Advertisement
০৬ নভেম্বর ২০২৪
Mohun Bagan and East Bengal Supporters' Protest

বন্ধ যুবভারতীর বাইরে হল রবিবারের ‘ডার্বি’, বিচার চেয়ে ‘বড় ম্যাচে’ যুগ্মজয়ী ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান

রবিবারের বাইপাস দেখল অভাবনীয় দৃশ্য। ডার্বি বাতিল এবং আরজি কর কাণ্ডের বিচার চেয়ে পথে নামলেন ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগানের সমর্থকেরা। যোগ দিল মহমেডানও। পুলিশের লাঠিচার্জ, বৃষ্টি সামলেও চলল প্রতিবাদ।

football

আরজি কর কাণ্ডের বিচার চেয়ে দুই প্রধানের প্রতিবাদের বিভিন্ন মুহূর্ত। ছবি: শান্তনু ঘোষ।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ অগস্ট ২০২৪ ২২:৫৫
Share: Save:

প্রতিবাদের ফুলকি জ্বলা শুরু হয়েছিল শনিবার দুপুর থেকেই। ডার্বি বাতিলের খবর ছড়িয়ে পড়ামাত্রই ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান সমর্থকেরা ঘোষণা করেছিলেন, ডার্বির নির্ধারিত সময়ের আগে জমায়েত করে প্রতিবাদ জানানো হবে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনের প্রধান দরজার বাইরে। সেই ফুলকি দাবানল হয়ে ছড়িয়ে পড়ল রবিবার দুপুরে। ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান, মহমেডান সমর্থকদের প্রতিবাদে চার ঘণ্টার বেশি অবরুদ্ধ হয়ে থাকল বাইপাস। আরজি কর কাণ্ডের প্রতিবাদ করতে গিয়ে খেতে হল পুলিশের লাঠি। তাতেও প্রতিবাদ থামল না। পুলিশের লাঠিচার্জ সত্ত্বেও সমর্থকেরা আবার ভিড় করলেন যুবভারতীর সামনে। সব মিলিয়ে, রবিবার মাঠে ডার্বি না হলেও মাঠের বাইরে হল, সেখানে জিতে গেল তিন প্রধানই।

রবিবার সকাল থেকেই গোটা শহরজুড়ে বৃষ্টি শুরু হয়। কোথাও কোথাও জল জমে যায়। প্রতিবাদীরা তাতেও পিছিয়ে আসেননি। ছুটির দিন হওয়ায় দ্বিগুণ উৎসাহে দুপুর থেকেই দলে দলে সমর্থক মিছিল করে এগোতে থাকেন যুবভারতীর দিকে। হাওড়া, দক্ষিণ কলকাতা, উত্তর কলকাতার বিভিন্ন জায়গা থেকে ছোট ছোট মিছিল এগোতে থাকে। গন্তব্য একটাই, যুবভারতী স্টেডিয়াম। ডার্বি বাতিল হওয়ার দুঃখ নয়, আরজি করের নির্যাতিতার বিচার চাওয়াই ছিল মূল লক্ষ্য।

পুলিশ ভ্যানে তোলা হয়েছে দুই সমর্থককে।

পুলিশ ভ্যানে তোলা হয়েছে দুই সমর্থককে। ছবি: শান্তনু ঘোষ।

রবিবার বিকেলে একটি সাংবাদিক বৈঠক করে বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটের বিধাননগর ডিসি অনীশ সরকার জানান, রবিবার বিকেল ৪টে থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত ওই এলাকায় ১৬৩ ধারা জারি করা হয়েছে। স্টেডিয়ামের বাইরে রবিবার বিকেল ৫টা থেকে আরজি করের ঘটনার প্রতিবাদে মিছিল করার কথা বলেছিলেন তিন প্রধানের সমর্থকেরা। বিধাননগর পুলিশের তরফে জানানো হয়, ওই মিছিলে অশান্তির আশঙ্কা করছেন তাঁরা। কারণ গোপন সূত্রে তাঁরা জানতে পেরেছিলেন, কিছু দুষ্কৃতী ওই শান্তিপূর্ণ মিছিলে অস্ত্র নিয়ে ঢুকে পড়তে পারে। বিশৃঙ্খলা এবং অশান্তি তৈরি করতে পারে। এ ব্যাপারে একটি প্রামাণ্য অডিয়ো রেকর্ডিংও ওই সাংবাদিক বৈঠকে শুনিয়েছে পুলিশ।

কিন্তু সাংবাদিক বৈঠকে দেওয়া সতর্কবার্তার কোনও প্রভাব পড়েনি সমর্থকদের মধ্যে। তাঁরা তত ক্ষণে বাড়ি থেকে বেরিয়ে দলে দলে স্টেডিয়ামের দিকে এগোতে শুরু করেছিলেন। বিকেল ৪টে থেকে যুবভারতীর বাইরে অল্প অল্প করে জমায়েত শুরু হয়। পুলিশ আগে থেকেই তৈরি ছিল। গার্ডরেল দিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করা হয়েছিল সমর্থকদের আটকাতে। মিছিল বড় হতেই পুলিশ আটকায়। পুলিশের সঙ্গে তর্কে জড়ান দু’দলের সমর্থকেরা। ভিআইপি গেটের বাইরে জড়ো হয়েছিলেন দুই প্রধানের সমর্থকেরা। তাঁদের উল্টোডাঙার দিকে ক্রসিংয়ে সরিয়ে দেওয়া হয়। একটু পরে প্রতিবাদীদের আরও সরিয়ে দিতে থাকে পুলিশ। বেঙ্গল কেমিক্যালের দিকে সরিয়ে দেওয়া হতে থাকে প্রতিবাদীদের।

মহিলা এবং পুরুষ সমর্থকদের একযোগে প্রতিবাদ।

মহিলা এবং পুরুষ সমর্থকদের একযোগে প্রতিবাদ। ছবি: শান্তনু ঘোষ।

মোহনবাগান এবং ইস্টবেঙ্গল সমর্থকেরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্লোগান তুলছিলেন। মুহুর্মুহু উঠছিল ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ স্লোগান। তাঁদের দাবি ছিল, শান্তিপূর্ণ অবস্থান করছেন। কোনও রকম অস্ত্র নিয়ে আসেননি। উত্তেজনা তৈরি করার কোনও ইচ্ছা তাঁদের নেই। শান্তিপূর্ণ অবস্থান করতে চাইছেন তাঁরা। কিন্তু পুলিশ কোনও রকম নরম মনোভাব দেখানোর রাস্তায় হাঁটেনি। মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গলের সমর্থকেরা প্রশ্ন তুলছিলেন, যদি নিরাপত্তার দাবি তুলে ডার্বি বাতিল করা হয়, তা হলে প্রতিবাদ আটকাতে এত পুলিশ মোতায়েন করা হল কেন? এর থেকে কম পুলিশে তো ডার্বি হয়ে যেত, বলছিলেন সমর্থকেরা।

বিকেল গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সমর্থকের সংখ্যা যেমন বাড়ছিল, তেমনই বাড়ছিল পুলিশের সংখ্যাও। বিক্ষোভকারীদের আরও সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিল তারা। বেঙ্গল কেমিক্যালের দিকে সরানোর চেষ্টা হচ্ছিল। কিছু প্রতিবাদী সরলেও বাকিরা সরতে চাইছিলেন না। বিকেল ৪.৩০ নাগাদ যুবভারতীতে যোগ দেন মহমেডান সমর্থকেরা। তিন প্রধানই এসে যাওয়ায় প্রতিবাদীদের কণ্ঠস্বর আরও বাড়তে থাকে। মিছিলে দেখা যায় ইস্টবেঙ্গল সমর্থক তথা অভিনেত্রী ঊষসী চক্রবর্তী ও মোহনবাগান সমর্থক তথা নাট্যকর্মী সৌরভ পালোধীকে। সৌরভ বলেন, “ভারতীয় ফুটবলকে আঘাত করলে প্রতিবাদ তো হবেই।”

ইস্টবেঙ্গলের এক ফ্যান ক্লাবের প্রতিবাদ।

ইস্টবেঙ্গলের এক ফ্যান ক্লাবের প্রতিবাদ। ছবি: সংগৃহীত।

বিকেল ৫টা বাজার একটু আগে আচমকাই প্রতিবাদীদের উপর লাঠিচার্জ শুরু করে পুলিশ। সরিয়ে দেওয়া হতে থাকে প্রতিবাদীদের। নির্বিচারে লাঠি চালানো হয় বলে অভিযোগ। দেখা যায়, অনেককে আটক করে গাড়িতে তোলা হচ্ছে। পুলিশের সঙ্গে ঘটনাস্থলে ছিল র‌্যাফও। ‘পুলিশ হায় হায়’ স্লোগান তুলতে শোনা যায় সমর্থকদের। পুলিশের তাড়া খেয়ে রাস্তা থেকে অনেক বিক্ষোভকারী ফুটপাথে উঠে পড়েছিলেন। তাঁদের সেখান থেকেও সরিয়ে দিতে থাকে পুলিশ। বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হতে থাকে বেঙ্গল কেমিক্যালের দিকে। মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গলের সমর্থকদের অভিযোগ, পুলিশের লাঠির ঘায়ে অনেকে আহত হয়েছেন। এমনকি, মহিলা সমর্থকদের উপরেও পুলিশ লাঠিচার্জ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। দু’দলের অনেক সমর্থককে গাড়িতে তোলে পুলিশ।

এর মধ্যেই ঘটনাস্থলে পৌঁছন সর্বভারতীয় ফুটবল সংস্থার সভাপতি কল্যাণ চৌবে। যুবভারতীর দিকে আসার আগেই প্রথমে তাঁর গাড়ি আটকানো হয়। তা পেরিয়ে তিনি যুবভারতীর সামনে পৌঁছে যান। সেখানে একটা সময় তাঁকে পুলিশ ঠেলতে ঠেলতে ভ্যানের দিকে তুলতে দেখা যায়। তা আটকান কল্যাণ। এর পর যে সমর্থকদের পুলিশ আটক করে ভ্যানে তুলেছিল, তাঁদেরও ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। তিনি জানান, সমর্থকদের দাবিকে সমর্থন জানাতেই তিনি যুবভারতী এসেছিলেন। ফুটবলপ্রেমীদের স্বার্থে তিনি এসেছিলেন। নিজের দায়িত্বে পুলিশকে অনুরোধ করে সমর্থকদের ছাড়িয়ে দিয়েছেন।

বিকেল ৫.৩০টা থেকে আবার শুরু হয় মিছিল। যে সব সমর্থক পুলিশের লাঠিচার্জে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন, তাঁরা আবার জড়ো হয়ে মিছিল করে যুবভারতীর দিকে এগোতে শুরু করেন। পুলিশ আবার গার্ড নেয়, তবে সে বার তারা অনেক শান্ত ছিল। যুবভারতীর ভিআইপি গেটের ঠিক বাইরে আবার শুরু হয় বিক্ষোভ। জড়ো হয়েছিলেন দু’দলের সমর্থকেরা। প্রস্তুত ছিল বিশাল পুলিশবাহিনীও। বেলেঘাটা মোড়ে প্রতিবাদীদের আটকে দেয় পুলিশ। সেখানেই বিক্ষোভ শুরু হয়। পুলিশের বিরুদ্ধে স্লোগান উঠতে থাকে। বিক্ষোভের মাঝেই গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতে থাকে পুলিশ। সায়েন্স সিটির দিক থেকে আসা গাড়ি চিংড়িহাটা দিয়ে ঘুরিয়ে দেওয়া হতে থাকে। উল্টোডাঙার দিক থেকে আসা গাড়ি হাডকো ও বেঙ্গল কেমিক্যাল থেকে ঘুরিয়ে দিতে থাকে পুলিশ।

মিছিল করে হাঁটতে হাঁটতে বিক্ষোভকারীদের জাতীয় সঙ্গীত গাইতে দেখা যায়। দেখা যায়, আশেপাশে দাঁড়িয়ে যাঁরা গোটা ব্যাপারটি দেখছিলেন, তাঁরাও জাতীয় সঙ্গীতে গলা মেলান। এর মাঝেই নামে বৃষ্টি। তবে তা প্রতিবাদ দমাতে পারেনি। মাঝে বেশ কিছু ক্ষণ রাস্তায় বসে পড়েছিলেন সমর্থকেরা। আবার মিছিল শুরু করেন তাঁরা। ভিড় আরও বাড়তে থাকে। পুলিশ এক দিকে অপেক্ষা করছিল। অনেক ক্ষণ অবরুদ্ধ থাকার পর সন্ধ্যা ৭.৩০টা থেকে অল্প অল্প গাড়ি চলাচল শুরু করে বাইপাসে।

মিছিলে থাকা মোহনবাগানের প্রাক্তন কর্তা সঞ্জয় ঘোষ বলেন, “এটা স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ। স্বাধীনতার আগে বা পরে এ রকম প্রতিবাদ কখনও হয়নি। ডার্বির অপেক্ষা সবাই করে থাকে। ফেরিওয়ালা থেকে শুরু করে খেলোয়াড়, সদস্য-সমর্থক সবাই এই ম্যাচের অপেক্ষা করে থাকেন। এই জন্যে আজ সবাই এগিয়ে এসেছেন। লাল-হলুদ, সবুজ-মেরুন, সাদা-কালো সবাই এক হয়ে গিয়েছে। পুলিশের লাঠিচার্জ মোটেই ভাল কাজ হল না। পতাকা নিয়ে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ চলছিল।

সমর্থকেরা তখনও সরেননি এলাকা থেকে। ক্রমাগত স্লোগান, চিৎকারে মুখরিত হচ্ছিল বাইপাস। ধীরে ধীরে পুলিশের তত্ত্বাবধানে বাইপাসে সচল হয় যানচলাচল। বৃষ্টিতে ভিজে থাকা অবস্থাতেই কিছু সমর্থক বাড়ির পথ ধরেন। থেকে যান অনেকেই। কত ক্ষণ থাকবেন তা-ও জানা নেই। যাঁরা ফিরছিলেন, তাঁরা জানিয়ে গেলেন, দরকার পড়লে আবার পথে নামবেন।

অন্য বিষয়গুলি:

Mohun Bagan East Bengal Mohammedan SC
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE