লর্ডসের বারান্দায় জার্সি খুলে ঘোরাচ্ছেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় (বাঁদিকে)। জার্সি খুলে ছুটছেন কেলি। ছবি: টুইটার
বিস্ফোরণ। উচ্ছ্বাসের। তাতে ‘রক্তাক্ত’ যুবরাজ উইলিয়ামও। ক্লোয়ি কেলি গোল করার পরে যে ভাবে আসন ছেড়ে তিনি লাফিয়ে উঠলেন তাতে কোনও রাজকীয় আদবকায়দা ছিল না। ছিল এক ফুটবল সমর্থকের বাঁধনছাড়া উল্লাস। তখন ম্যাচের অতিরিক্ত সময়। ১১০ মিনিটে জার্মানির জালে বল জড়িয়ে দিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের ফুটবলার ক্লোয়ি কেলি। আর ১০টা মিনিট পার করে দিতে পারলেই প্রথম বার মহিলাদের ইউরো কাপ জিতবে ইংল্যান্ড। বসে থাকতে পারছিলেন না ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামের ৮০ হাজার ইংরেজ সমর্থক। ঠিক তেমনই বসে থাকতে পারেননি বাঙালি তথা ভারতীয়রাও। ম্যাড়মেড়ে ইউরো কাপের মধ্যে গোল করে কেলির জার্সি খোলার দৃশ্য তাঁদের ফিরিয়ে নিয়ে গেল ২০ বছর আগে। লর্ডসের ব্যালকনিতে জার্সি খুলে ঘুরিয়েছিলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। ইংল্যান্ডকে হারিয়ে তাদের মাঠেই দেখা গিয়েছিল সৌরভের বাঁধনছাড়া উল্লাস ও ঔদ্ধত্য।
বক্সের মধ্যে থেকে ডান পায়ের টোকা দিয়ে মারা বলটা জার্মানির গোলে জড়িয়ে যেতেই ছুটতে শুরু করেন কেলি। দুটো হাত তখন কোমরে। সাদা জার্সি খানিকটা উপরে উঠে গিয়েছে। উন্মুক্ত কটি। এ কী কাণ্ড করতে চলেছেন কেলি! কয়েক সেকেন্ড থমকালেন নিজেই। অফসাইড না কি? না, গোল। আর রোখা যায়নি কেলিকে। গ্যালারিতে যুবরাজের উপস্থিতিও থামাতে পারেনি তাঁকে। মুহূর্তের মধ্যে জার্সি হাতে। ঊর্ধ্বাঙ্গে শুধু অন্তর্বাস। জার্সি হাতে ঘোরাতে ঘোরাতে কেলি ছুটে যাচ্ছেন কোচ সারিনা উইগম্যানের দিকে। সতীর্থরা তখন তাঁকে ছোঁয়ার জন্য ছুটছেন। কিন্তু নাগাল পাচ্ছেন না।
আবরণহীন কেলির এই উচ্ছ্বাস ফিরিয়ে নিয়ে গেল ২০ বছর আগে। ওয়েম্বলি থেকে মাত্র ৮ কিলেমিটার দূরে লর্ডসে ন্যাটওয়েস্ট ট্রফি জেতার পরে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে এ ভাবেই জার্সি খুলে উল্লাস করেছিলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। ইংল্যান্ডকে তাদের মাঠে হারিয়ে সেই জার্সি ঘোরানোর মধ্যে ছিল একটা জবাব। সেই সঙ্গে ভারতীয় ক্রিকেটের আগামীর প্রতি একটা বার্তা। ভয়ডরহীন, চোখে চোখ রেখে খেলার বার্তা। সৌরভের সেই জার্সি খোলার দৃশ্য ভারতীয় ক্রিকেটের ক্যানভাসে অন্যতম এক সেরা ছবি।
সৌরভের এই কাজের সমালোচনাও হয়েছিল। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম তাঁকে উদ্ধত বলেছিল। সৌরভের সঙ্গে একই ব্যালকনিতে থাকা ভিভিএস লক্ষ্মণ পরে অনেক বার বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, তিনি বুঝতে পারেননি সৌরভ হঠাৎ ও ভাবে জার্সি খুলে ঘোরাবেন। তিনি থামানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পারেননি। সৌরভ নিজেও পরবর্তী কালে জানিয়েছেন, এখন সেই ঘটনার কথা ভাবলে তাঁর নিজেরই বিব্রত লাগে। মনে হয়, সে দিন একটু বেশিই উচ্ছ্বাস দেখিয়ে ফেলেছিলেন। এতটা না করলেও পারতেন। তবে হরভজন সিংহ আবার চিরকাল সৌরভের কাজের সমর্থন করেছেন। জানিয়েছেন, সৌরভের দেখাদেখি তিনি নিজেও জার্সি খোলার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু রাহুল দ্রাবিড় তাঁকে আটকে দেন। কেলির জার্সি খোলা নিয়ে অবশ্য কোনও সমালোচনা হয়নি। কারণ, ফুটবলে এই ঘটনা প্রায় দেখা যায়। জার্সি খুললে হলুদ কার্ড দেখান রেফারিরা। তার পরেও এই ধরনের উল্লাস কমেনি।
সৌরভের মতো কেলির উচ্ছ্বাসের মধ্যেও ছিল একটা জবাব। যে জার্মানির কাছে এর আগে ২৭ বারের সাক্ষাতে ২৫ বার হারতে হয়েছে তাঁদের, সেই দলকে জবাব দেওয়ার ছিল। জবাব দেওয়ার ছিল সেই সমালোচকদের, যাঁরা কেলিকে জাতীয় দলে নেওয়া নিয়ে সমালোচনা করেছিলেন। জবাব দিলেন তিনি। দেশকে ট্রফি জিতিয়ে দিলেন।
ট্রফি জয়ের পরে কেলির মুখে বার বার উঠে এসেছে স্বপ্নপূরণের কথা। চোটের কারণে এই বছরের অনেকটা সময় মাঠের বাইরেই কাটাতে হয়েছিল ম্যাঞ্চেস্টার সিটিতে খেলা ফরোয়ার্ডকে। জানতেন না ইউরো কাপে খেলতে পারবেন কি না। কিন্তু সেই সময় জাতীয় দল তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিল। তাই বার বার সতীর্থদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন কেলি। বলেছেন, ‘‘ছোট থেকে একটাই স্বপ্ন দেখেছি। ইংল্যান্ডের হয়ে ট্রফি জিতে সেই স্বপ্ন সত্যি হয়েছে। চোট সারাতে যখন রিহ্যাব করছিলাম সেই সময় গোটা দল পাশে ছিল। আমার উপর বিশ্বাস রেখেছিল। সেই বিশ্বাসের দাম দিতে পেরেছি।’’ ধন্যবাদ জানাতে ভোলেননি সমর্থকদের। বলেছেন, ‘‘যাঁরা প্রতিটা মুহূর্তে আমাদের জন্য গলা ফাটিয়েছেন, তাঁদের অনেক ধন্যবাদ। এই ট্রফি তাঁদের জন্য।’’
ঘোরের মধ্যে ছিলেন ইংল্যান্ডের অধিনায়ক লিয়া উইলিয়ামসনও। শেষ বাঁশি বাজার পরে ঘোর কাটতে কিছু ক্ষণ সময় লাগে তাঁর। যুবরাজ উইলিয়ামের কাছ থেকে ট্রফি নিতে যাওয়ার আগে একটু সময় নেন ইংল্যান্ডের অধিনায়ক। তার পরে এগিয়ে যান পোডিয়ামের দিকে। বার বার কেঁদে ফেলছিলেন লিয়া। পরে সাংবাদিকদের সামনে বলেন, ‘‘অনেক কিছু মনে পড়ছে। নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারছি না। এ বার প্রতিযোগিতার আগে থেকে আমরা শুধু জয়ের কথা ভেবেছি। পরিকল্পনা করেছি। শেষ পর্যন্ত জিতেছি। এর থেকে বড় গৌরবের মুহূর্ত আমার কাছে নেই। এর প্রতিটা সেকেন্ড আমি উপভোগ করতে চাই।’’
সত্যিই তো, উচ্ছ্বাস থামেনি ইংল্যান্ডের। কোচ উইগম্যানের সাংবাদিক বৈঠকে গান গাইতে গাইতে দল বেঁধে ঢুকে পড়েন ফুটবলাররা। টেবিলের উপর চেপে নাচেন। কোচকে জড়িয়ে ধরেন। এই ঘটনায় অবাক হয়ে যান সাংবাদিকরাও। কয়েক মিনিট পরে যখন তাঁরা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান তখন কোচ বলেন, ‘‘এ বার মনে হচ্ছে আমরা সত্যিই ট্রফি জিতেছি।’’
এর আগে ১৯৮৪ ও ২০০৯ সালের ইউরো কাপের ফাইনালে উঠে হারতে হয়েছিল ইংল্যান্ডকে। তার মধ্যে শেষ বার প্রতিপক্ষ ছিল জার্মানি। ১৩ বছর পরে বদলা নিল ইংল্যান্ড। খাতায় কলমে প্রতিপক্ষ এগিয়ে থাকলেও ঘরের মাঠে শুরু থেকেই আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলেন কেলি, এলা টুন, লিয়া উইলিয়ামসনরা। প্রথম গোল দেন তাঁরাই। ৬২ মিনিটের মাথায় দলকে এগিয়ে দেন এলা। তবে হাল ছাড়েনি জার্মানি। ৭৯ মিনিটের মাথায় সমতা ফেরান লিনা মাগুল। ৯০ মিনিটে খেলার ফয়সালা না হওয়ায় অতিরিক্ত সময়ে গড়ায় খেলা। ১১০ মিনিটে কেলির গোলে বাজিমাত করে ইংল্যান্ড।
‘দিদির কীর্তি’-তে ৫৬ বছর পরে অধরা স্বপ্ন পূরণ হল ইংরেজদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy