একাগ্র: ঐচ্ছিক অনুশীলনেও হাজির ধোনি। শুক্রবার হেডিংলেতে ভারতের নেটে ব্যাট করতে নামছেন। ছবি: এপি।
মহেন্দ্র সিংহ ধোনিকে কখনওই মহড়ায় খুব গা-ঘামাতে দেখা যায় না। বরং উল্টোটাই মনে করা হয় যে, তিনি সরাসরি মঞ্চে ঝলমল করায় বিশ্বাসী। ২ এপ্রিল, ২০১১ ওয়াংখেড়েতে সেই চিরস্মরণীয় ছক্কা মেরে বিশ্বকাপ জেতানোর ম্যাচের আগের দিন অনুশীলনেও তাঁকে খুব মরিয়া ট্রেনিং করতে দেখেনি কেউ।
২০০৪ সালে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আবির্ভাব ধোনির। আইফোন আবিষ্কারের তিন বছর আগে। তার পর থেকে আজ পর্যন্ত অনুশীলনে কখনও সচিন তেন্ডুলকর, রাহুল দ্রাবিড় বা এখনকার বিরাট কোহালির মতো জানপ্রাণ লাগিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার ছবি ওঠেনি তাঁর। ফেসবুক, টুইটার বা ইনস্টাগ্রাম খুঁজেও কি ধোনির জিমে সময় কাটানোর ছবি খুব একটা পাওয়া যাবে? নাহ্, মনে তো করা যাচ্ছে না।
শুক্রবার হেডিংলেতে কিন্তু অন্য এক ধোনিকে আবিষ্কার করা গেল। যিনি আর পাঁচ জন ক্রিকেটারের মতো প্রাক্-ম্যাচ অনুশীলনকে ড্রেস রিহার্সাল হিসেবে দেখতে চাইলেন। নেটে ব্যাট করার সময়ে বারবার প্র্যাক্টিস বোলারদের দেখাতে থাকলেন, কোথায় বেশি করে বল ফেলতে হবে। ভারতীয় দলের আজ ছিল ঐচ্ছিক অনুশীলন। কোহালি এলেন, ঋষভ পন্থ, কেদার যাদব, দীনেশ কার্তিকেরা এলেন। বোলারদের মধ্যে যশপ্রীত বুমরা, ভুবনেশ্বর কুমারকে দেখা গেল। সঞ্জয় মঞ্জরেকরের সঙ্গে তীব্র বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়া রবীন্দ্র জাডেজা এলেন। কয়েক জন ভারতীয় সমর্থক জাডেজার সঙ্গে নিজস্বী তুলতে ছুটে এলেন। আর নতুন সদস্য হিসেবে যোগ দেওয়া মায়াঙ্ক আগরওয়ালকে দেখা গেল চুটিয়ে ফিল্ডিং ও ব্যাটিং প্র্যাক্টিস করছেন।
আলোচনা: প্র্যাক্টিসে কোচ শাস্ত্রীর সঙ্গে কোহালি। শুক্রবার। ছবি: গেটি ইমেজেস।
সচরাচর এ-সব ঐচ্ছিক দিনে মাঠে আসার ইচ্ছাই হয় না মাহির। যিনি গোটা আইপিএল খেলেন কার্যত বিনা প্র্যাক্টিসে, তাঁর কাছে আবার নতুন কী? কিন্তু ইনি যে লম্বা চুলের সেই ‘মাহি মার রহা হ্যায়’ চরিত্র নন। বরং বয়স যে সাঁইত্রিশ হল, জুলফিতে সাদার ছোঁয়া তা জানিয়ে দিচ্ছে। কোহালিদের দলে তিনিই একমাত্র দাড়িওয়ালা নন।
দাড়িহীন এমএসডি-র আপাতত বড় চ্যালেঞ্জ, স্পিনারের চক্রব্যূহ থেকে বেরোনো। আজ প্র্যাক্টিসে তাই স্পিনারদের নেটে বেশি সময় কাটাতে দেখা গেল তাঁকে। একটা পর্বে কব্জির ব্যবহারে আশেপাশে বল ঠেলে খুচরো রানের খোঁজ করার অধ্যবসায় চলল। তার পরের পর্বে হাত খুলে মারা। আর নেটের পাশে দাঁড়িয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে তাঁর ব্যাটিং দেখতে থাকলেন হেড কোচ রবি শাস্ত্রী। ব্যাটিং করে নেট থেকে বেরিয়েই শাস্ত্রীর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন ধোনি। হেড কোচের হাত নেড়ে শ্যাডো করার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল, খুচরো রানের উপরে জোর দিতে বলছিলেন। দেখে মনে হচ্ছিল, বারবার কব্জি ব্যবহারের ইঙ্গিতই করছিলেন হেড কোচ।
এই নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, ধোনির প্রধান সমস্যা অতিরিক্ত মাত্রায় ‘ডট বল’ (যে-বলে কোনও রান হয় না) খেলা। হিসেব বলছে, এখনও পর্যন্ত বিশ্বকাপে যত বল খেলেছেন ধোনি, তার প্রায় ৪৪ শতাংশ ডেলিভারিতে রান নিতে পারেননি। এই ‘ডট বল’-এর বোঝাই কাঁধে চেপে শ্বাসরুদ্ধ করে দিচ্ছে ব্যাটসম্যান ধোনিকে। হঠাৎই স্কোরবোর্ডের দিকে তাকিয়ে তিনি আবিষ্কার করছেন, রানের চেয়ে বল অনেক বেড়ে গিয়েছে। ও-দিকে হাতে বেশি উইকেটও বেশি থাকছে না যে, অল আউট চালাতে যাবেন।
বরাবর ধোনির খেলায় বিশেষত্ব ছিল, একেবারে শেষে গিয়ে টপ গিয়ারে গাড়ি তোলা। তখন খুচরো রান না-নিয়ে নিজে বেশি বল খেলতেন তিনি। এখন ‘ফিনিশার’ ধোনির সেই রণনীতিও হোঁচট খাচ্ছে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধেই যেমন প্রথম দু’বলে সিঙ্গলস নিলেন না। তৃতীয় বলে আউট হয়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ায় তীব্র আক্রমণ শুরু হয়ে গেল।
২০১১ বিশ্বকাপ ফাইনালের সেই ৭৯ বলে ৯১ নট আউটের সূর্যালোক বহু দিন তাঁর ব্যাট থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। এখনও ৬০-এর উপরে ব্যাটিং গড় ধরে রেখেছেন ধোনি। কিন্তু উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে স্ট্রাইক রেট। ২০০৫-এ স্ট্রাইক রেট ছিল ১০৩, এখন তা নেমে দাঁড়িয়েছে ৮৩.৭১। ধোনি যে-হেতু পাঁচ বা ছ’নম্বরে নামেন, যেখানে বলের চেয়ে অবশ্যই রান বেশি থাকা দরকার এবং রানরেট বাড়ানোটাই অন্যতম প্রধান দায়িত্ব, প্রতি ১০০ বলে ৮৩ রান বড্ড বেশি চোখে লাগছে। ২০১৫ বিশ্বকাপের সময় পর্যন্ত শেষ ২০ ওভারে নেমে ধোনির স্ট্রাইক রেট ছিল প্রতি ১০০ বলে ১০৬ রান। এখন সেটাও অনেক কমে এসে দাঁড়িয়েছে ৯৩-এ।
প্রাক্-ম্যাচ প্রস্তুতিতে এত কালের অভ্যেস পাল্টে নিজেকে নিংড়ে দেওয়াই শুধু নয়। ধোনিকে আরও একটা অদ্ভুত জিনিস করতে দেখা গেল শুক্রবার। চাকা লাগানো বড় হোভার কভার দিয়ে ঢাকা ছিল হেডিংলের বাইশ গজ। ব্যাটিং সেরে নিজেই সেই আবরণ ঠেলে সরাতে থাকলেন। সঙ্গী ফিল্ডিং কোচ শ্রীধর। দেখে মনে হচ্ছিল, কাল কোন পরীক্ষার হলে কত নম্বর সিট পড়ল, সব দেখে নিয়ে তবেই হোটেলে ফিরে যেতে চান। এতটাই এসপার-ওসপার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাঁর জন্য।
কোহালিদের দলের অন্দরমহলে একটা কথা উঠেছে, ধোনিকে উপরে তুলে হার্দিক পাণ্ড্যকে শেষের ঝড়ের জন্য রেখে দেওয়া হবে কি না। তাতে আউট হওয়ার আতঙ্ক থেকে ধোনিকে বার করে আনা সম্ভব হতে পারে। সে-ক্ষেত্রে তিনি কিছুটা খোলা মনে খেলার মনস্তাত্ত্বিক সুবিধা পেতে পারেন যে, আমি গেলেও হার্দিক আছে।
আর যদি নিজেকে চাঙ্গা করার জন্য উদাহরণ দরকার হয়, হেডিংলেতে তার অভাব হবে না। হাতের কাছেই জ্বলজ্বল করছে। ট্রেন্ট ব্রিজে বিশ্রী হার, লর্ডসে ড্র। জোড়া শূন্য করা ইংরেজ মহাতারকা অধিনায়কত্ব ছাড়তে বাধ্য হলেন। লিডসেও প্রথম ইনিংসে অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে ২২৭ রানে পিছিয়ে থেকে ১৭৪-এ অলআউট। সন্ধের স্কোরবোর্ডে জ্বলজ্বল করছে সেই বিখ্যাত বাজির দর: ৫০০-১। ছাইয়ের ভস্ম থেকে উঠে দাঁড়িয়ে এর পর তাঁর সেই অমর ১৪৯ নট আউট। বব উইলিস ৪৩ রানে আট উইকেট নেবেন আর অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে টেস্ট ছিনিয়ে নিয়ে যাবে ইংল্যান্ড।
আটত্রিশ বছর আগের সেই ঐতিহাসিক ইয়ান বোথাম টেস্ট। এখানকার ক্রিকেট-ভক্তদের মুখে মুখে এখনও ঘোরে ‘হেডিংলে ১৯৮১’। মহানায়কের প্রত্যাবর্তন মঞ্চ হয়ে ওঠার ইতিহাস কিন্তু আছে হেডিংলের!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy