আপ্লুত আকবর শোনালেন আকর্ষণীয় কাহিনি, ‘‘বছর দশেক আগের ঘটনা। সুরজিতের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল শ্যামল (ঘোষ)। ওর পাড়াতেই একটি অনুষ্ঠান ছিল। সুরজিতের অনুরোধে চলে গিয়েছিলাম সেই অনুষ্ঠানে। ঘণ্টাখানেক টানা গেয়েছিল ও। একা আমি নই অন্যান্য শ্রোতারাও মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসেছিল।’’
ভারতীয় ফুটবলে তিনি ছিলেন বরাবরের ব্যতিক্রমী চরিত্র। আপাত দৃষ্টিতে শান্ত ও স্থিথধী। কিন্তু পায়ে বল পড়লেই সুরজিৎ সেনগুপ্ত হয়ে উঠতেন ভয়ঙ্কর। বিদ্যুৎ গতিতে ডান প্রান্ত দিয়ে বল নিয়ে উঠতেন বিপক্ষের প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দিয়ে। খেলা শেষ হওয়ার পরেই তিনি ডুবে যেতেন সঙ্গীত, সাহিত্য, নাটকে। কখনও তবলায় ঝড় তুলতেন। কখনও আবার সুরের মুর্ছনায় ভাসিয়ে নিয়ে যেতেন শ্রোতাদের। বন্ধুর গান শুনতেই হায়দরাবাদ থেকে কলকাতায় ছুটে এসেছিলেন মহম্মদ আকবর!
বৃহস্পতিবার দুপুরে সুরজিতের প্রয়াণের খবর শুনে শোকস্তব্ধ আকবর হায়দরাবাদ থেকে ফোনে আনন্দবাজারকে বললেন, ‘‘সুভাষ ভৌমিকের পরে এ বার সুরজিৎও চলে গেল। এই যন্ত্রণা সহ্য করা কঠিন। সতীর্থ হলেও সুরজিৎকে আমি শ্রদ্ধা করতাম ওর বহুমুখী প্রতিভার জন্য। আমরা শুধু ফুটবলই খেলে গিয়েছি। ও কিন্তু নিজেকে কখনও এই ছোট্ট গণ্ডির মধ্যে আটকে রাখেনি। সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি দারুণ তবলা বাজাত, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ভক্ত শুধু ছিল না, দারুণ গাইত। রীতিমতো রেওয়াজ করা গলা। আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। সুরজিতের গানের অনুষ্ঠান দেখতেও ছুটে গিয়েছিলাম।’’
কবে? আপ্লুত আকবর শোনালেন আকর্ষণীয় কাহিনি, ‘‘বছর দশেক আগের ঘটনা। সুরজিতের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল শ্যামল (ঘোষ)। ওর পাড়াতেই একটি অনুষ্ঠান ছিল। সুরজিতের অনুরোধে চলে গিয়েছিলাম সেই অনুষ্ঠানে। ঘণ্টাখানেক টানা গেয়েছিল ও। একা আমি নই অন্যান্য শ্রোতারাও মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসেছিল।’’ এখানেই না থেমে স্মৃতিচারণ করতে বসে তিনি আরও যোগ করলেন, ‘‘অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পরে জড়িয়ে ধরে সুরজিৎকে বলেছিলাম, ‘‘শুধু যদি গান গাইতে, তা হলেও সাফল্যের শিখরে পৌঁছতে তুমি।’’ আক্ষেপের সঙ্গে বললেন, ‘‘মাস তিনেক আগে মহমেডানের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে কলকাতায় গিয়েও দেখা হয়েছিল সুরজিতের সঙ্গে। ও একবারও বলেনি যে অসুস্থ।’’
সুরজিতের গানের ভক্ত ছিলেন সমরেশ চৌধুরীও। বলছিলেন, ‘‘আমি দিনে তিন ঘণ্টা গান শুনি। এখনও সেই অভ্যাস রয়ে গিয়েছে। বাইরে খেলতে গেলে সুরজিৎই ছিল আমার প্রধান ভরসা। ওকে কখনও গান গাওয়ার জন্য একবারের বেশি অনুরোধ করতে হয়নি।’’
আরও বললেন, ‘‘সুরজিৎ সব সময়ই গুনগুন করে গান গাইত। নৈশভোজের পরে ওকে নিয়ে আমাদের আসর বসত। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের চর্চা করত। একের পর এক গান গেয়ে মাতিয়ে রাখত। তবলাও অসাধারণ বাজাত। সুরজিতের সঙ্গে খেলার চেয়েও বেশি আলোচনা হত গান-বাজনা নিয়ে।’’ এর পরেই যোগ করলেন, ‘‘সাহিত্যের উপরেও সুরজিতের দারুণ দখল ছিল। কলকাতার বাইরে খেলতে গেলে অনেক সময় রাতের আড্ডায় কবিতা, গল্প নিয়ে আলোচনা করত। যদিও সবটা বুঝতাম না। তবে নানা বিষয়ে ওর জ্ঞান দেখে অবাক হয়ে যেতাম। এত মেধাবী ছিল বলেই সুরজিতের খেলা ছিল উচ্চমানের।’’
সুরজিতের খেলা নিয়ে আবেগপ্রবণ আকবরও। বলছিলেন, ‘‘সুরজিৎ বরাবরই খুব নরম প্রকৃতির ছিল। ওকে কখনও কারওর ওপরে রাগ করতে দেখিনি। এই সুরজিৎই বদলে যেত মাঠে নামলে।’’ কী ভাবে? আকবর যোগ করছেন, ‘‘তখন যেন ওকে চেনাই যেত না। সেই সময় ভারতীয় ফুটবলে ওর চেয়ে দ্রুতগামী কোনও ফুটবলারই ছিল না। পায়ে বল পড়লে যেন গতি আরও বেড়ে যেত। আর ছিল অবিশ্বাস্য রকম বল নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা। সাপের মতো একে-বেঁকে ড্রিবল করতে করতে ডান প্রান্ত দিয়ে উঠত। আমি মনে করি, কিংবদন্তি চুনী গোস্বামীর পরে সুরজিৎই একমাত্র ফুটবলার, যে দর্শকদের সম্মোহিত করে রাখত।’’
১৯৭৭-’৭৮ মরসুমে কলকাতায় সন্তোষ ট্রফিতে বাংলার অধিনায়ক ছিলেন আকবর। ফাইনালে পঞ্জাবকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন তাঁরা। নেপথ্যে সেই সুরজিৎ। বলছিলেন, ‘‘প্রথম দিন ম্যাচে কোনও ফয়সালা হয়নি। দ্বিতীয় দিন আমরা ৩-১ গোলে জিতেছিলাম শুধু মাত্র সুরজিতের জন্যই। ও নিজে করেছিল একটি গোল। বাকি দু’টি গোল করেছিল শ্যাম থাপা ও বিদেশ বসু।’’ যোগ করলেন, ‘‘পঞ্জাবের ফুটবলাররা বিশাল চেহারা নিয়ে শুরু থেকেই শারীরিক ফুটবল খেলছিল। ওদের প্রধান লক্ষ্যই ছিল সুরজিৎকে খেলতে না দেওয়া। কারণ, আগের মরসুমে পটনায় ওর বিধ্বংসী খেলা দেখেছিল। ওরা ভেবেছিল, সুরজিৎ হয়তো ভয় পেয়ে যাবে মার খেয়ে। কিন্তু হল ঠিক উল্টোটা। ওরা আটকাতেই পারছিল না। পাকাল মাছের মতোই বল নিয়ে পিছলে বেরিয়ে যাচ্ছিল সুরজিৎ। এ বার আমাদেরও বোকা বানিয়ে চলে গেল সুরজিৎ।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy