সৌদি সমর্থকদের উচ্ছ্বাস। ছবি রয়টার্স।
সবুজ বিজয়-কেতন উড়িয়ে ঝড়ের গতিতে হাইওয়ে দিয়ে ছুটে চলেছে গাড়িগুলো। কাতার থেকে সৌদি আরবের দূরত্ব সড়কপথে এক ঘণ্টারও কম। সীমান্তে কড়াকড়ি বিশেষ নেই। ৫৩ মিনিটে সালেম আলদাওয়াসরি ২-১ করে দেওয়ার পর থেকেই সীমান্ত পেরিয়ে গাড়ি নিয়ে কাতারে ঢুকে পড়েন সৌদি আরবের বহু ফুটবলপাগল বাসিন্দা। শুরু হয়ে যায় উৎসব।
হাইওয়ের ধারেই গাড়ি থামিয়ে সাদা থোব (মরুদেশের বাসিন্দাদের পোশাক) পরে পাগলের মতো চিৎকার করছিলেন ও নাচছিলেন আমির, আজ়াকতরা, হাফিজ়রা। বলছিলেন, ‘‘আমরাও যে ফুটবল খেলতে পারি, তা গোটা বিশ্বকে দেখিয়ে দিলাম আজ।’’
বিশ্বকাপে ফের এক বার স্বপ্নভঙ্গের আশঙ্কায় সৌদি সমর্থকদের উৎসব দেখছিলেন দুই মেয়েকে নিয়ে আর্জেন্টিনা থেকে আসা ইউলিয়া। তাঁর গালের নীল-সাদা রং তত ক্ষণে ধূসর হয়ে গিয়েছে চোখের জলে। লুসেল কিউএনবি মেট্রো স্টেশনের সামনে মাটিতেই দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে রয়েছেন লিয়োনেল মেসির জন্মস্থান রোসারিয়োর তিন যুবক— পাবলো, লিয়ো ও সেবাস্তিয়ান।
কে ভেবেছিলেন যে, মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বদলে যাবে আমির, ইউলিয়া, পাবলোদের পৃথিবী।
বুয়েনোস আইরেস থেকে দুই মেয়েকে নিয়ে চব্বিশ ঘণ্টা আগেই দোহা এসেছেন ইউলিয়া। মঙ্গলবার সকাল থেকেই মুখে নীল-সাদা রং মেখে লুসেল কিউএনবি মেট্রো স্টেশনের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আর্জেন্টিনার সমর্থকদের দেখলেই এগিয়ে গিয়ে তাঁদের গালেও নীল-সাদা রং করে দিচ্ছিলেন। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলছিলেন, ‘‘এ বার আমাদের আটকানোর মতো শক্তি কোনও দলের নেই। আর্জেন্টিনাই চ্যাম্পিয়ন হবে। ১৮ ডিসেম্বর এই লুসেল স্টেডিয়ামে মেসির হাতেই বিশ্বকাপ উঠবে।’’
মঙ্গলবার ভোর চারটের মধ্যে লুসেল স্টেডিয়ামের সামনে পৌঁছে গিয়েছিলেন আর্জেন্টিনা থেকে আসা তিন যুবক। তিন জনেরই মোবাইল ফোনেই পাশাপাশি দু’টি ছবি। ১৯৮৬ সালে বিশ্বকাপ জয়ের পরে ট্রফি হাতে দিয়েগো মারাদোনা। তার ঠিক পাশেই ছবি লিয়োনেল মেসির হাসিমুখ। স্থির দৃষ্টিতে তিন জন যে ভাবে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়েছিলেন, মনে হচ্ছিল যেন ধ্যান করছেন। গত শুক্রবার কাতার এসেছেন তাঁরা। তার পর থেকে প্রত্যেক দিন নিয়ম করে সকাল দশটার মধ্যে লিয়োরা গিয়েছেন দোহার ডাউন-টাউনে দিয়েগো মারাদোনাকে নিয়ে শুরু হওয়া প্রদর্শনী দেখতে। প্রয়াত কিংবদন্তির ব্যবহৃত বুট, জার্সি ছাড়াও অসংখ্য স্মরণীয় মুহূর্তের ছবি রয়েছে। সেখান থেকে সরাসরি চলে গিয়েছেন কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের যে হস্টেলে মেসিরা এখন রয়েছেন, সে দিকের গেটে। আরও কোথাও যাওয়ার আগ্রহ নেই তাঁদের। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে সেবাস্তিয়ান বললেন, ‘‘কাতারে আমরা বেড়াতে আসিনি। ৩৬ বছর বিশ্বকাপ জিততে পারিনি। আগে চ্যাম্পিয়ন হই, তার পরে অনেক সময় পাওয়া যাবে বেড়ানোর, ফূর্তি করার।’’ ইউলিয়ার মতো সেবাস্তিয়ানের গলায় তখনও হুঙ্কার, ‘‘সৌদি আরবকে আজ বড় ব্যবধানে হারিয়েই বিশ্বকাপে যাত্রা শুরু করবে আর্জেন্টিনা।’’
খেলা শুরুর আগে পর্যন্ত ইউলিয়া, সেবাস্তিয়ানের মতো আর্জেন্টিনার বহু সমর্থকই মনে করছিলেন, বিশ্বকাপে মেসিদের চ্যাম্পিয়ন হওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। সোমবার রাত থেকেই যে ভাবে সর্বত্র উৎসব শুরু করে দিয়েছিলেন আর্জেন্টিনার সমর্থকেরা, মনে হচ্ছিল যেন সৌদি আরবের বিরুদ্ধে মাঠে নামার আগেই ম্যাচ জিতে গিয়েছেন মেসিরা। মেট্রো স্টেশন থেকে রাস্তা— ম্যাচের আগে ভামোস আর্জেন্টিনা...ভামোস মেসি...ধ্বনিতে কুঁকড়ে থাকা সৌদি আরবের সমর্থকেরা নিঃশব্দে হাঁটছিলেন। ম্যাচ শেষের পরে আর্জেন্টিনার সমর্থকদেরও একই হাল। তাঁরা হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন যে, বিশ্বকাপ ফুটবলে অঘটনের ইতিহাস। ১৯৯০ সালে বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই ক্যামেরুনের কাছে ০-১ গোলে হেরে গিয়েছিল দিয়েগো মারাদোনার আর্জেন্টিনা। পরে অবশ্য ফাইনালে উঠেছিলেন মারাদোনারা। কিন্তু জার্মানির কাছে হেরে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন ভেঙে যায় তাঁদের। ১৯৯৮ সালে ব্রাজিলকে হারিয়ে বিশ্বকাপ জেতা ফ্রান্সেরও একই হাল হয়েছিল চার বছর পরে। ২০০২-এর বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচেই সেনেগালের কাছে ০-১ গেলে হেরেছিলেন থিয়েরি অঁরিরা।
বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার পরের ম্যাচ মেক্সিকোর বিরুদ্ধে আগামী শনিবার। এই ম্যাচের উপরে বিশ্বকাপে মেসিদের ভবিষ্যৎ অনেকটাই নির্ভর করবে। আর্জেন্টিনা কি পারবে লক্ষ্যে পৌঁছতে? চোখের জল মুছে সেবাস্তিয়ান বলে গেলেন, ‘‘নব্বইয়ের বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচ হেরেও আমরা ফাইনালে উঠেছিলাম।’’
রাস্তা কঠিন। তবু স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণার বিকেলে প্রত্যাবর্তনের স্বপ্ন মারাদোনার দেশের মানুষের মনে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy