গৌতম সরকারের কথায়, ‘‘সে দিন দারুণ প্রেরণা দিয়েছিল সুরজিৎ। ওর জন্যই মোহনবাগান সে দিন শুরুতে ছন্দ হারিয়েছিল। সুরজিতকে আটকাতে পারছিল না মোহনবাগান রক্ষণ।’’
দু’পায়ে সুক্ষ্ম কাজ। গতি দুরন্ত। বিপক্ষকে কাটিয়ে চকিতে বেরিয়ে যেতে পারে। ঠিকানা লেখা পাস বাড়ানো আর বুদ্ধি নিখুঁত। যা দেখে ব্যান্ডেলের ফুটবল কোচ অশ্বিনী বরাট বুঝেছিলেন এ ছেলের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। কিন্তু ছেলেটি ডান পা দিয়েই খেলে। ছোট্ট সুরজিৎ সেনগুপ্তকে পোক্ত করতে অশ্বিনীবাবু বলেন, ডান পা ছোঁয়ালেই কান ধরে ওঠবোস করতে হবে। আর এই শাস্তির জেরেই বাঁ পায়েও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিলেন সুরজিৎ। কলকাতায় অচ্যুৎ বন্দ্যোপাধ্যায় শিখিয়েছিলেন বলের উপর নিয়ন্ত্রণ এবং মাঠের দুরূহ কোণ থেকে গোল করার কৌশল। আর ঘষেমেজে হুগলির এই প্রতিভাবান ফুটবলারকে আরও ভয়ঙ্কর করে তুলেছিলেন প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। এই তিন গুরুর দেওয়া ফুটবল-ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করেই সুরজিৎ সেনগুপ্ত দেড় দশক দাপিয়েছেন ভারতীয় ফুটবলে।
বৃহস্পতিবার এই শিল্পী ফুটবলারের প্রয়াণের দিনে সুরজিতের সেরা কিছু ম্যাচের স্মৃতিচারণ করছিলেন প্রাক্তনেরা। গৌতম সরকারের এখনও মনে আছে ১৯৭৫ সালের সেই ঐতিহাসিক আইএফএ শিল্ড ফাইনালের ম্যাচ। যে ম্যাচে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মোহনবাগানকে ৫-০ হারিয়েছিল ইস্টবেঙ্গল। মোহনবাগান মাঠে আয়োজিত সেই ম্যাচে লাল-হলুদ আক্রমণ ভাগে রাজ করেছিলেন সুরজিৎ। দলের প্রথম গোলটাই ছিল তাঁর। তাঁর শরীরের দোলায় কেটে গিয়েছিল মোহনবাগান রক্ষণ। গৌতম সরকারের কথায়, ‘‘সে দিন দারুণ প্রেরণা দিয়েছিল সুরজিৎ। ওর জন্যই মোহনবাগান সে দিন শুরুতে ছন্দ হারিয়েছিল। সুরজিতকে আটকাতে পারছিল না মোহনবাগান রক্ষণ।’’
মিহির বসুর আবার মনে পড়ছে ১৯৭৮ সালের কথা। বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে ময়দানের চিরকুমার ফুটবলার মিহির বলছিলেন, ‘‘সে বার কলকাতা লিগ ও আইএফএ শিল্ড না পাওয়ার দুঃখ ইস্টবেঙ্গল ভুলেছিল ডুরান্ড কাপ জিতে। সুরজিতদাই ছিলেন অধিনায়ক। ওর বুদ্ধিদীপ্ত ফুটবল সামলাতে না পেরে ৩-০ হারে মোহনবাগান। প্রথম গোলটি করে মোহনবাগানকে চাপে ফেলার কাজটি শুরু করেছিল সুরোদাই। ওর জীবনের অন্যতম সেরা ম্যাচ এটি।’’ উঠে আসে ১৯৭৮ সালে বরদলুই ট্রফির ফাইনালে ম্যাচের কথা। গুয়াহাটিতে যে ম্যাচে প্রায় গোটা মাঠ ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে ছিল। প্রতিপক্ষ পোর্ট অথরিটি, ব্যাঙ্কক। সুরজিতের নেতৃত্বেই গ্যালারির সব বিক্ষোভ সামলে ম্যাচের শুরু থেকেই দুর্দান্ত ফুটবল খেলতে শুরু করে ইস্টবেঙ্গল। লাল-হলুদ জার্সিধারীরা জিতেছিলেন ৪-২। দু’টি গোল করেন সুরজিৎ সেনগুপ্ত। বাকি দুই গোল মিহিরের। তিনি বললেন, ‘‘শুরুতেই ওরা গোল করেছিল। আমরা শোধ দিলেও পরক্ষণেও এগিয়ে গিয়েছিল ব্যাঙ্ককের দলটি। সুরজিতদা তখন বলছিল, ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে আজ ভারতের সম্মানও আমাদের কাছে। চল নিজেদের সেরাটা দিয়ে ওদের হারিয়ে আসি। এতেই চেগে গিয়েছিল গোটা দল। সুরজিতদা অপ্রতিরোধ্য
হয়ে উঠেছিলেন।’’
১৯৭৯ সালে ইস্টবেঙ্গলের অধিনায়ক প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের মনে পড়ছে সে বারের শিল্ড সেমিফাইনালের কথা। প্রতিপক্ষ ছিল দক্ষিণ কোরিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় একাদশ। ম্যাচে ০-১ পিছিয়ে ছিল ইস্টবেঙ্গল। এই অবস্থায় সুরজিৎ যে গোলটি করেন, ভারতীয় ফুটবলে তা চিরদিন আলোচিত হবে। প্রথমার্ধের খেলা প্রায় শেষ হওয়ার মুখে। ডান প্রান্ত দিয়ে এগোচ্ছিলেন সুরজিৎ। কোরিয়ার দুই ডিফেন্ডার এগিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু সুরজিতের আউটসাইড ও ইনসাইড ডজে ছিটকে যান। কিন্তু তখনও গোল থেকে প্রায় ৩০ গজ দূরে তিনি। সুরজিৎ পলকেই দেখে নেন এগিয়ে আছে কোরিয়ার দলটির গোলরক্ষক। সবাইকে চমকে দিয়ে কর্নারের লাগোয়া শূন্য ডিগ্রি কোণ থেকে নেওয়া সুরজিতের রামধনুর মতো বাঁক খাওয়ানো শট আটকে যায় জালে। প্রশান্ত বলছিলেন, ‘‘তখন বল হাওয়ায় বেশি বাঁক খেত না। পুরোটাই পায়ের কারসাজি। অনুশীলনে এ রকম গোল বলে বলে করতেন। ওই গোলটার পরেই বুঝে যাই আমরাই জিতব। জিতেওছিলাম। অবিশ্বাস্য খেলেছিলেন সে দিন।’’
১৯৭৭ সালের সন্তোষ ট্রফির ফাইনাল হয়েছিল কলকাতায়। ফাইনালে বাংলার প্রতিপক্ষ ছিল পঞ্জাব। ফাইনালে সুরজিতের দৌড়ের কাছে হার মানে ইন্দার সিংহ, হরজিন্দর সিংহদের পঞ্জাব। বাংলা জেতে ৩-১। অপ্রতিরোধ্য সুরজিতের সামনে ইন্দার সিংহ দর্শনীয় একটি গোল করলেও হার বাঁচাতে পারেননি। যে প্রসঙ্গে মানস ভট্টাচার্যের স্মৃতিচারণ, ‘‘সে বার বাংলার কোচ ছিলেন অরুণ ঘোষ। প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, সুরজিৎ তোকে পঞ্জাবীরা ভয় পায়। তুই দৌড়লেই বাংলা জিতবে। সুরজিতদা দৌড়ে ও ড্রিবল করে একাই শেষ করে দিয়েছিলেন পঞ্জাবকে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy