আইএসএল লিগ-শিল্ড জয়ের পর মোহনবাগান অধিনায়ক শুভাশিসের সঙ্গে হাবাস। —নিজস্ব চিত্র।
যুবভারতী ভর্তি মোহনবাগান সমর্থকে। চার দিকে সবুজ-মেরুন জার্সি, পতাকা, টিফো। ম্যাচ তখনও শুরু হয়নি। হঠাৎ জয়ধ্বনি দিলেন মোহন-সমর্থকেরা। কী হল? উৎসুক চোখ এ দিক -ও দিক তাকাতেই দেখতে পেল সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট পরে ৫ ফুট ৯ ইঞ্চির এক টাকমাথা ভদ্রলোক মাঠে এসেছেন। ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসি। ডান হাত নাড়তে নাড়তে মাঠে ঢুকছেন। আর মোহন-গ্যালারি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। কারণ সেই মানুষটির নাম আন্তোনিয়ো লোপেজ হাবাস।
বেশ কিছু দিন অসুস্থ ছিলেন হাবাস। মোহনবাগানের শেষ কয়েকটি ম্যাচে বেঞ্চে ছিলেন না। তাঁর থাকা-না থাকার সময়ে মোহনবাগানের খেলায় যে পরিবর্তন হয়, তা বোঝা গিয়েছিল চেন্নাইয়িনের বিরুদ্ধেই। হাবাসহীন মোহনবাগান সেই ম্যাচ হেরেছিল ২-৩ গোলে। মোহন-সমর্থকদের আফসোস করতে শোনা যেত, হাবাস থাকলে ওই ম্যাচ হারত না মোহনবাগান। তাঁরা তো জানেন, ওই ম্যাচ জিতে গেলে আইএসএল লিগ-শিল্ড পাওয়ার জন্য সোমবারের ম্যাচ পর্যন্ত হয়তো অপেক্ষাই করতে হত না।
হাবাস যেন ম্যাজিশিয়ান। তিনি মাঠের পাশে থাকলেই কোনও এক জাদুকাঠির ছোঁয়ায় বদলে যায় মোহনবাগান ফুটবলারদের খেলা। তাই আইএসএল ‘ফাইনাল’ খেলতে নামা মোহনবাগান বেঞ্চে তিনি থাকবেন জেনে ম্যাচ শুরুর আগেই স্বস্তি পান মোহন-সমর্থকেরা। এই স্বস্তিটা প্রথম এসেছিল ১০৩ দিন আগে। টানা তিনটি হারে মোহনবাগান তখন ধুঁকছে। প্রাক্তন কোচ জুয়ান ফেরান্দো বুঝতে পারছেন না, কী ভাবে দলকে জয়ে ফেরাবেন। এমন অবস্থায় সুপার কাপের আগে নিজেই পদত্যাগ করেন ফেরান্দো। কোনও সময় না নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে হাবাসকে কোচ করে মোহনবাগান। এত দিন তিনি ছিলেন দলের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর। এই বছর ৩ জানুয়ারি কোচ করা হয় তাঁকে। আইএসএল শিল্ড জয়ের ঠিক ১০৩ দিন আগে। যদিও সঙ্গে সঙ্গে দলে যোগ দিতে পারেননি হাবাস। ভিসা সমস্যায় দেরি হয় তাঁর। কিন্তু তিনি দলে যোগ দেওয়ার পর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি দলকে। আইএসএলে হারতে থাকা দল হঠাৎ বদলে গেল। তরতরিয়ে এগিয়ে চলল পালতোলা নৌকা।
হাবাসের সাফল্যের চাবিকাঠি অবশ্যই তাঁর ম্যাচ পরিচালন ক্ষমতা। খুব দ্রুত বুঝে নিতে পারেন, কী ভাবে দু’-একটা বদল করলেই ম্যাচের রাশ নিজের হাতে চলে আসতে পারে। প্রায় ৩৪ বছর ধরে কোচিং করাচ্ছেন হাবাস। বলিভিয়ার মতো দেশের কোচ ছিলেন। বহু দেশের ক্লাবে কোচিং করিয়েছেন। সেই অভিজ্ঞতাই হাবাসের বড় সম্বল। ভারতে কোচিং করাতে এসেছিলেন ২০১৪ সালে। ১০ বছর আগে এটিকে-র কোচ হয়ে ভারতে এসেছিলেন হাবাস। ২০২০ সালে প্রথম বার মোহনবাগানের কোচ হয়েছিলেন তিনি। ২০২১ সালে সেই দায়িত্ব ছেড়ে দেন। আবার তাঁকে ফিরিয়ে আনা হয় ২০২৩ সালে। তখন যদিও তিনি টেকনিক্যাল ডিরেক্টর। এই বছরের শুরুতে কোচ করা হয় তাঁকে।
হাবাস যে সময় এটিকের কোচ ছিলেন, তখন বলা হত তিনি বড্ড বেশি রক্ষণাত্মক কোচ। কিন্তু এ বারে সেই তকমা ঝেড়ে ফেলেছেন হাবাস। মোহনবাগান আক্রমণ করছে। গোল করছে। আবার রক্ষণও যথেষ্ট জমাট। হাবাস বলেন, “আমার হাতে সেই সময় আক্রমণ ভাগের তেমন ফুটবলার ছিল না। সেই কারণে রক্ষণে জোর দিতাম। এখন আমার হাতে বেশ কিছু আক্রমণাত্মক ফুটবলার আছে। তাই আক্রমণাত্মক খেলি। যেমন ফুটবলার দলে থাকবে সেই ভাবেই তো লড়তে হবে।” এটাই হাবাসের সব থেকে বড় গুণ। তিনি জানেন তাঁর রান্নাঘরে কোন সব্জি আছে। তা দিয়েই সেরা রান্নাটা রাঁধতে জানেন। আলু, পটল দিয়ে তো আর বিরিয়ানি রাঁধা যায় না।
মোহনবাগান এই মরসুমের শুরুতেই সাহাল আব্দুল সামাদ এবং অনিরুদ্ধ থাপাকে দলে নিয়েছিল। প্রতিভাবান দুই ভারতীয় ফুটবলার দলে আসায় শক্তি বাড়ে বাগানের। সেই সঙ্গে জেসন কামিংস এবং আর্মান্দো সাদিকুর মতো দুই স্ট্রাইকার। হাবাস তাঁদের ব্যবহার করতে জানেন। কোন ম্যাচে সাদিকুকে খেলাবেন, কোন ম্যাচে কামিংসকে— তা খুব ভাল বোঝেন হাবাস। আর মোহনবাগানকে বদলে দেওয়ার জন্য হাবাসের সেরা চাল ছিল জনি কাউকোকে দলে নেওয়া। মোহনবাগানের মাঝমাঠ প্রাণ পায় কাউকো যোগ দেওয়ায়।
হাবাস কড়া কোচ। হাবাস ভাল কোচ। এমনটাই বলছেন দলের ফুটবলারেরা। অনিরুদ্ধ বলেন, “এই জয়ের কৃতিত্ব কোচের। হাবাস আসার পর আমাদের খেলা বদলে গেল। কোচ বড্ড কড়া। অনেক চাহিদা তাঁর। আমরা এমনই এক জনকে চেয়েছিলাম।” আইএসএল শিল্ড জয়ের পর দিমিত্রি পেত্রাতোস বলেন, “এই কৃতিত্ব আসলে কোচ হাবাস এবং জনি কাউকোর। ওরা দু’জন আসার পর আমাদের খেলা বদলে গিয়েছে। পর পর ম্যাচ হেরে চাপে পড়ে গিয়েছিলাম আমরা। সেখান থেকে এই দু’জনের জন্যই ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছি।” এর পর একই কথা বলে গেলেন সোমবারের ম্যাচের দুই গোলদাতা লিস্টন কোলাসো এবং কামিংস। সাহালও কোচের প্রশংসা করে গেলেন। এটাই হাবাসের জাদু। সব ফুটবলারদের পছন্দের লোক হয়ে ওঠেন তিনি। আবার কড়া হাতে শাসনও করেন। সেই কারণেই বোধ হয় হাবাসের কাজে নাক গলান না সঞ্জীব গোয়েন্কারা।
মরসুমের মাঝপথে কোচ হওয়ার একটা ঝামেলা আছে। অন্য এক কোচের জুতোয় পা গলাতে হয়। ফুটবলারেরা এক ধরনের খেলায় অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে নতুন এক জনের আবির্ভাব। মানিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা হতেই পারে। হাবাস জানুয়ারি মাসে কোচ হয়ে একটি পরিবর্তন করলেন। ফেরান্দোর মোহনবাগান খেলছিল ৩-১-৪-২ ছকে। হাবাস এসে সেটাকেই বদলে দিলেন ৩-৪-২-১ ছকে। কখনও কখনও খেলালেন ৩-৫-২ ছকে। এর ফলে রক্ষণ যেমন জমাট হল, তেমনই আক্রমণও শক্তিশালী হল।
প্রতিপক্ষ অনুযায়ী সেই ছক বদলে যেত। পেত্রাতোসকে যেমন ছেড়ে রেখেছিলেন হাবাস। তিনি কখনও গোল করাতেন, কখনও করতেন। বিপক্ষ তাঁকে কী ভাবে আটকাবে, বুঝেই উঠতে পারত না। পেত্রাতোসের সঙ্গী হিসাবে কখনও থাকতেন কামিংস, কখনও সাদিকু। বক্সের মধ্যে তাঁরা যে কোনও সময় ভয়ঙ্কর। আর এই আক্রমণকে সাহায্য করার জন্যই মাঝমাঠে এলেন কাউকো। দলের রিমোট যেন তাঁর হাতেই থাকত। খেলার গতি নিয়ন্ত্রণ করতেন কাউকোই। এই বিদেশি ফুটবলারদের সঙ্গে হাবাস দলে পেলেন অভিষেক সূর্যবংশী, কিয়ান নাসিরি, দীপেন্দু বিশ্বাসের মতো তরুণ ফুটবলারদের। সেই সঙ্গে অভিজ্ঞ লিস্টন, সাহাল, অনিরুদ্ধ, শুভাশিসরা তো ছিলেনই।
মোহনবাগানের রক্ষণ ভাগে হাবাস রেখেছিলেন শুভাশিস, আনোয়ার আলি এবং হেক্টর ইউস্তেকে। তাঁদের সামনে কখনও অভিষেক, কখনও দীপক টাংরিকে খেলালেন। এর ফলে বিপক্ষের আক্রমণের সামনে রক্ষণের দু’টি দেওয়াল তুললেন হাবাস। এর ফলে গোল খাওয়া বন্ধ হল বাগানের। শেষ ১২টি ম্যাচের মধ্যে ছ’টি ম্যাচে গোল খায়নি মোহনবাগান।
গোল খাওয়া বন্ধ করেই আক্রমণের দিকে নজর দিলেন হাবাস। সেই কাজ শুরু হত মাঝমাঠ এবং উইংস থেকে। কাউকো এবং পেত্রাতোস মাঝমাঠ থেকে আক্রমণে ওঠার চেষ্টা করতেন। আর তাঁদের সঙ্গে উইংস থেকে ছিলেন লিস্টন, নাসিরি, আশিস রাই এবং আমনদীপ সিংহের মতো ফুটবলারেরা। বক্সের মধ্যে কামিংসেরা তো ছিলেনই।
এটাই হাবাস-জাদু। যে ছোঁয়ায় পর পর তিনটি ম্যাচ হেরে কাঁধ ঝুঁকে যাওয়া ফুটবলারেরাই হাতে তুলে নিলেন নৌকার দাঁড়। আরব সাগর পারের দলকে সোমবার হারিয়ে পালতোলা নৌকা ছুটছে। প্রথম বার আইএসএল লিগ-শিল্ড জিতল মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। এ বার লক্ষ্য চ্যাম্পিয়ন হওয়া। মুম্বই সিটি একই বছরে আইএসএল শিল্ড এবং চ্যাম্পিয়ন হওয়ার তকমা জিতেছিল। সেই অসম্ভবকে সম্ভব করাই এখন লক্ষ্য হাবাসের মোহনবাগানের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy