আশাবাদী: কোহালির দলের প্রতি আস্থাশীল কিংবদন্তি লয়েড। ফাইল চিত্র
নিউজ়িল্যান্ড বোলিংয়ের হামলায় তখন বেসামাল ভারতীয় ব্যাটিং। বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত দেখাচ্ছে বিশ্বকাপ স্বপ্ন। আইসিসি কমেন্ট্রি বক্সে পাওয়া গেল তাঁকে। ক্রিকেটে একটা বাজে দিন কী ভাবে একটা ফেভারিট দলকে ধ্বংস করে দিতে পারে, তাঁর চেয়ে ভাল কে জানেন! ২৫ জুন, ১৯৮৩ লর্ডসে এক দিকে কপিলের দৈত্যেরা ইতিহাস লিখছেন, অন্য দিকে ক্যারিবিয়ান মহাশক্তি লুটিয়ে পড়ছে। তাই হয়তো শুরুর দিকে ভারতীয় ব্যাটিংয়ের অমন বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যে বারবার ভারতীয় দলের পাশে দাঁড়ালেন। বলে গেলেন, একটা দিন দিয়ে একটা দলকে বিচার করবেন না। তিনি— ক্লাইভ লয়েড কমেন্ট্রির ব্যস্ততার ফাঁকে সময় বের করে সাক্ষাৎকার দিলেন বুধবার সেমিফাইনাল চলাকালীন। চার ফাস্ট বোলার নিয়ে যাঁর দুলকি চালে মাঠে ঘুরে বেড়ানো আর ঠান্ডা চাহনি দেখে হাড় হিম হয়ে যেত সব দলের। ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তি শুরু করলেন এক সময়কার প্রবল প্রতিপক্ষ এবং অবশ্যই বন্ধু সুনীল গাওস্করকে সত্তরতম জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে।
প্রশ্ন: সত্তরতম জন্মদিনে আপনার বন্ধু এবং এক সময়কার প্রতিপক্ষ সুনীল গাওস্করকে কী বলবেন?
ক্লাইভ লয়েড: হাই সানি, হ্যাপি বার্থডে। তোমাকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই। এটাই বলব যে, দারুণ ব্যাটিং করে চলেছ। আমাদের বিরুদ্ধে যেমন করতে। এ ভাবেই চালিয়ে যাও। আর আশা করছি, এত সব শুভেচ্ছা জানানোর জন্য খুব শীঘ্রই কখনও কোথাও তুমি নিশ্চয়ই আমার জন্য পানীয়ের অর্ডার দেবে।
প্র: ফিরে তাকিয়ে গাওস্করের ব্যাটিং সম্পর্কে কী মনে হয়?
লয়েড: অসাধারণ ব্যাটসম্যান। সানি সম্পর্কে খুব একটা ভাল কথা একেবারেই আশা করবেন না, কারণ আমি মোটেও ভুলিনি যে, আমাদের বিরুদ্ধেই বেশি রান করত ও। (হাসি) যাক, ইয়ার্কি সরিয়ে রেখে বলতে পারি, সানির মতো জমাট ব্যাটসম্যান আমি খুব কম দেখেছি। বোলারদের পক্ষে খুঁত খুঁজে পাওয়াই কঠিন হত। সানির ব্যাটিংয়ে যে জিনিসটাকে আমি সব চেয়ে শ্রদ্ধা করতাম, তা হচ্ছে ওর মনঃসংযোগ। ওর ব্যাটিং দেখে মাঝেমধ্যে মনে হত, আহা, এ রকম মনঃসংযোগ যদি আমারও থাকত!
প্র: আপনি নিজেও তো ক্যারিবিয়ান ব্যাটিংয়ের ‘ক্রাইসিস ম্যান’ ছিলেন। যখনই বিপদের মুখে পড়ত দল, আপনার ব্যাট আরও চওড়া হত। আপনার কাছেও সানি উদাহরণ ছিলেন?
লয়েড: অবশ্যই। সেই সময় এমন কোনও ব্যাটসম্যান ছিল না যে, কোনও না কোনও ভাবে সানির দ্বারা প্রভাবিত হয়নি। আমার তো বারবারই মনে হয়েছে, ঈশ্বর আমাকে কেন সানির মতো মনঃসংযোগ দিলেন না! তা হলে হয়তো আমি আরও অনেক রান করতে পারতাম। আমাদের সময়ে সানি ছিল ব্যাটিংয়ের মহাশক্তি। অনেক দিন ধরে খেলেওছে। পরে সচিন তেন্ডুলকর এসেছে ভারতের হয়ে খেলতে। সচিনও অনেক দিন ধরে খেলেছে। কিন্তু সানি ছিল উদাহরণ। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ওকে আদর্শ মেনে নিজেদের গড়েছে। জন্মদিনে তাই আবার বলি— সানি, বন্ধু আমার, ক্রিকেটকে সমৃদ্ধ করার জন্য ধন্যবাদ। হ্যাপি বার্থডে। ড্রিংকটা ভুলো না যেন।
প্র: আপনার হাতে তখন বিশ্বত্রাস সব ফাস্ট বোলার ছিল। সানিই কি ফাস্ট বোলিংয়ের বিরুদ্ধে আপনার দেখা সেরা ব্যাটসম্যান?
লয়েড: এত বছর পরে এটা আর আমাকে বলতে হবে কেন? আমাদের বিরুদ্ধে সানির রেকর্ডই তো যা বলার বলে দিচ্ছে। সেই সময় ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলিং আক্রমণকে বিশ্বের সেরা বলা হত। তাদের বিরুদ্ধে প্রচুর রান করে দেখিয়েছে সানি। এক বার নয়, বারবারই সফল হয়েছে। ধারাবাহিকতা ছিল দেখার মতো। বিশ্বের সেরা বোলারদের বিরুদ্ধে এত রান করার জন্যই তো ওকে সর্বকালের সেরাদের এক জন বলে মানে ক্রিকেট বিশ্ব। সেই কারণেই তো ক্রিকেট বিশ্ব আজও ওকে সম্মান করে। শ্রদ্ধায় মাথা ঝোঁকায়।
প্র: আপনার দলের তরুণ ব্যাটসম্যানদের কি বলতেন, সুনীল গাওস্করকে উদাহরণ করো?
লয়েড: হ্যাঁ, বলতাম। কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজ অধিনায়ক হিসেবে আরও বেশি করে চাইতাম, কত ক্ষণে ও ক্রিজ থেকে বিদায় হবে (হাসি)!
বিষণ্ণ: বিশ্বকাপের স্বপ্ন শেষ। বুধবার ম্যাঞ্চেস্টারে হারের পরে বিমর্ষ রোহিত, হেড কোচ শাস্ত্রী এবং কোহালি। এপি
প্র: ভারতের এই অকস্মাৎ ব্যাটিং বিপর্যয় দেখে কি আপনি বিস্মিত?
লয়েড: খেলায় এ রকম হতেই পারে। এ জন্যই তো ক্রিকেটকে মহান অনিশ্চয়তার খেলা বলা হয়। নিউজ়িল্যান্ডের বোলারেরা পরিবেশকে কাজে লাগাচ্ছে। আমার মনে হয়, ভারতের বাকি ব্যাটসম্যানদের এ বার ক্রিজে থিতু হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। (ঠিক তখনই খোঁচা দিয়ে আউট হয়ে গেলেন কে এল রাহুল। ভারত চতুর্থ ওভারে ৫ রানে তিন উইকেট হারিয়ে ধুঁকছে) এটা নতুন করে শপথ নেওয়ার সময়। ওদের প্রধান ব্যাটিং স্তম্ভরা হয়তো চলে গিয়েছে কিন্তু ভারতের ব্যাটিংয়ে অনেক গভীরতাও আছে। শান্ত ভাবে পরিস্থিতির মোকাবিলা করাটাই দরকার এখন। নিজেদের মধ্যে কথা বলে বলে পরিস্থিতি হাল্কা করার চেষ্টা করতে হবে। বিশ্বাস রাখতে হবে নিজেদের উপর যে, ম্যাচ এখনও আছে।
প্র: ভারতীয় ব্যাটিং কি বিরাট কোহালি আর রোহিত শর্মার উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল? সেই অতি নির্ভরতাই কি ডোবাচ্ছে?
লয়েড: ক্রিকেট একটা টিমগেম। এক বা দু’জনের উপর নির্ভর করে খেলা যায় না। সেই কারণেই দলে ভারসাম্য দরকার হয়। শুরুতে যদি আমার কয়েক জন প্রধান ব্যাটসম্যান আউট হয়ে যায়, কী ভাবে পরিস্থিতির সামাল দেব? ক্রিকেটে সব দিন সমান যায় না। বিপদ আসতেই পারে। কিন্তু বিপদ থেকে উদ্ধার পাব কী ভাবে, সেই রাস্তাটাও জানা থাকতে হবে। আমার মনে হয়, ম্যাঞ্চেস্টারে আকর্ষণীয় একটা ম্যাচের প্রেক্ষাপট তৈরি ছিল। গত কাল ভারত ছিল শাসক। নিউজ়িল্যান্ডের ঘাড়ে চেপে বসেছিল ভারতীয় বোলারেরা। আজ নিউজ়িল্যান্ডের বোলারেরা প্রত্যাঘাত করল। বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে তো এ রকম হাড্ডাহাড্ডি লড়াই-ই হওয়ার কথা। টেনিসে যেমন আমরা দেখতে পাই। সেরা চার জন সেমিফাইনালে উঠেছে। কেউ কাউকে জমি ছাড়বে না, এটাই স্বাভাবিক।
প্র: কিন্তু আপনার কি মনে হচ্ছে, সুইং সহায়ক পরিবেশে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের টেকনিক সংক্রান্ত দুর্বলতা ফের প্রকট হয়ে উঠল?
লয়েড: না, আমি একটা ম্যাচ দেখে সে রকম কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছতে রাজি নই। আগের অনেক ম্যাচে তো ওরা ভাল করে দেখিয়েছে। আমি জানি, বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল ম্যাচে ব্যর্থ হলে কথা উঠবে। কিন্তু আমি নিজে একটা ম্যাচের ফল দেখে একটা দল সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ পাল্টে ফেলতে রাজি নই।
প্র: যাঁর হাতে সেরা সব ফাস্ট বোলারেরা ছিল, তাঁর চোখে এখনকার ভারতীয় বোলিং কেমন?
লয়েড: খুবই ভাল বোলিং। দারুণ ভারসাম্য রয়েছে। তবে আমি সব চেয়ে মুগ্ধ ভারতের ফিল্ডিং দেখে। আমি ভারতের যত টিম দেখেছি, তার মধ্যে এটাই ফিল্ডিংয়ে সেরা। দলে অনেক তরুণ ক্রিকেটার আছে। তারা মাঠে অনেক বেশি চনমনে ভাব তৈরি করেছে। জাডেজা অসাধারণ। ও মাঠে থাকলেই ভারতীয় ফিল্ডিংয়ের তীব্রতা বেড়ে যায়। আর একটা বড় কারণ আইপিএলের মতো সফল টুর্নামেন্টের আবির্ভাব। নতুন নতুন ছেলেরা আন্তর্জাতিক স্তরের সফল তারকাদের সঙ্গে খেলার সুযোগ পাচ্ছে। তাদের থেকে শেখার সুযোগ পাচ্ছে।
প্র: ভারতের ফাস্ট বোলিংয়ের বিবর্তন দেখে সকলে উচ্ছ্বসিত। মার্শাল, রবার্টস, হোল্ডিং, গার্নারদের ক্যাপ্টেন কী বলবেন?
লয়েড: ভারতের ফাস্ট বোলিং বিভাগ খুবই ভাল। কিন্তু আমি বলতে চাইছি, ফাস্ট বোলিংই একমাত্র অস্ত্র হতে পারে না। শুধু একটা জিনিসের উপর নির্ভর করে এগোনো যায় না। দলগত একটা ভারসাম্য থাকতে হবে। ভারতের এই দলটা যে গত দু’বছর ধরে ধারাবাহিক ভাবে সফল হয়েছে, তার কারণ ওদের দারুণ ভারসাম্য রয়েছে। ভাল ব্যাটসম্যান রয়েছে, স্পিন বোলিং বিভাগ খুব ভাল, দারুণ সব ফাস্ট বোলার রয়েছে, যারা এক্সপ্রেস গতিতে বল করতে পারে। এক-আধটা দিন ছন্দপতন হতে পারে। আবার বলছি, তা দিয়ে বিচার করা উচিত নয়। আমি এত ভারসাম্য আর এমন দুর্ধর্ষ ফিল্ডিং কোনও ভারতীয় দলে দেখিনি।
প্র: ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপে ভাল শুরু করেও পারল না। নিজেদের দল নিয়ে আপনার কী মত?
লয়েড: শুনুন, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ভাল খেলেনি। আর ভাল না খেললে আগেভাগে বিদায় তো নিতেই হবে।
প্র: সর্বকালের অন্যতম সেরা ক্যাপ্টেনের কাছে জানতে চাইব, এখনকার ক্রিকেটে কোন ক্যাপ্টেনকে আপনার ভাল লাগে?
লয়েড: ভাল অধিনায়ককে ভাল নেতা হতে হয়। সকলকে নিয়ে যেমন চলতে হবে, তেমনই উদাহরণও সৃষ্টি করতে হবে। আজকেই তো মাঠে যেমন দু’জন ভাল ক্যাপ্টেন রয়েছে। কোহালি দারুণ নেতৃত্ব দিচ্ছে। কেন উইলিয়ামসন খুব ভাল নেতৃত্ব দিচ্ছে। ওরা দু’জনে ওদের দলের জন্য দারুণ ক্রিকেটারও। বিরাট অসাধারণ ব্যাটসম্যান। যদি এখনকার কোনও ব্যাটসম্যানকে দেখার জন্য আমি পয়সা খরচ করে টিকিট কাটতে রাজি থাকি, তা হলে সেটা বিরাটই। ভাল অধিনায়কদের মধ্যে অ্যারন ফিঞ্চও রয়েছে। কঠিন সময়ে অস্ট্রেলিয়াকে নেতৃত্ব দিচ্ছে এবং ভাল করছে। আরও কয়েক জন আছে, কিন্তু এখনকার ক্রিকেটে এই তিন জনের কথা আলাদা করে বলতে চাই আমি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy