জুটি: তারুণ্য ও অভিজ্ঞতার মিশেল ভরসা শাস্ত্রী-কোহালির। ফাইল চিত্র
তিনি নিজে দু’দু’বার বিশ্বজয়ের মুকুটধারী। তিরাশিতে লর্ডস ব্যালকনিতে শ্যাম্পেন ছোটানো কপিল দেবের দৈত্যদের এক জন। পঁচাশিতে বেনসন অ্যান্ড হেজেস বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে মেলবোর্নে আউডি গাড়ি চড়ে মাঠ প্রদক্ষিণ। সে দিনের চ্যাম্পিয়ন অব চ্যাম্পিয়ন্স এ বার বিরাট কোহালিদের চাণক্য হিসেবে ফের আরও একটি কাপ অভিযানে বেরিয়ে পড়েছেন। পারবেন কি এ বার কাপ আনতে? কবে থেকে, কী ভাবে প্রস্তুতি নিয়েছে তাঁর দল? কাদের ফেভারিট ধরছেন? এ বার ফের সেই ইংল্যান্ডেই বিশ্বকাপ। লর্ডসের সেই বিশ্ব জয়ের ব্যালকনিতে শ্যাম্পেন, ড্রেসিংরুমে সেলিব্রেশন কতটা স্মৃতিমেদুর করে তুলবে তাঁকে? মিশন বিশ্বকাপে বেরিয়ে পড়ার আগে আনন্দবাজারের সঙ্গে দীর্ঘ, একান্ত আলাপচারিতায় যোগ দিয়েছিলেন রবি শাস্ত্রী। আজ প্রকাশিত হল এক্সক্লুসিভ সাক্ষকারের প্রথম পর্ব:
প্রশ্ন: এমন এক জনের সঙ্গে কথা বলছি, যিনি ১৯৮৩ বিশ্বকাপ জয়ের অন্যতম সদস্য। ১৯৮৫ বেনসন অ্যান্ড হেজেস বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ জয়ী দলের সেরা খেলোয়াড় এবং চ্যাম্পিয়ন অব চ্যাম্পিয়ন্স। বিশ্বকাপ জিততে গেলে সব চেয়ে বেশি করে কোন জিনিসটা দরকার হয়?
রবি শাস্ত্রী: আমার মনে হয় অন্য কোনও কিছুর চেয়ে বেশি দরকার হয় নিজেদের প্রতি বিশ্বাস। যেটা আমাদের এই দলটায় খুব দেখতে পাই। যে ভাবে ওরা গত চার বছর ধরে খেলেছে, সেটা দেখলেই বোঝা যাবে। আমার মনে হয় অস্ট্রেলিয়ায় ২০১৫ বিশ্বকাপের পর থেকে এই দলটার মধ্যে উন্নতির ছাপ খুব স্পষ্ট। শুধুমাত্র ফলের জন্য নয়, কী রকম ধারাবাহিকতা রয়েছে দলটার দেখুন। কত নতুন মুখ উঠে এসেছে। দলে বৈচিত্র যোগ হয়েছে। সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তারুণ্য আর অভিজ্ঞতার দারুণ মিশেল তৈরি হয়েছে। আমার তো মনে হয়, এই মিশ্রণটা এ বারের বিশ্বকাপে খুব কাজে দেবে।
প্র: ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপ। ১৯৮৩-র ঐতিহাসিক জয় কতটা মনে পড়বে? নস্ট্যালজিক হয়ে পড়বেন কি?
শাস্ত্রী: অবশ্যই। মাত্র ১৯ বছর বয়স ছিল তখন আমার। প্রথম পাঁচটা ম্যাচে আমি খেলেছিলাম। জীবনে ভুলব না ’৮৩ বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচটা। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সেই সময় বিশ্ব ক্রিকেটে অপরাজেয় একটা দল। বিশ্বকাপেও তার আগে কখনও কেউ ওদের হারাতে পারেনি। আর আমরা কি না শুরুতেই হারিয়ে দিলাম! পুরো দলটার মনোভাব ওখান থেকেই ঘুরে গিয়েছিল। কী টিম ওদের! ভিভ, গ্রিনিজ, হেনস, লয়েড। সঙ্গে সেই আগুন ঝরানো পেস ব্যাটারি। শেষ উইকেটে ওরা কামড়ে পড়েছিল। শেষে গার্নারকে আমিই আউট করেছিলাম (শেষ উইকেটে হোল্ডিং এবং গার্নার যোগ করেছিলেন ৭১ রান)। জীবনে ভুলব না ওই উইকেটটা। আমার মনে হয়, ওই ম্যাচটা থেকেই সকলের মধ্যে বিশ্বাসের জন্ম নিতে শুরু করে যে, এই বিশ্বকাপে আমরা অভাবনীয় কিছু করে দেখাতে পারি।
প্র: ২৫ জুন, ১৯৮৩। লর্ডসে কপিল দেবের হাতে বিশ্বকাপ ওঠার পরে কী ভাবে সেলিব্রেট করেছিলেন? কতটা মনে আছে সেই রাত?
শাস্ত্রী: ওহ্! জীবনে ভোলা যাবে না। এখনও গায়ে কাঁটা দেয়। আর শুনুন, কখনও রাতটা ভোলা যাবে না কারণ, সেই রাতটা যে শেষই হয়নি আমাদের জন্য।
প্র: আপনি বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারানোর কথা বললেন। কিন্তু তার আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে গিয়েছিল ভারতীয় দল। সেখানে একটি ওয়ান ডে-তে তারা জেতে। আপনি সেই ম্যাচে অলরাউন্ড পারফরম্যান্স করেছিলেন। অনেকের মনে হয়, বিশ্বকাপ জয়ের নেপথ্যে বড় ভূমিকা নিয়েছিল ভিভদের দেশে সেই জয়।
শাস্ত্রী: ঠিক। সেই সময় ওয়েস্ট ইন্ডিজকে নিজেদের ঘরে কেউ হারাতে পারত না। ভিভদের ডেরায় গিয়ে ওদের মেরে আসাটা তো কেউ আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ হাতে পেলেও ভাবতে পারত না। ও রকম টিম আমি দেখিনি। সংশয়াতীত ভাবে চ্যাম্পিয়ন। যাদের শ্রেষ্টত্ব নিয়ে কখনও কেউ প্রশ্ন তোলার ফুরসত পায়নি। সেই সময় দু’টোই তো ফর্ম্যাট ছিল। টেস্ট আর ওয়ান ডে। দু’টোতেই অবিসংবাদী শাসক ছিল ওরা। কেউ ওয়েস্ট ইন্ডিজের ধারেকাছেও ছিল না। ওই জয়টা তাই বিশ্বকাপের জন্য বিশ্বাসের বীজ বুনে দিয়েছিল। এর পর ইংল্যান্ডে এসেও শুরুতেই যখন ওদের হারালাম, বিশ্বাসটা মন্ত্রের মতো গেঁথে গেল যে, আমরা পারি!
প্র: সেটা ছিল ২৫ জুন, ১৯৮৩। এ বার ১৪ জুলাই, ২০১৯। সেই লর্ডস। সে দিন ট্রফি হাতে লর্ডসের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়েছিলেন কপিল দেব। এ বার কি বিরাট কোহালিকে সে রকম ছবি তুলতে দেখা যাবে? সে দিন আপনি ছিলেন কপিলের দলের ক্রিকেটার। এ বার বিরাটদের কোচ।
শাস্ত্রী: তিরাশিতে ছিলাম ক্রিকেটার, আর এ বারে কোচ— এই ব্যাপারটা ভাবলে আমার একটা বিশেষ সুখানুভূতি হচ্ছে। মনে হচ্ছে, ক্রিকেট খেলাটার বিভিন্ন বাউন্ডারি লাইন ধরে আমি দৌড়তে পেরেছি। ছোটবেলা থেকে এই খেলাটাকে এত ভালবেসেছি, তার সঙ্গে নানা রূপে যে জড়িয়ে থাকতে পারলাম, নানা ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হতে পারলাম, তার জন্য ক্রিকেটের প্রতি ভীষণ ভাবে কৃতজ্ঞ। যদি সত্যিই এ বার ফাইনালে উঠতে পারি, যদি শেষের সেই দিনটায় ফিরে যেতে পারি লর্ডসের ড্রেসিংরুমে ট্রফির দাবিদার হিসেবে, অবর্ণনীয় এক অনুভূতি তৈরি হবে, এখনই বলে দিতে পারি।
প্র: ২০১৪-তে প্রথম যখন আপনি এই দলটার দায়িত্ব নিয়েছিলেন, তখন তাঁরা বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে সাত নম্বর স্থানে পড়ে গোঙাচ্ছে। এই দলের বেশির ভাগ ক্রিকেটার তৈরি হয়েছে গত চার-পাঁচ বছরে আপনি কোচ থাকাকালীন। আপনিই বলুন, কেন এই দলটার উপর ভরসা করা যায়?
শাস্ত্রী: আমি পঁয়ত্রিশ বছর ধরে ক্রিকেটের সঙ্গে নানা ভূমিকায় যুক্ত। কখনও খেলেছি, কখনও ধারাভাষ্যকার, কখনও কোচ। আমি যখন বলেছিলাম, আমার দেখা সেরা ভারতীয় দলগুলির থেকে কোথাও পিছিয়ে থাকবে না এখনকার এই গ্রুপটা, সকলে রে–রে করে উঠল। কথাটা আমি সজ্ঞানেই বলেছিলাম রে ভাই। এখনও বলছি। গত তিন বছরে সমস্ত ফর্ম্যাটের ক্রিকেট মিলিয়ে ওদের পরিসংখ্যানটা একটু ঘেঁটে দেখুক না আক্রমণকারীরা। অভাবনীয়, অবিশ্বাস্য শব্দগুলো তখন ওরা নিজেরাই ব্যবহার করবে। তিন বছর ধরে টানা ওরা বিশ্বের এক নম্বর টেস্ট টিম হয়েছে। ওয়ান ডে ক্রিকেটে প্রথম দুই থেকে সরেনি। টি-টোয়েন্টিতেও প্রথম তিনের মধ্যে থেকেছে সব সময়। অসাধারণ ধারাবাহিকতা। তার সঙ্গে দুর্ধর্ষ বিনোদনের ক্রিকেট। আমার কাছে ‘ব্র্যান্ড অফ ক্রিকেট’ ব্যাপারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। জিতছি তো ঠিক আছে, কিন্তু কী ভাবে জিতছি? আমাদের এই টিমটা ক্রিকেট খেলার মাধ্যমে মানুষের মনে আনন্দ দিয়ে জিততে পারছে। সেটাই সেরা প্রাপ্তি। মানুষ আনন্দ পাচ্ছে কারণ তারা দেখতে পাচ্ছে এই টিমে তারুণ্য আছে, সাফল্যের খিদে আছে, উদ্যম আছে, শিল্প আছে, উৎকর্ষ আছে।
প্র: বিশ্বকাপের প্রস্তুতি শুরু করেছেন ঠিক কবে থেকে?
শাস্ত্রী: গত বছরের শুরুতে দক্ষিণ আফ্রিকায়। যখন আমরা ওখানে সফর করলাম, সকলে মিলে এক সন্ধ্যায় টিম মিটিংয়ে বসে বললাম, এখন আমরা সব বিদেশে ম্যাচ খেলব। দক্ষিণ আফ্রিকায় এসেছি, ইংল্যান্ডে যাব, অস্ট্রেলিয়ায় খেলব, তার পরে নিউজ়িল্যান্ডেও যাব। এই চারটে দেশে যে ওয়ান ডে সিরিজ খেলতে হবে, সেগুলোকে কেন বিশ্বকাপের প্রস্তুতি হিসেবে দেখব না? সকলে সায় দিল সেই ভাবনায়। দক্ষিণ আফ্রিকাতেই প্রথম আমরা ওয়ান ডে সিরিজ খেললাম বিশ্বকাপের কথা মাথায় রেখে।
প্র: সেই সময় ছেলেদের প্রতি হেড কোচের বার্তাটা কী ছিল?
শাস্ত্রী: বেশি কিছু বলিনি। চেয়েছিলাম, বিশ্বকাপের ভাবনাটা মাথার পিছন দিকে থাকুক। বলেছিলাম, বিশ্বকাপ থেকে আমরা সতেরো মাস দূরে আছি। নিজেদের এক সূত্রে বাঁধার কাজটা শুরু করে দিই, চলো। নানা রকম কম্বিনেশন চেষ্টা করে দেখতে থাকি, কোনটা আমাদের জন্য ভাল হতে পারে। স্ট্র্যাটেজি করা শুরু করি, কোন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কী ভাবে খেলব। এই সব আর কী!
প্র: ভারত দু’বার পঞ্চাশ ওভারের বিশ্বকাপ জিতেছে। কিন্তু এতটা ফেভারিট হিসেবে বোধ হয় কখনও বিশ্বকাপে খেলতে যায়নি। এটা সুবিধা যেমন, তেমনই কি চাপের নয়?
শাস্ত্রী: ফেভারিট কি ফেভারিট না, এ সব নিয়ে আমাদের অত মাথা ঘামানোর কী আছে? আমরা তো নিজেদের ফেভারিট বলে ঘোষণা করিনি। যারা বলছে, তারা বুঝুক না! আমরা গত সতেরো মাসে যা যা করে সফল হয়েছি, সেটাই করে যাওয়ার দিকে মন দেব। বিশ্বকাপ বলেই আমাকে অন্য রকম খেলা খেলতে হবে, সে রকম তো নয় ব্যাপারটা। বরং আমি তো ছেলেদের উল্টোটা বলেছি। মনে করো, এই বড় মঞ্চটা তোমাদের। নিজেদের মনের ভাব প্রকাশ করে সেই মঞ্চে খোলা মনে ঘুরে বেড়াও। এই বৃহত্তম ক্রিকেট মঞ্চকে উপভোগ করো।
প্র: ভারত ছাড়া আর কোন দলকে কাপ জয়ের দাবিদার মনে হচ্ছে?
শাস্ত্রী: এই বিশ্বকাপে খারাপ কোনও দল নেই। তার মধ্যেও ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়ার কথা বলব। দু’টো দলই খুব শক্তিশালী। ইংল্যান্ড আমার মতে এক নম্বর ফেভারিট। গত বারো মাস যে ধরনের ওয়ান ডে ক্রিকেট ওরা খেলেছে, এক কথায় অসাধারণ। দুর্দান্ত গভীরতা রয়েছে দলটায়। প্লাস, ভুললে চলবে না ওরা নিজেদের দেশে বিশ্বকাপ খেলবে। কিন্তু যতই ফেভারিট তকমা সেঁটে দিই, কোনও দল এ বারের বিশ্বকাপে শান্তিতে ঘুমনোর সুযোগ পাবে না। ফর্ম্যাটটাই এমন যে, দম ফেলার সময় নেই। দশটা সেরা টিম খেলবে। প্রত্যেকটা ম্যাচই তো সেমিফাইনাল!
প্র: ভারতের বর্তমান এই দলের ফিল্ডিং এবং ফিটনেস নিয়ে সবাই মুগ্ধ। আপনার কি মনে হয়, এটাই বিশ্বকাপে খেলা ভারতের সর্বকালের সব চেয়ে ফিট দল?
শাস্ত্রী: ইয়েস, আমার তাই মনে হয়। এটাই বিশ্বকাপে খেলা ভারতের সব চেয়ে ফিট দল। দায়িত্বে ফিরে এসে আমি প্রথমেই ছেলেদের বলেছিলাম, একটা জায়গায় আমাদের অনেক উন্নতি করতে হবে— ফিল্ডিং। ছেলেদের ফুল মার্কস দিতেই হবে। যে টার্গেট তৈরি করা হয়েছিল, সেটা ওরা হাসিল করেই দেখিয়েছে। কঠোর পরিশ্রম করেছে, ফিটনেসে পুরোপুরি ফোকাস রেখেছে, অক্লান্ত ভাবে ট্রেনিং করে গিয়েছে। তাতে অনেক পাল্টে গিয়েছে ভারতীয় দল।
প্র: এই বিশ্বকাপে ফিল্ডিং কতটা গুরুত্বপূর্ণ হতে যাচ্ছে?
শাস্ত্রী: তফাত করে দেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ দিক হতে যাচ্ছে। ফিল্ডিংয়ে যদি কোনও দল ২৫ রান বাঁচিয়ে দিতে পারে, তার মানে তাদের ব্যাটসম্যানদের ২৫ রান কম তাড়া করতে হবে। বিশ্বকাপের মতো টুর্নামেন্টে সেটা একটা বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়াতেই পারে। সেই কারণেই অস্ট্রেলিয়া বা দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দল অন্যদের থেকে এগিয়ে গিয়েছে বরাবর। শুরু থেকেই ওদের কাছে ফিল্ডিং সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক। (চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy