রাহুল দ্রাবিড় ও গ্রেগ চ্যাপেলের সঙ্গে আলোচনায় সৌরভ। —ফাইল চিত্র।
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে একেবারেই পছন্দ করতেন না গ্রেগ চ্যাপেল। আর সেই অপছন্দই টিম ইন্ডিয়া থেকে ছিটকে দিয়েছিল বঙ্গসন্তানকে। ফাঁস করলেন প্রাক্তন জাতীয় নির্বাচক রঞ্জীব বিসওয়াল।
২০০৫ থেকে ২০০৭, জাতীয় দলের কোচ ছিলেন গ্রেগ। সেপ্টেম্বরে জিম্বাবোয়ে সফরে গিয়েছিল ভারত। বুলাওয়েতে প্রথম টেস্টে সেঞ্চুরি করেছিলেন সৌরভ। জেতেন টেস্ট সিরিজ। কিন্তু টেস্ট সিরিজ জয়ী অধিনায়ককেই ছেঁটে ফেলা হয় এর পর। ক্রিকেটের ইতিহাসে যার নজির বিরল।
জিম্বাবোয়েতেই কোচ-ক্যাপ্টেন সংঘাতের আগুন জ্বলে উঠেছিল। অধিনায়কের বিরুদ্ধে পাঠানো কোচের ইমেল প্রকাশ্যে আসায় তা চরমে ওঠে। জাতীয় দল থেকে ছিটকে যান সৌরভ। নতুন অধিনায়ক রাহুল দ্রাবিড়কে পাশে নিয়ে দলে জাঁকিয়ে বসেন গ্রেগ। কেন বাদ পড়তে হয়েছিল সৌরভকে? আনন্দবাজার ডিজিটালকে প্রাক্তন নির্বাচক সরাসরি বললেন, “সৌরভকে সহ্য করতে পারত না গ্রেগ। এটাই মোদ্দা কারণ, জিম্বাবোয়ে সফরের পর যখন সৌরভ বাদ পড়েছিল, তখন আমি নির্বাচক ছিলাম না। তখন কী হয়েছিল তা আমার জানা নেই। তবে ড্রেসিংরুমের স্টোরি লিক হয়েছিল, যা খুব দুর্ভাগ্যের ছিল। আমি পরের বছর নির্বাচক হয়েছিলাম। তখনই উপলব্ধি করি যে গ্রেগ নিজের মতো করে সাজাতে চাইছে দল। আমাদের মানসিকতা, আমাদের ভাবনাচিন্তাকে সামান্যতম গুরুত্ব দিতেও চাইছে না। সৌরভের সঙ্গে সমস্যার কারণ এটাই।”
জিম্বাবোয়েতে সৌরভ-গ্রেগ। সমস্যার শুরু এই সফর থেকেই। —ফাইল চিত্র।
শুধুই পছন্দ নয়, সৌরভ-গ্রেগ সংঘাতকে আদর্শের ঠোকাঠুকি বলেও মনে করেন অনেকে। দলের রিমোট কার হাতে থাকবে, সেটাই নাকি ছিল সংঘাতের নেপথ্যে। ক্রিকেটের প্রাচীন অরণ্য প্রবাদ বলে, অধিনায়কই বস। গ্রেগ কি সেই কর্তৃত্বই পেতে পেয়েছিলেন? বিসওয়াল সিলমোহর দিলেন, “হ্যাঁ, একদমই ঠিক।” অর্থাৎ, পরাক্রান্ত ক্যাপ্টেনকে সরিয়ে ক্ষমতা দখলই ছিল অগ্রাধিকার। যা করতে গিয়েই ভুলে যাওয়া যে তাঁর কোচ হওয়ার পিছনে সৌরভেরই ছিল বড় ভূমিকা। অবশ্য কাজ হয়ে গেল উপকার আর মনে রাখা সব সময় কাজের নয়! গ্রেগও তা রাখেননি।
গুরু গ্রেগ। সেই জমানায় এ ভাবেই চিহ্নিত হতেন ইয়ান চ্যাপেলের ভাই। সম্প্রতি সেই জমানাকে ভারতীয় ক্রিকেটের সবচেয়ে খারাপ সময় হিসেবে চিহ্নিত করেছেন হরভজন সিংহ। বলেছেন, দলে বিভাজন সৃষ্টি করাই ছিল কোচের লক্ষ্য। একা ভাজ্জি নন, যুবরাজ সিংহ থেকে শুরু করে সচিন তেন্ডুলকর পর্যন্ত কোনও না কোনও সময়, কোনও না কোনও ভাবে গ্রেগের বিরুদ্ধে মন্তব্য করেছেন। কেন সিনিয়র ক্রিকেটারদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছিলেন অজি কোচ? নির্বাচক হিসেবে সেই সময়ের ঘটনাপ্রবাহের সাক্ষী রঞ্জীব বিসওয়াল বললেন, “গ্রেগ ছিল অজি, কর্তৃত্ব করাই ছিল লক্ষ্য। সিনিয়র ক্রিকেটাররা যে সম্মান পেতে অভ্যস্ত, তা দিত না গ্রেগ। ফলে, দলের মধ্যে সমস্যা বাড়ছিল। সিনিয়ররা স্বচ্ছন্দ বোধ করত ন একদম। আমাদের দেশের মানসিকতা আলাদা। ভারতীয় ক্রিকেটারদের কমফোর্ট জোনে আনলে পারফরম্যান্স মেলে। গ্রেগ এটা মানতে রাজি ছিল না একেবারেই। ফলে, সিনিয়ররা অনিশ্চয়তায় ভুগছিল।”
আরও পড়ুন: প্রথা ভেঙে পাল্টাচ্ছে আইপিএল ফাইনালের দিন?
একা গ্রেগই কি সবকিছুর জন্য দায়ী? সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় নিজেই তো হালফিল সিস্টেমকে দায়ী করেছেন। সৌরভের মতে, নির্বাচনী সভায় ভোট দেওয়ার ক্ষমতাহীন গ্রেগ নিশ্চয়ই বাকিদের সমর্থন পেয়েছিলেন। না হলে কেনই বা তিনি সর্বেসর্বা হয়ে উঠবেন? বিসওয়াল বললেন, “দেখুন, নির্বাচনী বৈঠকে কী ঘটেছিল সেই সময় তা প্রকাশ্যে আনা উচিত নয়। আমি তা আনতে চাইও না। তবে গ্রেগের জোরালো বক্তব্য থাকত। অধিনায়ক রাহুল দ্রাবিড়ও তা সমর্থন করত। আর নির্বাচক হিসেবে কোচ-ক্যাপ্টেন যা চাইবে, তা পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আগেও বলেছি, সিনিয়র ক্রিকেটারদের কখনই ভরসা দেয়নি গ্রেগ। টিম তৈরি করতে হয়। কোচ-ক্যাপ্টেন-সিনিয়ররা বসে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কিন্তু গ্রেগ কখনই এটা করেনি। ফলে কোচ হিসেবে সফলও হতে পারেনি।”
২০০৬ সালের গোড়ায় পাকিস্তানে গিয়েছিল দ্রাবিড়ের ভারত। জাতীয় নির্বাচক হিসেবে সফরসঙ্গী হয়েছিলেন বিসওয়াল। মনে আছে, মাঠে দাঁড়িয়ে চ্যাপেল-দ্রাবিড়ের সঙ্গে সৌরভের লম্বা আলোচনার কথা। পরিষ্কার ইঙ্গিত মিলছিল, একসুরে বাজছে না দল। লাহৌরে প্রথম টেস্টে ব্যাটিং আসেনি। ফয়সলাবাদে দ্বিতীয় টেস্টে বাদ পড়েন সৌরভ। করাচিতে তৃতীয় টেস্টে দুই ইনিংসেই করেন ত্রিশের বেশি রান। সেটা ছিল জানুয়ারি। সৌরভ ফের টেস্ট ক্রিকেটে ফেরেন ডিসেম্বরের দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে। ঘরোয়া ক্রিকেটের ক্রমাগত পরীক্ষা দিয়ে বাধ্য করেন দলে ফেরাতে।
ফেলে আসা সেই অগ্নিগর্ভ দিনে ফিরে গেলেন বিসওয়াল। বললেন, “গ্রেগের যতই আপত্তি থাক, দলে ফিরেছিল সৌরভ। ওর দক্ষতা নিয়ে আমাদের মধ্যে তো কোনও সংশয় ছিল না। আর ক্রীড়াবিদদের চিরকাল সমান যায় না। কোনও ব্যাটসম্যানই কেরিয়ার জুড়ে একই রকম ভাবে রান করতে পারে না। ভাল সময়ের মতো খারাপ সময়ও আসে। আর সৌরভ কেমন ব্যাটসম্যান তা তো ওর পরিসংখ্যানেই প্রতিফলিত। ওর দক্ষতা, সেরা বোলিং আক্রমণের বিরুদ্ধে রান করার ক্ষমতা কারও অজানা ছিল না।”
ভারতের যুব দলের অধিনায়ক থাকার সময় থেকেই সৌরভকে চেনেন বিসওয়াল। বললেন, “সেটা ১৯৮৮-’৮৯। আমার নেতৃত্বে পাকিস্তান ট্যুরে ও গিয়েছিল। তখনই নজরে পড়েছিল ব্যাটিং প্রতিভা। রান করেছিল। আবার বলছি ওর দক্ষতা নিয়ে কখনই প্রশ্ন ছিল না। এর পর ১৯৯১-’৯২ মরসুমে অস্ট্রেলিয়ায় গিয়েছিল। তখন ব্যাটিং অর্ডারে হেভিওয়েটদের ভিড়। নিজেকে প্রমাণ করার যথেষ্ট সুযোগ ও পায়নি। চার বছর পর ফিরে এসেছিল তৈরি হয়ে। থাকার জন্যই। কামব্যাক এমন ভাবে করেছিল যে নিজের জায়গা পাকা করে ফেলেছিল দলে।”
সৌরভের হাত থেকে দলের নিয়ন্ত্রণ ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিলেন গ্রেগ। —ফাইল চিত্র।
দক্ষিণ আফ্রিকা সফরেও তেমনই রাজকীয় ভাবে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন সৌরভ। বিসওয়ালের মনে আছে তার আগের কাহিনি। গুয়াহাটিতে দলীপ ট্রফির ম্যাচে খেলছিলেন সৌরভ। যে ম্যাচের উপর তাঁর ভবিষ্যত নির্ভর করছিল অনেকটাই। বিসওয়াল বললেন, “সৌরভ যে দিন সেঞ্চুরি করল, তার আগের দিন বিকেলে বোমা বিস্ফোরণ হয়েছিল গুয়াহাটিতে। সৌরভ তখন অল্প রানে অপরাজিত। আমি ওখানে ছিলাম আর এক নির্বাচক ভেঙ্কটপতি রাজুর সঙ্গে। কিন্তু ম্যাচ তো বন্ধ হয়ে যায় যায় নিরাপত্তার কারণে! আমরা পুলিশকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলাম যাতে ম্যাচ পরের দিন করা যায়। অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে বলেছিলাম বাড়তি পুলিশ আনতে। পরামর্শ দিয়েছিলাম, মাঠ ফাঁকা করে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় মুড়িয়ে দিয়ে খেলা করতে। তাই হয়েওছিল। আর সৌরভ সেঞ্চুরিও করেছিল।”
সেই ইনিংসে রান না পেলেও কি জাতীয় দলে ফিরতেন সৌরভ? বিসওয়াল বললেন, “দেখুন, আবার বলছি, সৌরভের ট্যালেন্ট নিয়ে সংশয় ছিল না। কিন্তু কামব্যাক করার জন্য রান করতেই হত। আর সেই ম্যাচে রান করেছিল ও। ফলে জাতীয় দলে ফিরে আসে।” গ্রেগ তখন বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেননি? ভেসে এল হাসি। বোঝা গেল, ইচ্ছা না থাকলেও সৌরভকে হজম করতে হয়েছিল গ্রেগকে। না করে উপায় ছিল না বলেই!
আরও পড়ুন: ‘কিক’ তত্ত্ব উড়িয়ে ‘দলের সম্পদ’ ঋষভকে আরও সুযোগ দিতে বলছেন কোচ
ভারতীয় ক্রিকেটে সৌরভের অবদান কী? বিসওয়াল অপকট, “সৌরভ কী ভাবে জাতীয় দলের চেহারা বদলে দিয়েছিল কঠিন সময়ে নেতৃত্বে এসে, তা সবারই জানা ছিল। তখন ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অভিযোগে ভারতীয় ক্রিকেটে ছিল তীব্র অবিশ্বাসের আবহ। প্রচুর বিতর্ক ঘিরে ধরেছিল। সৌরভ নেতৃত্বে এসে ভারতীয় দলকে লড়াই করতে শেখাল। ফাইটিং মেশিনে পরিণত করল। মহেন্দ্র সিংহ ধোনি সেই দলকেই এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। চ্যাম্পিয়ন করিয়েছিল। কিন্তু ভিতটা গড়েছিল সৌরভই।”
বিসওয়াল ফের ফিরলেন গ্রেগে। ২০০৭ বিশ্বকাপে প্রথম রাউন্ডে ছিটকে গিয়েছিল দ্রাবিড়ের দল। গ্রেগ-বিদায়ের দামামা বেজেছিল তার পরই। নেপথ্য কাহিনি সামনে আনলেন ওড়িশার প্রাক্তন ক্রিকেটার। বললেন, “সেই বিশ্বকাপ ভারতীয় দলের ম্যানেজার ছিলাম আমি। ব্যর্থতার পর ফিরে এসে রিপোর্ট দিয়েছিলাম বোর্ডকে। রিপোর্টে ঠিক কী লিখেছিলাম তা বলতে পারব না। তবে চ্যাপেলের বিরুদ্ধেই তা ছিল, এটাতে লুকোছাপার কিছু নেই। দেশে ফিরে শ্রীনি-স্যার ও শশাঙ্ক মনোহরের সঙ্গে কোচ নিয়ে আলোচনাতেও আমি উপস্থিত ছিলাম। তার পর ক্রিকেটারদের মতামত নেওয়া হয়েছিল।”
নিয়তির পরিহাস, যে ক্রিকেটারদের ভবিষ্যত নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছিলেন, সেই ক্রিকেটারদের মতামতেই কার্যত দাঁড়ি পড়ে গ্রেগের কোচিং জীবনে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy