধাক্কা দেওয়ার পরেও সাড়াশব্দ দিচ্ছেন না। জড়ো হওয়া জনতার উদ্বেগ ক্রমশ বাড়ছে। ঘরের ভিতরে কী আগুন ছড়িয়ে পড়ল নাকি?
আর দেরি না করে গৃহকর্তা ঠিক করলেন, দরজা ভাঙবেন। যেমন ভাবা, তেমন কাজ। তার পর হুড়মুড়িয়ে সকলে ঢুকে পড়লেন ভিতরে। এবং এক রাশ উদ্বেগ আর আতঙ্ক নিয়ে ঢুকে দেখলেন, ভিতরে যিনি ছিলেন, দিব্যি কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছেন। অনেক চিৎকার-চেঁচামেচি করে তবেই তোলা গেল তাঁকে। বাতানুকূল যন্ত্র থেকে যে আগুন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে, বড় বিপদ এসে পৌঁছেছে শিয়রে, দেখে কে বলবে! তিনি যেন সম্পূর্ণ অন্য জগতে।
নব্য যুগের কোনও কুম্ভকর্ণ নয়, কয়েক বছরের মধ্যে ইনিই ভারতের এবং বিশ্বের অন্যতম সেরা ফাস্ট বোলার হয়ে উঠবেন। আসুন পরিচয় করিয়ে দেওয়া যাক বিশ্বকাপের নতুন হ্যাটট্রিকের মালিক মহম্মদ শামির সঙ্গে। কলকাতা ময়দান থেকেই অভাবনীয় উত্থান উত্তর প্রদেশের সহাসপুরে বড় হওয়া শামির। প্রচণ্ড ঘুমকাতুরে তিনি এক দুপুরে এমনই কাণ্ড বাধিয়ে এলাকায় ত্রাহি ত্রাহি রব ফেলে দিয়েছিলেন।
সেই সময়ে তিনি থাকতেন টাউন ক্লাবের কর্তা এবং পরে সিএবি-র সহ-সচিব দেবব্রত দাসের বাড়িতে। দেবব্রত বলছিলেন, ‘‘প্রচণ্ড ঘুমোতে ভালবাসে। কিন্তু সে দিন সত্যিই খুব ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। কোনও সাড়াশব্দই পাচ্ছিলাম না।’’
শনিবার সাউদাম্পটনের মাঠে শেষ ওভারে যিনি হ্যাটট্রিক করে জেতালেন, তাঁর জীবন একেবারে গলি থেকে রাজপথে উঠে আসার এক কাহিনি। যার পদে-পদে রোম খাড়া করে দেওয়া সব মুহূর্ত। নাটকীয় সব মোচড়। আর সেই কাহিনিতে বড় ভূমিকা কলকাতা ময়দানের। শামির বাবা চেয়েছিলেন, ছেলে পেস বোলার হোক। কিন্তু সহাসপুরে পড়ে থেকে কী করে বড় ক্রিকেটার হবেন তিনি? তাই কলকাতায় পাঠিয়েছিলেন ছেলেকে। প্রথম ডালহৌসি ক্লাবের সুমন চক্রবর্তীর নজরে পড়েছিলেন তিনি। ‘‘ট্রায়াল দিতে এসেছিল ও। একটা কিশোর ছেলে অত জোরে বল করছে কী ভাবে, দেখে আমি বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলাম। তার পরেই আমি কোচকে বলি, এই ছেলেটাকে নিয়ে নাও। এ তো অসাধারণ প্রতিভা,’’ পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে বলছিলেন সুমন। খুব সহজে বাকিদের মানাতে পারেননি তিনি। জোরজার করে তবু ঢুকিয়ে দিতে পেরেছিলেন ডালহৌসি ক্লাবের দলে। শামি তাঁর অধিনায়কের মাথা নিচু হতে দেননি। কলকাতার ক্রিকেট ময়দানে উদয় ঘটল এক সত্যিকারের ফাস্ট বোলারের। সুমন এখনও পুরনো সেই দিনের কথা মনে করতে গিয়ে মুগ্ধ কণ্ঠে বলে ফেলেন, ‘‘এত জোরে বল কলকাতায় তখনও কেউ করেনি। সাঁ সাঁ করে বল যাচ্ছে। কাস্টমসের সঙ্গে সবুজ পিচে একটা ম্যাচ খেললাম আমরা। সাত উইকেট নিয়ে ওদের শেষ করে দিল শামি।’’
ডালহৌসি ক্লাবের একটা ছেলে খুব জোরে বল করছে— লোক মারফত বার্তা পৌঁছল টাউন ক্লাবের শীর্ষ কর্তা দেবব্রতের কানে। তিনি ছুটলেন সেই এক্সপ্রেস গতির বোলারকে দেখতে। গিয়ে কী দেখেছিলেন সে দিন? দেবব্রতের কথায়, ‘‘উচ্ছ্বসিত হয়ে আমি সুমনকে বলেছিলাম, এই মুক্তোটিকে কোথা থেকে পেলি তুই? কোথা থেকে ধরে এনেছিস ওকে?’’ দ্রুত রফা সেরে নিলেন টাউন কর্তা। সুমন এবং তাঁর আবিষ্কারকে নিয়ে এলেন নিজের ক্লাবে। টাউন মানে আরও বড় ক্লাব। আরও বেশি করে নজরে পড়া। মহম্মদ শামি নামটা দ্রুত তরঙ্গ তৈরি করতে থাকল ময়দানে।
‘মাহি মার রহা হ্যায়’-এর সেই বিখ্যাত সংলাপের মতো দু’টো জিনিস ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল সহাসপুর থেকে আসা তরুণ ফাস্ট বোলারকে নিয়ে। ‘লড়কা তেজ ডালতা হ্যায়’ অর্থাৎ ‘ছেলেটা খুব জোরে বল করে’। এবং ‘ডান্ডা লেগা রে ভাই, ডান্ডা’ অর্থাৎ ‘উইকেট ভাঙবে, উইকেট’। শনিবার সাউদাম্পটনে শামি যখন একের পর এক স্টাম্প ছিটকে হ্যাটট্রিক করছেন, কলকাতার বাড়িতে বসে টিভিতে দেখতে দেখতে দেবব্রত ওরফে দেবুর মনে পড়ছিল ময়দানের সেই উদ্দাম কিশোর কথা। ‘‘ওর বলের সামনে কেউ দাঁড়াতেই পারত না। শামির মতো বোল্ড করতে আমি খুব কম বোলারকেই দেখেছি। ময়দানে যখন খেলত, সব উইকেটই আসত বোল্ড থেকে। আর ছোটবেলা থেকেই ইয়র্কার দিতে দেখছি ওকে।’’
বিরিয়ানি খেতে ভালবাসেন শামি। টাউনের হয়ে খেলার সময় অনেক ম্যাচে তাঁকে বিরিয়ানির টোপ দিয়ে প্রলুব্ধ করতেন দেবব্রত। বাউন্ডারি লাইন ধরে তাঁর কাছে পৌঁছে গিয়ে বলতেন, ‘‘উইকেট পড়ছে না শামি। উইকেট তোল, বিরিয়ানি আনাচ্ছি।’’ শামি পরখ করে নিতেন টাউন কর্তার কথা। ‘‘কথা দিচ্ছ তো?’’ তার পরেই বলে উঠতেন, ‘‘বল দিতে বলো আমাকে।’’ আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের মতোই তাঁর হাতে বল উঠলে যেন জাদুকরি ক্ষমতা ভর করত। এর পর তিন-চারটি উইকেট একাই উপড়ে ফেলতেন তিনি। আর তাঁবুতে ফিরে চলত বিরিয়ানি উৎসব। এখন কোটিপতি ক্রিকেটার হয়ে উঠেছেন। উত্তর প্রদেশে ফার্ম হাউস রয়েছে। সেখানে ফিটনেস চর্চার জন্য অত্যাধুনিক জিম বসিয়েছেন, সুইমিং পুল তৈরি করেছেন। এ দিন জানা গেল, নিজস্ব ট্রেনারও রেখেছেন তিনি। আজ কে বিশ্বাস করবে, শুরুর সেই সময়ে কলকাতায় খেলা থাকলে দিন প্রতি একশো টাকা পেতেন তিনি!
প্রথম যখন কলকাতায় ট্রায়াল দিতে এলেন, থাকার জায়গাও নেই। ডালহৌসি ক্লাব তাঁকে নেবে শোনার পরে সুমন চক্রবর্তীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘আমাকে তোমরা নিচ্ছে কিন্তু থাকব কোথায়? আমার তো কেউ নেই এখানে।’’ সেই সময়ে ডালহৌসির অধিনায়ক সুমন তাঁকে নিজের বাড়িতে রেখে দেন। তবু কত আর সব কথা মুখ ফুটে তাঁকে বলা যায়? সুমন এক দিন বাড়ি ফিরতে গিয়ে দেখলেন, শামি বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। কী হয়েছে, বাইরে কেন? জিজ্ঞেস করলেন তিনি। শামি বললেন, ‘‘আমার কিছু টাকার দরকার। বাইরে খেতে যাব ভাবছিলাম।’’ তাঁকে টাকা দিলেন সুমন কিন্তু তার আগে বাড়িতে ঢুকিয়ে লুচি খাওয়ালেন। তার আগে শামি কখনও লুচি খাননি। দেখে বলেছিলেন, এটা কি বড় ফুচকা?
পরে টাউন কর্তা দেবব্রতের বাড়িতে থেকেছেন অনেক বছর। টাউনের হয়ে খেলার সময়েই বাংলার প্রধান নির্বাচক সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে খবর যায়, ‘লড়কা তেজ ডাল রহা হ্যায়’। সম্বরণের সঙ্গে কথা হল দেবব্রতের। তিনি বললেন, ‘‘এক বার এসে দেখে যাও তুমি।’’ সম্বরণ আর দেরি করেননি। শামিকে স্থানীয় ম্যাচে বল করতে দেখে বিস্মিত সম্বরণ সে দিন টাউন কর্তাকে বলে উঠেছিলেন, ‘‘একে কোথা থেকে আনলি?’’ মাঠ থেকে ফিরেই নির্বাচক কমিটির বৈঠকে শামির কথা বললেন বাংলার রঞ্জিজয়ী অধিনায়ক। টাউন ক্লাব থেকে বাংলা দলে ঢুকে পড়লেন শামি। এর পরে বাংলার অধিনায়ক লক্ষ্মীরতন শুক্লের সমর্থন তাঁকে আরও দ্রুত এগিয়ে দিল ভারতীয় ক্রিকেটের হাইওয়ের দিকে।
সহাসপুর থেকে ক্রিকেটের নেশায় কলকাতায় আসা এক আত্মভোলা তরুণ। যাঁর পৃথিবী বলতে ছিল জোরে বল করা, স্টাম্প ছিটকে দেওয়ার মধুর শব্দ, বিরিয়ানির প্যাকেট আর কুম্ভকর্ণের ঘুম। ঠিকানা বলতে কখনও ক্লাব ক্যাপ্টেন বা ক্লাব কর্তার বাড়ি। গরচা রোডে অগ্নিদগ্ধ হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেয়ে বিশ্বকাপের মঞ্চে দ্বিতীয় ভারতীয় বোলার হিসেবে হ্যাটট্রিকের নায়ক।
ক্রিকেটের ‘স্লামডগ মিলিয়োনেয়ার’ কাহিনি তিনি— মহম্মদ শামি!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy