Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

শ্রীপুরের ময়দানে যেন ‘বেন্ড ইট লাইক বেকহ্যাম’

এঁদের প্রত্যেককেই হয়তো অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার লড়াই করে যেতে হয়। বাধা, বঞ্চনার জবাব দেওয়ার জন্য লড়াকু মেয়েরা বেছে নিয়েছেন আজ এই ময়দানকে। লিখছেন জাহির রায়হান বর্ধমানের কেতুগ্রাম থানার শ্রীপুরে আমার মামাশ্বশুরের বাড়ি। হেমন্তের আগমনে মাঠ ভরে হলুদে, সবুজে মাখামাখি আমন ধান। অগ্রহায়ণই তো পরিশ্রমের ফসল তোলার সময়। এ সময়ে শ্রীপুরের ঘরে ঘরে খুশির বান ডাকে। মহা সমারোহে পালিত হয় নবান্ন, গ্রামবাসী যাকে ডাকে ‘নবান’ বলেন।

জমে উঠেছে খেলা। শ্রীপুরের মাঠে। ছবি: লেখক

জমে উঠেছে খেলা। শ্রীপুরের মাঠে। ছবি: লেখক

জাহির রায়হান
শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০১৮ ০০:৪০
Share: Save:

সাবিনা আর রুবিনা। সহোদর দু’বোন। এক জনের জার্সি নম্বর ‘ছয়’, অন্য জনের ‘নয়’। এঁরা দু’জনেই আজ সমাজ, পরিবারের অচলায়তন, গত বাঁধা মানসিকতাকে আক্ষরিক অর্থেই নয়-ছয় করে দাপাচ্ছেন ফুটবল মাঠে। মাঠে উপস্থিত প্রায় হাজার দেড়েক মানুষ। বুড়ো, যুবক, অবিবাহিতা তরুণী, গাঁয়ের বধূ, শিশু— সবাই আছেন সে দলে। তাঁদের সামনেই শম্পা মাল তীব্র গতিতে ছুটে চলেছেন ফুটবলের পিছে পিছে। গ্রামের অগণিত মানুষ বিস্ফারিত চোখে দেখছেন চিত্তরঞ্জনের রূপালি বাউড়ি কী ভাবে বিপক্ষের রক্ষণ ভেঙে বল জড়িয়ে দিচ্ছেন জালে। সাক্ষী ছিলাম সেই লড়াইয়ের।

বর্ধমানের কেতুগ্রাম থানার শ্রীপুরে আমার মামাশ্বশুরের বাড়ি। হেমন্তের আগমনে মাঠ ভরে হলুদে, সবুজে মাখামাখি আমন ধান। অগ্রহায়ণই তো পরিশ্রমের ফসল তোলার সময়। এ সময়ে শ্রীপুরের ঘরে ঘরে খুশির বান ডাকে। মহা সমারোহে পালিত হয় নবান্ন, গ্রামবাসী যাকে ডাকে ‘নবান’ বলেন। শ্রীপুরের এই উৎসবের কথা শুনেছিলাম সহধর্মিনীর কাছেই। ছোটবেলার নানা সুখস্মৃতি তিনি শুনিয়েছিলেন আমায়। ধর্ম ও সম্প্রদায় ভিত্তিক পরবের বাইরে নিশ্চিত ভাবে রাখা যায় নবান্নকে। সব বর্ণ, ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষের একত্রে উদ্‌যাপনের এত বড় উপলক্ষ আর বুঝি বা নেই! সেই অনুভূতির আঁচ পেতে আমিও পৌঁছেছিলাম শ্রীপুরে। এ বছর অগ্রহায়ণে।

মাঠ থেকে বয়ে আনা নতুন আতপ চাল গুঁড়োর সঙ্গে চিনি, নারকেল-সহ আরও নানা কিছু মাখিয়ে তৈরি মিশ্রণটির স্বাদ আগে কখনও জোটেনি। খাওয়ার আয়োজনও প্রচুর। মাইকে গান বাজছে সারা গ্রাম জুড়ে। কিন্তু এ সব ছাড়িয়ে যখন শুনলাম নবান্ন উপলক্ষে দিঘির পাড়ের মাঠে একটি মহিলা প্রীতি ফুটবল ম্যাচের আয়োজন করেছে স্থানীয় শ্রীপুর যুব সঙ্ঘ, তখন নবান্ন ভিন্ন মাত্রা পেল। মনে রাখতে হবে শ্রীপুর কোনও ভাবেই শহর নয়। গ্রাম বাংলার একটি সাধারণ জনপদ। উচ্চশিক্ষিতের সংখ্যাও বেশি নয়। অথচ, সব জড়তা ও সংস্কারের দৈন্যকে দূরে সরিয়ে সে গ্রামেই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে কিশোরী, তরুণীদের। ফুটবল খেলার জন্য।

ঠিক সময়ে টিকিট কেটে মাঠে ঢুকলাম। বিনে পয়সায় খেলা দেখা যাবে না। মেয়েরাও অর্জন করেছে সেই সম্মান, সেই অধরা স্বীকৃতি যে জন্য বিনা বিরক্তিতেই টিকিট কেটে গ্রামবাসী ভরিয়ে ফেলেছেন আয়তাকার মাঠের চারদিক। মাঠের পাশের বাড়ির ছাদ, চিলেকোঠায় থিকথিকে ভিড়। সকলের চোখেই উৎসাহ, উদ্দীপনা। মহিলাদের চোখেমুখে আপাত কাঠিন্য। মাঠে যাঁরা খেলবেন তাঁরা অগোচরে হয়তো এই গ্রামের মহিলাদেরই প্রতিনিধি। হয়তো তাঁদের মাথায় কাজ করছে অনেক যন্ত্রণা, উপেক্ষা, অপমান, লাঞ্ছনা, গঞ্জনার জবাব গিতে হবে। ফুটবলের গায়ে সপাটে লাথি উড়িয়ে নিয়ে যাবে সেই সব প্রাচীন, অযৌক্তিক, অচল ধ্যানধারণাকে যা মেয়েদের প্রতিনিয়ত, প্রতিদিন বেঁধে রাখে। ঠিক যেমনটা হয়েছিল গুরিন্দর চড্ঢার ‘বেন্ড ইট লাইক বেকহ্যাম’ (২০০২) ছবিতে।

বাঁশি বাজার সঙ্গে সঙ্গেই মাঠ জুড়ে শুরু হয়ে গেল বল্গাহীন কন্যাদের দাপাদাপি। বল দখল ও কেড়ে নেওয়ার মরণপণ লড়াই। সে লড়াইয়ে কেউ কাউকে এক ইঞ্চি জমি ছাড়তে নারাজ। সমানে সমানে টক্কর। খেলোয়াড়দের শরীরী ভাষায় ফুটে বেরোচ্ছে হার না মানা জেদ, বহু কাঁটায় ভরা পথ পেরিয়ে এসে আজ জনসমক্ষে নিজেদের প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা। এঁদের প্রত্যেককেই হয়তো অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার লড়াই করে যেতে হয়। আজ সে সব বাধা, বঞ্চনার জবাব দেওয়ার জন্য লড়াকু মেয়েরা বেছে নিয়েছেন এই চারকোণা ময়দানকে। তাঁরাও যে মানুষ, এ পৃথিবীর রূপ, রস, গন্ধে তাঁদেরও যে সমান অধিকার রয়েছে তা যেন বুঝিয়ে দিতে চান প্রতি পদে। সামাজিক, পারিবারিক শীতল রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আজ তাঁদের বুঝে নেওয়ার লড়াই।

চোখের সামনে সে লড়াই দেখতে দেখতে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছি দূরে, বহু দূরে...। আমার এক বোনকে বাড়ি থেকে শাড়ির ব্যবসা করতে বারণ করা হয়েছিল পাছে বিয়ে দিতে সমস্যা হয়। আমার এক সম্পর্কিত বোনের বিয়ে বার বার ভেঙে যাচ্ছিল, তাঁর গায়ের রঙ কালো বলে।

এখনও বহু বাড়িতেই মাছের সব চেয়ে সুস্বাদু, বড় অংশটা বাড়ির রোজগেরে ছেলের পাতে পড়ে, পাশে বড় দিদি বা বোন থাকা সত্ত্বেও। এখনও শুধু পুত্র সন্তানের আশায় বহু বাড়িতে পর পর সন্তান নেওয়া হয়। কন্যা হলে কুঁচকে ওঠে পরিবারের সদস্যদের মুখমণ্ডল। অপরাধে কুন্ঠিত হয়ে ওঠেন সদ্য মা। শিক্ষায়, সুযোগে বঞ্চিত রাখা হয় পরিবারের কন্যা সন্তানটিকে। জন্মের পরে নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে নিদারুণ লড়াই লড়তে হয় নারীদেরই। মেয়ে জন্মালেই অনেক পরিবারের কর্তা পড়েন দুশ্চিন্তায়। কোনও রকমে বড় করে বিয়ে দিতে পারলেই বুঝি যাবতীয় সমস্যার নিশ্চিত সমাধান হয়ে যাবে। নারীর বুঝি আলাদা অস্তিত্ব থাকতে নেই। পুরুষের নিয়ন্ত্রণেই থাকবে তাঁর জীবনপ্রবাহ। আর জন্মানোর আগেই লিঙ্গ নির্ধারণ ও কন্যাভ্রুণ হত্যার মতো ঘটনা ঘটে চলে আকছার। সমাজ সব দেখে শুনেও চোখ, কান বন্ধ করে রেখে দেয়।

গো-ও-ল... হাততালি আর কলরবে সম্বিৎ ফিরল। আহত এক কিশোরী ফুটবলারের প্রাথমিক পরিচর্যায় মাঠে ছুটে চলেন ডাক্তার, জলের বোতল হাতে পৌঁছে যান ক্লাবের যুবক প্রতিনিধি। খেলা শেষ হল। স্থানীয় ক্লাব দুই শূন্য গোলে হারিয়ে দিয়েছে চিত্তরঞ্জনের একটি ক্লাবকে। মাইকে ঘোষণা হয়, খেলা শেষে মাঠের মধ্যে কোনও দর্শকই যেন অনধিকার প্রবেশ না করেন। আগত ফুটবলাররা শ্রীপুর গ্রামের অতিথি, তাঁদের সম্মান রক্ষার দায়ও তাই গ্রামবাসীদের। হয়ও তাই, ম্যাচ শেষে যুবকদের কর্ডনে মঞ্চের সামনে হাজির হন নাসিমা, জুলি, মিতালি, রূপালিরা। সমবেত দর্শকের আন্তরিক অভিবাদন ও করতালিতে মুখর হয়ে ওঠে লড়াইয়ের ময়দান। হার-জিত সরিয়ে রেখে পতপত করে উড়তে থাকে নারীশক্তির বিজয় পতাকা। অভিবাদনের আন্তরিকতায় খেলোয়াড়দের চোখের কোণও যেন চিকচিক করে ওঠে। দু’দলের খেলোয়াড়েরা সমবেত ভাবে একশো গোলে হারিয়ে দিয়েছেন পুরুষশাসিত সমাজের জগদ্দলকে।

লেখক বেলডাঙা এসআরএফ কলেজের ইংরেজির শিক্ষক

অন্য বিষয়গুলি:

Football Girl Ingnorance Society
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy