হতাশ: ৬৬ রান করে আউট হয়ে ফিরছেন বিরাট কোহালি। রবিবার বার্মিংহামে। রয়টার্স
ধরা যাক বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল। ৩০ বলে ৬০ করতে হবে। কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। ক্রিজে মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। যাঁকে ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা ‘ফিনিশার’ বলা হয়। সঙ্গী কেদার যাদব। ভারত জিতবে?
রবিবাসরীয় এজবাস্টনে যা দেখা গেল, এই অন্তিম প্রশ্নেরও আগে একটা প্রশ্ন এসে গিয়েছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি— ধোনি এবং কেদার জেতার চেষ্টা করবেন তো? এক-এক সময় এমনই উদ্ভট দেখাচ্ছিল ধোনি এবং কেদারের ব্যাটিং যে, নিজের গায়েই চিমটি কেটে দেখতে ইচ্ছে করছিল, সত্যিই লাইভ ম্যাচ হচ্ছে তো? নাকি কোনও ম্যাচের শুটিং? প্রত্যেক ওভারে যখন দরকার ১২ বা ১৩ রান করে, তখন তাঁরা খুচরো রান নিয়ে খেলা চালিয়ে যাচ্ছেন। বড় হিট হবে কি, চেষ্টাই তো নেই। শেষের আধ ঘণ্টা রুদ্ধশ্বাস থ্রিলারের মতো হওয়ার কথা ছিল। হয়ে দাঁড়াল ফ্লপ ছবি। হয়তো বলা হবে, নেট রানরেট ঠিক রাখতে সাবধানি ব্যাটিং করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ধোনিরা। কিন্তু পাঁচ উইকেট হাতে নিয়েও এমন ব্যাটিংয়ের যা ব্যাখ্যাই দেওয়া হোক, ক্রিকেট ভক্তদের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়া কঠিন।
ধোনি এবং কেদার দু’জনে মিলে ৩১ বল খেললেন। তার মধ্যে ৭টা বলে কোনও রান নেই, কুড়িটা এক রান, তিনটে চার এবং একটা ছয়। ভারত শুধু বিস্ময়কর ব্যাটিং করে ম্যাচই হারল না এজবাস্টনে, লক্ষ লক্ষ ভক্তের হৃদয় থেকেও দূরে সরে গেল। ধোনির ব্যাটিং সব চেয়ে অবাক করার মতো। তিনি দলের সিনিয়র ব্যাটসম্যান। কেদারকে তাঁরই পরিচালনা করার কথা। কিন্তু সাউদাম্পটনের ম্যাচের মতোই নিজে খোলসের মধ্যে ঢুকে পড়লেন। সঙ্গীকেও হাত খুলতে উদ্বুদ্ধ করলেন না। শেষ ওভারে গিয়ে যখন জেতার জন্য ভারতের ৪৬ রান দরকার, প্রথম বলে ছয় মারলেন ধোনি। কিন্তু তত ক্ষণে দর্শকদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গিয়েছে। বিদ্রুপাত্মক ধ্বনি ভেসে আসছে ভারতের দুই ব্যাটসম্যানের দিকে। দ্বিতীয় বলে ধোনি আবার এক রান নিতে অস্বীকার করলেন। এ বার দর্শকদের ক্ষোভ আরও ফেটে পড়ল। রোজ রোজ এই শেষ ওভারের ‘ফিনিশার ফর্মুলা’ যে কাজে দেয় না, বাজারেও যে তা জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে, সাউদাম্পটনের পরে এজবাস্টনেও প্রমাণ পাওয়া গেল। ৩১ রানে জিতে ইংল্যান্ড শেষ চারের দৌড়ে ভেসে থাকল। এখনও তারা সম্পূর্ণ ভাবে নিশ্চিত নয়, কিন্তু নিঃসন্দেহে বড় লাইফলাইন পেয়ে গেলেন অইন মর্গ্যানেরা।
ভারত এখনও টেবলের দু’নম্বরে। কিন্তু হার্দিক পাণ্ড্য এবং ঋষভ পন্থ আউট হওয়ার পরে যে রকম বিনা লড়াইয়ে ধোনি-কেদার আত্মসমর্পণ করলেন, তাতে প্রবল প্রতিক্রিয়া হতে বাধ্য। একে তো ইংল্যান্ডের প্রত্যেকটি মাঠে যে প্রবল জনসমর্থন তাঁরা পাচ্ছেন, তা জোরালো ধাক্কা খাবে। দ্বিতীয়ত, বড় রান তাড়া করার ব্যাপারে যে সংশয় ভারতীয় ব্যাটিংকে ঘিরে ছিল, তা থেকেই গেল। সব চেয়ে চিন্তার ব্যাপার হচ্ছে, ছক্কা মারার লোক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পন্থ সবে প্রথম ম্যাচ খেললেন, হার্দিক রোজ রোজ সফল হওয়ার মতো ধারাবাহিকতা এখনও দেখাতে পারেননি। ইংল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়ার মতো দল সাড়ে তিনশোর আশেপাশে তুলে দিলে কী করে তাড়া করা যাবে, এই প্রশ্ন থাকছে। ধোনি আর কেদারকে দিয়ে ‘ফিনিশারের’ কাজ আদৌ করা যাবে কি না, তা নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় হয়েছে।
সকালের দিকে মাইকেল ভন টুইট করলেন, ‘‘আমরা গুনে দেখেছি। এজবাস্টনে আজ সব মিলিয়ে ৮৬ জন ইংরেজ ক্রিকেট সমর্থক উপস্থিত হয়েছেন। আর এই সংখ্যাটা ইংল্যান্ডের টিম এবং ম্যানেজমেন্টকে ধরে।’’ গত কাল আইসিসি-র দেওয়া হিসেবে যে জল ছিল, তা আগেই অনেকে অনুমান করেছিলেন। কিন্তু এতটা জল থাকবে, ভাবা যায়নি। গ্যালারির নিরানব্বই শতাংশ ছিল ভারতীয় সমর্থকদের দখলে। কে জানত সেই প্রবল জনস্রোতই মাঠ ছাড়বে ভারতীয় দলকে ধিক্কার দিতে দিতে! একটা দুর্ধর্ষ দ্বৈরথের রুদ্ধশ্বাস শেষ দেখার অপেক্ষায় ছিলেন সকলে। মাঠে উপস্থিত নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতীয় ভক্তরা তো বটেই, এমনকি, ক্রিকেট বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য ভক্তরাও ধরে নিয়েছিলেন বিশ্বকাপের সেরা ম্যাচ মঞ্চস্থ হতে চলেছে এজবাস্টনে। তার বদলে শেষের ওভারগুলোতে যা দেখা গেল, তাকে প্রহসন ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। ধোনি ক্রিজে এসে প্রথম বল যেটা পেলেন, সেটা ব্যাট তুলে ছেড়ে দিলেন। যেন বলতে চাইছে, ‘‘অনেক দিন টেস্ট ম্যাচ খেলিনি। আজ এজবাস্টনে খেলব।’’ ৪৭তম ওভারেও ধোনিরা নিলেন পাঁচটা সিঙ্গলস। অবিশ্বাস্য!
তুলনায় ইংল্যান্ডের ইনিংস দারুণ ভাবে শুরু করার পরেও মহম্মদ শামি যখন ম্যাচে ফেরালেন, তার পরেও মর্গ্যানের দল ছাড়ল না। বেন স্টোকস ৫৪ বলে ৭৯ করে ইংল্যান্ডকে সাত উইকেটে ৩৩৭-এর স্কোরে পৌঁছে দিলেন। স্টোকস এমন একটা শট খেললেন, যা ক্রিকেটে বিপ্লব এনে দিতে বাধ্য। যুজবেন্দ্র চহালকে তিনি মারলেন রিভার্স স্লগ সুইপ। মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল, সুইচ হিট মারলেন। বল সোজা গিয়ে পড়ল গ্যালারিতে। নিজেদের দেশে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে যাওয়ার মতো চাপ এসে পড়েছিল তাঁদের উপরে। প্রাক্তনেরা বলছিলেন, বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিলে ইংল্যান্ডের ক্রিকেট ইতিহাসের সব চেয়ে বড় বিপর্যয় হবে। সে রকম পরিস্থিতিতে দুঃসাহসিক মানসিকতা বের করলেন স্টোকসরা। দুই ওপেনার জনি বেয়ারস্টো এবং জেসন রয়ও সাবধানী শুরু করেছিলেন। যশপ্রীত বুমরার ওপেনিং স্পেল দেখে দেখে খেলে দিলেন তাঁরা। কিন্তু যখন গিয়ার তোলার সময় হল, ঠিকই তুললেন। ধোনিদের মতো সিটবেল্ট বেঁধে জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকলেন না। বেয়ারস্টো দুরন্ত খেলে গিয়েছেন আইপিএলে। সানরাইজার্স হায়দরাবাদে পাশে পেয়েছেন ভিভিএস লক্ষ্মণকে। স্পিন খেলায় মাস্টার লক্ষ্মণ। তাঁর থেকে পাঠ নিয়ে লক্ষ্মণের দেশের স্পিনারদের তুলোধনা করে গেলেন। একটা সময়ে কুল-চা জুটি তাঁদের প্রথম দশ ওভারে দিয়ে দিয়েছিল ৯০-এর উপর। ১০৯ বলে ১১১ করলেন বেয়ারস্টো। একাই মারলেন ছ’টা ছক্কা। ভারতীয় ইনিংসে সেখানে সব মিলিয়ে হল মাত্র একটা ছক্কা। এজবাস্টনে গব্বরের ঢংয়ে বলতেই পারেন বেয়ারস্টো, ‘‘জো ডর গয়া, মর গয়া।’’
তিনটে অসাধারণ ক্যাচ দেখা গেল এই ম্যাচে। রবীন্দ্র জাডেজার অসাধারণ ক্যাচ তবু ভারতকে ম্যাচে ফিরিয়েছিল। লং অনে সামনে ঝাঁপিয়ে পরিবর্ত ফিল্ডার হিসেবে যে ক্যাচ নিলেন জাডেজা, তাতে ইংল্যান্ডের ওপেনিং জুটির ঝড় থামাল। এর পর শামি এবং বুমরা মিলে চাপ বাড়ালেন ইংল্যান্ডের ব্যাটিংয়ের উপর। কুল-চা কিছুটা হলেও ছন্দ ফিরে পেলেন। ইংল্যান্ড যখন ইনিংস শেষ করল, দর্শকদের মধ্যেও দেখা গেল ব্যস্ততা। দ্রুত খাবারের প্যাক নিয়ে ফিরে গিয়ে বসতে হবে সিটে। একটাও বল মিস করা যাবে না এই ম্যাচের। চেজমাস্টার কোহালি আর ফিনিশার ধোনি যে টিমে আছেন, তাঁরা এক-আধবার ৩৩৭ তাড়া করতে পারবে না?
রোহিত আর কোহালি যত ক্ষণ ছিলেন, তত ক্ষণ গাড়ি ঠিকঠাক হাইওয়ে ধরে যাচ্ছিল। রোহিত ১০২ করলেন ১০৯ বলে। কোহালি ফের হাফসেঞ্চুরি পেলেন, আবার বলা যেতে পারে ফের সেঞ্চুরি হারালেন। এ সব দিনে পঞ্চাশ নয়, তিনি বড় সেঞ্চুরি করে পথ না দেখালে এখনও দিগ্ভ্রষ্ট দেখায় ভারতীয় ব্যাটিংকে।
মঙ্গলবার বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ম্যাচ। তার আগে রবিবাসরীয় এজবাস্টনে যদিও শুধু পথভ্রষ্ট নয়, রোগাক্রান্তও দেখাল কোহালির ভারতকে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy