সুরজিতের জন্যই বাংলা গানের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম। যার নামের মধ্যেই সুর রয়েছে, তার গানের গলা তো অসাধারণ হবেই। গান ছিল সুরজিতের প্রাণ। একটা ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে।
স্মৃতি: বিদেশে বন্ধু সুরজিতের সঙ্গে উলগানাথন। ফাইল চিত্র
করোনার জন্য প্রায় আড়াই বছর কলকাতায় যেতে পারিনি। দিন তিনেক আগেই হায়দরাবাদ থেকে বেঙ্গালুরু ফেরার সময় ভাবছিলাম, অনেক দিন দেখা হয়নি সুরজিৎ (সেনগুপ্ত), পিন্টু (সমরেশ চৌধুরী), গৌতম (সরকার)-সহ ময়দানের বাকি বন্ধুদের সঙ্গে। করোনা পরিস্থিতি এখন আগের চেয়ে কিছু ভাল। সপ্তাহখানেকের মধ্যেই কলকাতায় যাব। ভাবতেও পারিনি যে আর কখনও দেখা হবে না সুরজিতের সঙ্গে। বৃহস্পতিবার দুপুরে ওর চলে যাওয়ার খবর শোনার পর থেকেই মনটা একদম ভেঙে গিয়েছে।
কলকাতা ময়দানে আমার সব চেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল সুরজিৎ। ১৯৭৪ সালে আমি মোহনবাগানে সই করি। সে বছরই ও চলে যায় ইস্টবেঙ্গলে। পরের বছর আইএফএ শিল্ডের ফাইনালে ৫-০ হেরেছিলাম। অবিশ্বাস্য খেলেছিল সুরজিৎ। সাতাত্তরে আমি ইস্টবেঙ্গলের সই করার পরে ওর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। ক্লাবের হয়ে এবং ভারতীয় দলে খেলার সময় বাইরে গেলে সব সময় এক ঘরে থাকতাম আমরা। এক সঙ্গে ঘোরাঘুরি করতাম, শপিংয়ে যেতাম। খেলা ছাড়ার পরে পাকাপাকি ভাবে আমি বেঙ্গালুরু চলে আসার পরেও আমাদের বন্ধুত্ব ছিল অটূট। কয়েক বছর আগেও বেঙ্গালুরুতে আমার বাড়িতে সপরিবার ঘুরে গিয়েছিল। কলকাতায় গেলে আমিও যেতাম ওর বাড়িতে। এত দিনের এই সম্পর্ক ছিন্ন করে দিয়ে বন্ধু আমাকে ছেড়ে চলে গেল।
ইস্টবেঙ্গলে সই করার আগে কখনও আমরা একসঙ্গে খেলিনি। তা সত্ত্বেও খুব অল্প দিনের মধ্যেই মাঠে দারুণ বোঝাপড়া গড়ে উঠেছিল আমাদের। সুরজিৎ খেলত ডান প্রান্তে। আমি বাঁ দিকে। উইং দিয়ে আক্রমণ শানাতাম আমরা। দারুণ বোঝাপড়া ছিল আমাদের মধ্যে। ম্যাচের পরিস্থিতি অনুযাযী, নিজেদের মধ্যে ঘনঘন জায়গা পরিবর্তন করে বিপক্ষের ডিফেন্ডারদের ধন্দে ফেলে দিতাম। পুরো ব্যাপারটাই ছিল সুরজিতের মস্তিষ্কপ্রসূত। ওর মতো বুদ্ধিদীপ্ত ফুটবলার আমি খুব কমই দেখেছি। অনুশীলনে আমাকে বলেছিল, ‘‘উলগা, সবাই জানে আমরা কী ভাবে খেলি। আমাদের আটকানোর জন্য প্রতিপক্ষের নির্দিষ্ট রণনীতি অবশ্যই থাকবে। কিন্তু ওদের ফাঁদে পা দেওয়া চলবে না। মাঝেমধ্যেই আমরা জায়গা পরিবর্তন করব। তুই চলে আসবি, ডান প্রান্তে। আমি তোর জায়গায় চলে যাব। দেখবি তা হলেই ওদের সব পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে।’’
সুরজিতের পরিকল্পনা শুনে আমি রীতিমতো চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। ডান দিকে আমি এর আগে কখনও খেলিনি। আমি ছিলাম বাঁ পায়ের ফুটবলার। সুরজিতের দু’টো পা-ই সমান চলত। খুব কম ফুটবলারই রয়েছে যাদের ডান ও বাঁ পায়ে সমান ভাবে বল নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা থাকে। সুরজিতের সেই দক্ষতা ছিল। যদিও ভারতীয় ফুটবলে ওর পরিচিতি ডান পায়ের ফুটবলার হিসেবেই। কিন্তু আমি দেখেছি, ওর বাঁ পা কতটা ভয়ঙ্কর ছিল। দু’পায়েই একাধিক ফুটবলারকে কাটিয়ে এগিয়ে যেতে পারত। আর ছিল নিখুঁত শটে গোল করার দক্ষতা। বিদ্যুৎ গতিতে প্রান্ত দিয়ে বল নিয়ে উঠতে পারত। আমার সেই ক্ষমতা ছিল না বলেই চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। সুরজিৎ তা বুঝতে পেরে বলেছিল, ‘‘তুই চিন্তা করছিস কেন? রাইট উইংয়ে খেলার জন্য ডান পায়ের ফুটবলারই হতে হবে কে বলেছে? তুই স্বাভাবিক খেলাই খেলবি। বরং কাট করে ভিতরে ঢুকে বাঁ পায়ে গোল লক্ষ্য করে বল মারবি। দেখবি, অনেক বেশি গোল হবে।’’
সুরজিতের জন্যই বাংলা গানের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম। যার নামের মধ্যেই সুর রয়েছে, তার গানের গলা তো অসাধারণ হবেই। গান ছিল সুরজিতের প্রাণ। একটা ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে। আমরা রোভার্স কাপ খেলতে যাচ্ছি। একই বিমানে ছিলেন কিংবদন্তি মান্না দে-ও। সুরজিৎ যথারীতি সিটে বসেই গান গাইতে শুরু করে দিল। ও খেয়ালই করেনি যে, মান্না দে-ও রয়েছেন একই বিমানে। সুরজিতের গান শুনে সিট ছেড়ে উঠে এসে উচ্ছ্বসিত প্রশংসাও করেছিলেন কিংবদন্তি গায়ক। দারুণ তবলাও বাজাত সুরজিৎ। ও ছিল আক্ষরিক অর্থেই শিল্পী। মাঠে বল নিয়ে হোক, অথবা গানের গলায়— সুরজিৎ মেতে থাকত সৃষ্টি সুখের উল্লাসে।
সব কিছু বেসুরো করে দিয়ে আমাদের ছেড়ে এত তাড়াতাড়ি চলে যাওয়ার কী দরকার ছিল, বন্ধু? উইং ধরে দৌড়ব কার সঙ্গে? ডানা মেলে উড়ব কার সঙ্গে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy