ভারতীয় ফুটবলে সুরজিৎদা তখন তারকা। সাধারণত দলের তরুণ ফুটবলারদের সঙ্গে তারা একটু দূরত্ব বজায় রেখেই চলে সব সময়। কিন্তু সুরজিৎদা ছিল ব্যতিক্রমী।
নৈপুণ্য: এই স্কিলই সুরজিতের সেরা অস্ত্র ছিল। ফাইল চিত্র।
ময়দানে আমার অভিভাবক-কে হারালাম। সুরজিৎদা (সেনগুপ্ত) না থাকলে ১৯৭৫ সালের আইএফএ শিল্ডের ফাইনালে ইস্টবেঙ্গলের কাছে পাঁচ গোলে বিপর্যয়ের পরে আমার ফুটবলজীবনই হয়তো শেষ হয়ে যেত।
অসংখ্য বড় ফুটবলারের সঙ্গে খেলার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। ভবিষ্যতেও ভারতীয় ফুটবলে অনেক তারকা দেখা যাবে। কিন্তু বড় মনের ফুটবলারের সংখ্যা নগন্য। সুরজিৎদা ছিল এই বিরল প্রতিভার অধিকারী। পঁচাত্তরের সেই ম্যাচ আমার কাছে এখনও দুঃস্বপ্নের মতো। সুরজিৎদাই প্রথম গোল করে এগিয়ে দিয়েছিল ইস্টবেঙ্গলকে। যত দূর মনে পড়ছে সুভাষ ভৌমিকের ব্যাক পাস ধরে বল গোলে ঠেলে দিয়েছিল। এত দ্রুত সব কিছু ঘটে গিয়েছিল যে, বুঝতেই পারিনি। এই ম্যাচের পরে আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। আমি নিজেও শঙ্কিত ছিলাম। তবুও পরের বছর ইস্টবেঙ্গল আমাকে সই করিয়েছিল। ফুটবলার সুরজিৎদার অনেক দিন ধরেই ভক্ত ছিলাম। এ বার চিনলাম মানুষ সুরজিৎদাকে। আমার মতো সদ্য বড় ক্লাবে খেলা শুরু করা অনুজকে প্রথম দিনই বুকে টেনে নিয়েছিল। স্নেহ, ভালবাসা দিয়ে আগলে রেখেছিল খেলা ছাড়ার পরেও।
ভারতীয় ফুটবলে সুরজিৎদা তখন তারকা। সাধারণত দলের তরুণ ফুটবলারদের সঙ্গে তারা একটু দূরত্ব বজায় রেখেই চলে সব সময়। কিন্তু সুরজিৎদা ছিল ব্যতিক্রমী। জানত, আমি মানসিকভাবে কতটা বিপর্যস্ত। পাঁচ গোলে (যদিও আমি চারটি গোল খেয়েছিলাম) হারের যন্ত্রণায় বিধ্বস্ত। সেই সময় অনেকেই সান্ত্বনা দিয়েছিল। কেউ কেউ পরামর্শ দিয়েছিল, সব ভুলে যেতে। তা সত্ত্বেও আমি সব সময় গুটিয়ে থাকতাম। মনে হত, কেউ না কেউ নিশ্চয়ই ওই ম্যাচের প্রসঙ্গ তুলবে। সুরজিৎদা কোনও দিন পঁচাত্তরের শিল্ড ফাইনাল নিয়ে একটাও কথা বলেননি আমার সঙ্গে। এমন ভাবে ব্যবহার করতেন, যাতে মনে হবে অস্বাভাবিক কিছু হয়নি ওই ম্যাচে। ফুটবলে এ রকম হতেই পারে। ধীরে ধীরে আমিও সহজ হলাম। আমার মনের মধ্যে কিন্তু তখনও রক্তক্ষরণ হচ্ছে। তার মধ্যেই মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম নিজেকে প্রমাণ করার জন্য। এর জন্য সব চেয়ে জরুরি ছিল নিজের ভুলভ্রান্তি খুঁজে বার করে তা শোধরানোর চেষ্টা করা। কিন্তু ক্লাবের অনুশীলনে তা সম্ভব নয়। এর জন্য আলাদা ভাবে পরিশ্রম করতে হবে। শেষ পর্যন্ত সুরজিৎদার দ্বারস্থ হলাম। এক দিন অনুশীলন শেষ হওয়ার পরে একটু ভয়ে ভয়েই বললাম, গোলে দাঁড়াচ্ছি। আমাকে কয়েকটা শট মারবে? আমার আগ্রহ দেখে সুরজিৎদা সে দিন এত খুশি হয়েছিল, লিখে বোঝাতে পারব না।
শুরু হল আমার প্রত্যাবর্তনের লড়াই। সুরজিৎদা তখন আর শুধু অগ্রজ সতীর্থ নয়, আমার গুরুও। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে মাঠের বিভিন্ন জায়গা থেকে শট মেরে চলেছে, আর আমি গোলে দাঁড়িয়ে বাঁচানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। মাসের পর মাস এ ভাবে আমাকে অনুশীলন করিয়ে গিয়েছিল সুরজিৎদা। এক, এক দিন বুঝতে পারতাম শট মারতে মারতে ওর পায়ে ব্যথা হয়ে গিয়েছে। তবুও থামেনি। হাসি মুখে বল বসিয়ে আমাকে বলত, ‘‘শট মারছি। গোল খাওয়া চলবে না।’’
মাঠের বাইরেও আমাকে আগলে রাখত। কী ভাবে খেলা উচিত সব সময় পরামর্শ দিয়েছে। কী ধরনের জীবনযাপন করা উচিত তা বলতেন। আমাদের তখন বয়স কম ছিল। বিপথে যাতে চলে না যাই, তার জন্য কড়া নজর ছিল সুরজিৎদার। বিশেষ করে বিদেশে খেলতে গেলে। তবে কখনওই কাউকে বকেনি। কেউ ভুল করলে মাথায় হাত বুলিয়ে খুব নরম করে বলত। অবশ্য একা আমি নই, অনুজদের প্রতি বরাবরই সুরজিৎদার আলাদা দুর্বলতা ছিল।
সুরজিৎদা আমার পরিবারেও অভিভাবক ছিল। সালটা এখন আর মনে নেই। কলকাতার বাইরে খেলতে গিয়েছি। আমার স্ত্রীর অ্যাপেনডিসাইটিসের ব্যথা উঠল। খবর পেয়ে সুরজিৎদাই আমার বাড়ি গিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে সোজা হাসপাতালে গিয়েছিল। অস্ত্রোপচারের সময় সেখানেই দাঁড়িয়েছিল। আমরা দেখা পরিপূর্ণ মানুষ ছিল সুরজিৎদা। যে রকম অসাধারণ ফুটবলার ছিল, তেমনই ছিল গানের গলা, তবলার হাত, অভিনয়ের দক্ষতা, লেখার মুন্সিয়ানা। সর্বগুনসম্পন্ন মানুষ। একসঙ্গে খেলার পাশাপাশি স্টেট ব্যাঙ্কে চাকরিও করেছি আমরা। সেখানেও সুরজিৎদা সব সময় আগলে রাখত। ভাই হয়েই আমিই পারলাম না দাদাকে ধরে রাখতে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy