সমর্থকদের পাশে লিভারপুল। ফাইল ছবি
গত শনিবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনাল দেখতে গিয়ে অসহনীয় অভিজ্ঞতার সাক্ষী হয়েছিলেন লিভারপুলের সমর্থকেরা। তাঁদের জন্য অভিনব উদ্যোগ নিল লিভারপুল। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে জোট বেধে তাঁরা সমর্থকদের পাশে দাঁড়িয়েছে। সমর্থকরা চাইলে ওই সংগঠনে গিয়ে নিজেদের চিকিৎসা করাতে পারেন। সমর্থকদের জন্য অন্য কোনও ক্লাবকে এমন উদ্যোগ নিতে খুব একটা দেখা যায়নি।
বৈধ টিকিট থাকা সত্ত্বেও সে দিন অনেকে স্টেডিয়ামের ভিতরে ঢুকতে পারেননি। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। সমর্থকদের দিকে ছোড়া হয় মরিচ গুঁড়ো, কাঁদানে গ্যাস। শুধু তাই নয়, ফ্রান্স সরকারের অভিযোগ, টিকিট না থাকা সত্ত্বেও প্যারিসে খেলা দেখতে এসে গন্ডগোল বাধানোর জন্য দায়ী লিভারপুলের সমর্থকরাই। অভিযোগ অস্বীকার করেছে লিভারপুল।
এই ঘটনা দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলেছে সমর্থকদের মানসিক স্বাস্থ্যে। অনেকে প্রিয় দলের খেলা দেখতে না পেয়ে ব্যথিত, হতাশ। অনেকে তেমনই বিনা কারণে পুলিশের মার খেয়ে ক্ষুব্ধ। সমর্থকদের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে পাশে দাঁড়িয়েছে লিভারপুল।
ক্লাবের এই উদ্যোগে কতটা লাভ হবে সমর্থকদের? বিষয়টি জানতে আনন্দবাজার অনলাইন যোগাযোগ করেছিল শহরের নামী ক্রীড়া মনোবিদ অনুশীলা ব্রহ্মচারীর সঙ্গে। তিনি প্রথমেই লিভারপুলের এই উদ্যোগকে কুর্নিশ করলেন। তার পরে বললেন, “যে কোনও সমর্থকের কাছেই তাঁর দল ভগবানের মতো। প্রতিনিয়ত দলের কথা ভাবেন তাঁরা। দলের থেকে তাঁরা কতটা সমর্থন পাচ্ছেন, দল কখন কী ভাবে তাঁদের পাশে দাঁড়াচ্ছে, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। যে কোনও ক্লাবেরই একটা দায়িত্ব থাকে সমর্থকদের জন্যে। এখানে লিভারপুল ঠিক সেই দায়িত্বটাই পালন করছে। সমর্থকরা যে কোনও কারণে মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত থাকতে পারেন। কিন্তু প্রয়োজনের সময় ক্লাবকে পাশে পেলে তাঁদের ভরসা, বিশ্বাস আরও বাড়বে। তিনি ক্লাবের সঙ্গে আরও একাত্ম বোধ করবেন। লিভারপুলের এই উদ্যোগ তাই নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। সব ক্লাবই চায় তাঁদের জনসমর্থন বাড়ুক। কিন্তু সমর্থকদের ভালমন্দের চিন্তাও ক্লাবকে করতে হবে। এ ক্ষেত্রে লিভারপুল প্রমাণ করে দিল, তারা সমর্থকদের নিজেদের পরিবারের অংশ হিসেবে ভাবে।”
শুধু ক্লাব নয়, অনুশীলার মতে, প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। তিনি বলেছেন, “শিল্পী বা অন্য কোনও নামী ব্যক্তিত্বকেও অনেক মানুষ অনুসরণ করে। ফলে সেই অনুসরণকারীদের জন্যে ওই ব্যক্তিরও দায়বদ্ধতা থাকে। আমাদের আশেপাশে কিন্তু সেই নজির দেখতে পাই না।” এ প্রসঙ্গে তিনি চলচ্চিত্রের কথাও তুলে ধরেন। অনুশীলা বলেছেন, “আমরা এমন অনেক সিনেমা দেখতে পাই যেখানে দর্শকরা বিষয়বস্তু দেখে প্রভাবিত হয়। তাঁদের মধ্যে নিজেদের বা অন্যের ক্ষতি করার মানসিকতা চলে আসে। এক জনপ্রিয় হিন্দি সিনেমা দেখার পর তরুণ প্রজন্মের মধ্যে প্রতিশোধস্পৃহা, অপরাধের প্রবণতা বেড়ে গিয়েছিল। অনেকে জেলেও গিয়েছিল। পরে ওই সিনেমার পরিচালক ক্ষমা চান। অনেকে আবার সিনেমা দেখে নিজেদের সুপারহিরো ভাবেন। সেটাও বিপদ ডেকে আনে। ফলে নিজের কাজ সম্পর্কে যে কোনও পেশাদারের একটা দায়বদ্ধতা থাকা উচিত।”
লিভারপুলের অসাধারণ উদ্যোগ দেখা গেলেও বাংলায় কি কোনও দিন এই জিনিস দেখা যাবে? অনুশীলা আশাবাদী। তবে দু’টি সমস্যার কথা তিনি তুলে ধরেছেন। প্রথমত, মানসিকতা। দ্বিতীয়ত, অর্থ। বাংলার সব থেকে বড় ম্যাচ নিঃসন্দেহে ডার্বি। অতীতে এই ম্যাচ ঘিরে মারপিট, পুলিশের মার খাওয়ার মতো অনেক ঘটনা ঘটেছে। শুধু তাই নয়, ম্যাচে হারের পর আত্মহত্যারও অনেক ঘটনা ঘটেছে। এই সব ক্ষেত্রে যদি ক্লাব তাদের সমর্থকদের পাশে দাঁড়াত, তা হলে দুর্ঘটনা এড়ানো গেলেও যেতে পারত। অনুশীলা বলেছেন, “ইংল্যান্ড বা ইউরোপের অন্যান্য দেশে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে এখন যে পরিমাণ সচেতনতা দেখা যাচ্ছে, তার কিছুই বাংলায় বা আমাদের দেশে দেখা যায় না। মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টি যে গুরুত্বপূর্ণ, এখানে সেটাই অনেকে বোঝেন না।’’
সমর্থক তো দূর, খেলোয়াড়দের মানসিক স্বাস্থ্যের কথাও ভাবা হয় না, অভিযোগ অনুশীলার। বললেন, ‘‘একজন খেলোয়াড় দিনের পর দিন ম্যাচ খেলেন, অনুশীলন করেন, দলের সঙ্গে যাতায়াত করেন। প্রতিনিয়ত এই চাপ অনেকেই নিতে পারেন না। কেউ চোট পেলে দ্রুত তা সারিয়ে মাঠে ফেরার চেষ্টা করেন। কারণ তিনি জানেন, বেশি দিন মাঠের বাইরে থাকলে দলে নিজের জায়গা হারিয়ে ফেলবেন। পরের ম্যাচে যে আরও বড় চোট পেতে পারেন, সেটা এক বারও ভাবেন না। কারণ ক্লাবের থেকে সেই সমর্থনটাই যে তাঁরা পান না।” অনুশীলার মতে, প্রত্যেকটি ক্লাবেই অন্তত একজন ক্রীড়া মনোবিদ থাকা উচিত, যাঁর কাছে গিয়ে খেলোয়াড়রা তাঁদের মনের কথা বলতে পারবেন। কোনও কারণে মানসিক চাপে পড়লে তার থেকে বেরিয়ে আসার রাস্তা খুঁজে পাবেন। কিন্তু বেশির ভাগ ক্লাব ক্রীড়া মনোবিদ নিয়োগ করার বিষয়ে গুরুত্বই দেয় না।’’
দ্বিতীয় সমস্যা হিসেবে আর্থিক দিকটি তুলে ধরেছেন। অনেক ক্লাবের এমন আর্থিক সঙ্গতি নেই যে তারা ক্রীড়া মনোবিদ নিয়োগ করতে পারে। তাঁর কথায়, “লিভারপুলের কাছে যে পরিমাণ টাকা রয়েছে, সেটা এই শহর বা দেশের কোনও ক্লাবেরই নেই। এই বিষয়টিই অন্যতম বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যাদের সেই অর্থ রয়েছে, তাদের মধ্যে আগ্রহ নেই। ফলে সমস্যা দু’দিকেই। তবে আশা করি খুব শীঘ্রই এ ব্যাপারে আরও সচেনতা দেখতে পাব। কারণ খেলাধুলোতেও যে একজন মনোবিদের প্রয়োজন, সেই বিশ্বাসটা ধীরে ধীরে আসছে।”
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy