অস্ত্র: ফুরফুরে কামিংস। শুক্রবার। ছবি:সুদীপ্ত ভৌমিক।
অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপার। ক্রিকেটের নয়, ফুটবলের। লিয়োনেল মেসির সঙ্গে বিশেষ মুহূর্ত। সারা শরীর ভর্তি ট্যাটু। জোকারের ভক্ত। মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের গোলমেশিন। চলতি সেমিফাইনালে ওড়িশার বিরুদ্ধেও প্রথম গোল তাঁর। আজ, শনিবার যুবভারতীতেও কি পারবেন সবুজ-মেরুন ভক্তদের মুখে হাসি ফোটাতে? আইএসএল ফাইনালের আগের দিন যুবভারতীর পাশে পাঁচতারা হোটেলে বসে আনন্দবাজারকে একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন জেসন কামিংস।
প্রশ্ন: ফাইনালের আগে মোহনবাগানের গোলমেশিনের মনের মধ্যে কী চলছে?
জেসন কামিংস: আমি খুবই উত্তেজিত ফাইনাল নিয়ে। যদি আমি শিল্পী হই, তা হলে শনিবারই এ বছরের শেষ জলসা। এই দিনটার জন্য, এই মুহূর্তটার জন্যই তো সারা বছর ধরে এত পরিশ্রম করেছি। মরসুমটা দারুণ গিয়েছে আমাদের। ডুরান্ড জিতেছি, আইএসএল শিল্ড জিতেছি। এখন আমাদের সামনে ইতিহাস তৈরির সুযোগ। ত্রিমুকুট জেতার সুযোগ। ঔদ্ধত্য দেখাচ্ছি না। যেমন বড় ম্যাচ, তেমনই তো বড় ক্লাব খেলতে নামছে। বড় বড়
ফুটবলাররা আছে।
প্র: সেমিফাইনালে রুদ্ধশ্বাস জয় কি অনেক মনোবল বাড়িয়ে দিচ্ছে গোটা দলের?
কামিংস: পিছিয়ে থাকা অবস্থায় এমন জয় মনোবল বাড়িয়ে তো দেয়ই। বিশেষ করে তা যদি হয় সেমিফাইনালে। যেখানে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে। দু’গোলের ব্যবধানে জিততে হবে। নিজেদের ঘরের মাঠে এমন নাটকীয় জয়। সমর্থকদের এত ভালবাসা, এত উৎসব। এর জন্যই তো ফুটবল খেলতে আসা।
প্র: এই মুহূর্তে সবুজ-মেরুন সমর্থকদের ডার্লিং আপনি। নিশ্চয়ই প্রচুর অনুরোধ আসছে ফাইনালেও গোল করার জন্য...
কামিংস: আচ্ছা, আমি কিন্তু সব সময় জনতার ডার্লিং ছিলাম না। আমি অনেকটা বক্সের মধ্যে ধূর্ত শেয়াল ঘরানার স্ট্রাইকার। দর্শকেরা দর্শনীয় গোল দেখতে পছন্দ করেন। খুব স্বাভাবিক। চল্লিশ গজের দুরন্ত শটে গোল বা কর্নার থেকে দারুণ ফিনিশ। যেগুলো আমাদের দলে দিমি (দিমিত্রি পেত্রাতস) করে। আমি ও রকম নই। আমার কাছে গোল হল গোল। ছোট্ট ট্যাপিংয়ে গোল পেলেও আমি একই রকম উচ্ছ্বসিত হই। জালে বল জড়িয়ে যাচ্ছে দেখলেই আমি খুশি। আমার মনে হয়, মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট সমর্থকেরাও আমাকে বুঝতে পারছেন এখন। তাঁরা এটাও বুঝেছেন যে, আমি মাঠের মধ্যে একশো শতাংশ উজাড় করে দিই। তাই হয়তো ওঁরা আমাকে ভালবাসতে শুরু করেছেন। ইনস্টাগ্রামে অনেকে আমাকে মেসেজ পাঠান। যে আবেগ আমি দেখতে পাই মোহনবাগান সুপার জায়ান্টকে নিয়ে স্টেডিয়ামে বা রাস্তাঘাটে, যে ভাবে সবুজ-মেরুন পতাকা বুকে জড়িয়ে ‘জয় মোহনবাগান, জয় মোহনবাগান’ বলে স্লোগান তোলেন, তাতে জেদটা আরও বেড়ে যায়। বড় ম্যাচে গোল করতে পারলে তবেই তো বড় ফুটবলার হওয়া যায়। আমি বড় খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্ন দেখেছি সব সময়।
প্র: বাংলা শব্দও কি শিখতে শুরু করেছেন নাকি? জয় মোহনবাগান তো একটুও না বেঁধে বেশ বলে দিলেন!
কামিংস (হাসি): না, খুব একটা শিখতে পারিনি। বাংলা খুব কঠিন ভাষা মনে হয়। ‘জয় মোহনবাগান’ প্রচুর শুনি, তাই ওটা শিখে গিয়েছি। ইচ্ছা আছে আরও কিছু বাংলা শব্দ শিখব।
প্র: জীবনে অনেক ড্রেসিংরুমেই সময় কাটিয়েছেন। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে বিশ্বকাপ খেলেছেন। মোহনবাগান ক্লাব, এমবিএসজি ড্রেসিংরুম নিয়ে অভিজ্ঞতা কী রকম?
কামিংস: মোহনবাগান তাঁবুতে পা দিলে যে কারও গায়ে কাঁটা দেবে। এত ঐতিহ্য, এত ইতিহাস এই ক্লাবের! সঙ্গে এমন সমর্থককুল। রোজ যা বেড়ে চলেছে। আমার কী মনে হয় জানেন? সমর্থকদের এই অকৃত্রিম ভালবাসাটা বুঝতে পারলে জার্সির বুকে ক্লাবের যে ব্যাজটা লাগানো আছে, তার মর্মও আমরা, খেলোয়াড়েরা উপলব্ধি করতে পারব। মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের সঙ্গে এই পর্বটা হৃদয়ে গেঁথে যাচ্ছে। ছেলেমেয়েদের বলব, নাতি-নাতনিদের গল্প শোনাব।
প্র: আপনার মতে মোহনবাগানের দল হিসেবে সাফল্যের প্রধান মশলা কী?
কামিংস: আমরা ট্রেনিংয়ে যেমন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করি তেমনই সবাই মিলে খুব আনন্দ করি, হাসাহাসি করি। দলে আরও দু’জন অস্ট্রেলীয় আছে। দিমি, ব্রেন্ডন। ওদের সঙ্গে হয়তো আমি বেশি সময় কাটাই। কিন্তু যে দিন থেকে এখানে এসেছি, সকলের সঙ্গে দারুণ বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, যে দল মাঠের বাইরে এককাট্টা থাকতে পারে, তারাই মাঠে বেশি জেতে। আমার মনে হয় মোহনবাগানের সাফল্যের প্রধান কারণ এটাই। আমরা এক দল, এক পরিবার।
প্র: সেমিফাইনালে শেষ গোলটা হওয়া পর্যন্ত বেশ উদ্বেগের প্রহর চলছিল।
কামিংস: একটা কথা বলি। প্রথম পর্বে এগিয়ে গিয়ে হেরে গেলেও কিন্তু আমাদের গোলকিপার, রক্ষণ দারুণ খেলেছে গোটা মরসুমে। আমি মনে করি বিশাল (কেইথ) ভারতের সেরা গোলকিপার। ইউরোপে গিয়েও অনায়াসে খেলতে পারে। বিশালের মতো প্রহরী গোলে থাকা মানে বাকি দল আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে। সাহালের গোলটা নিয়ে আর কী বলব? বিশাল বোঝা নামলে যেমন শান্তি হয়, তেমন মনে
হচ্ছিল সকলের।
প্র: ফাইনালে প্রতিপক্ষ মুম্বই। তিন বছর আগে ফাইনালে হারিয়েছিল। এ বার আপনারা হারিয়েছেন মুম্বইকে। এ বারের পূর্বাভাসে কী বলা যেতে পারে?
কামিংস: নতুন ম্যাচ, নতুন দিন। আমরা গতবারের চ্যাম্পিয়ন কিন্তু মুম্বইও শক্তিশালী দল। আমাদের দেখতে হবে যেন বেশি স্নায়ুর চাপে না ভুগতে শুরু করি। একটা কথা আছে না, ‘প্লে দ্য গেম, ডোন্ট প্লে দ্য অকেশান’, সেটা মাথায় রাখা দরকার। কয়েক দিন আগেই মুম্বইকে আমরা হারিয়েছি। সেটাও ফাইনালের মতোই ছিল। গ্যালারি ভর্তি সবুজ-মেরুন ভক্ত আমাদের সব চেয়ে বড় শক্তি।
প্র: বড় ম্যাচের আগে চাপ কমানোর কোনও বিশেষ প্রক্রিয়া আছে আপনার?
কামিংস: নির্দিষ্ট কিছু নেই। এমনিতেই আমি বেশ নির্বিকার থাকতে পারি। হয়তো অভিজ্ঞতা থেকে এসেছে। বড় ম্যাচের সকালে উঠে হাত-পা কাঁপে না। সতীর্থদের সঙ্গে হয়তো ভিডিয়ো দেখলাম বা কফি নিয়ে আড্ডা মারলাম। দিমির (দিমিত্রি) সঙ্গে দাবা খেললাম। ওকে হারিয়ে দিতে পারলে আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে মাঠে যেতে
পারি (হাসি)।
প্র: কলকাতা শহরটাকে চেনার চেষ্টা করছেন কি?
কামিংস: নিশ্চয়ই। সময় পেলেই আমি বেরোই। তবে এখন যা গরম, ১০-১৫ মিনিটের বেশি বাইরে থাকতে পারছি না। আমার মা এসেছিল। খেলা দেখেছে, কলকাতা ঘুরেছে। বাবা এসেছে। ফাইনাল দেখবে। বান্ধবী রয়েছে। পরিবারের লোকজন নিউ মার্কেট ঘুরে এসেছে। ‘সিটি অব জয়’ সম্পর্কে কে না শুনেছে! শহরটায় যেখানেই যান, কিছু না কিছু মন
ছুঁয়ে যাবেই।
প্র: আচ্ছা, আপনার শরীরে ঠিক কতগুলো ট্যাটু রয়েছে?
কামিংস (হাসি): ওহ্ ম্যান, আই লাভ ট্যাটুজ়। আমার শরীর ভর্তি ট্যাটু। কতগুলো গুনিও না। আমার মায়ের নামে রয়েছে, পোষা কুকুরের জন্য আছে, বান্ধবীর জন্য আছে। হাতে আছে জোকার ট্যাটু। ত্রিমুকুট জিতলে সেটারও ট্যাটু করব।
প্র: আপনি জোকার-ভক্ত। ইনস্টাগ্রামে প্রোফাইলে জোকারের ছবি। হাতে জোকারের ট্যাটু। বিশেষ কোনও কারণ?
কামিংস: জোকার আমার সবচেয়ে প্রিয় চরিত্র। আমার মনে হয়, জোকার দারুণ এক চরিত্র যাকে সবাই ভুল বোঝে। আমি জোকার মুভি, কমিক দেখতে পছন্দ করি। প্রায় সবকটাই আমার দেখা।
প্র: গোল করার পরে মুখের কাছে হাত নিয়ে আপনার বিশেষ উৎসবের ভঙ্গি খুব জনপ্রিয়। এটার অর্থ আসলে কী?
কামিংস: আমি জোকারের বিরাট ফ্যান। ডান হাতে জোকারের হাসির ট্যাটু রয়েছে। গোলের পরে হাতটাকে মুখের সামনে এনে আমি জোকারের হাসিতে উৎসব করি। বিশ্বাস করি, জোকার কোনও দুষ্টু লোক নয়। আমাদের অনেক বিনোদনও দিয়েছে। বিশেষ করে আমার জীবনে বিরাট প্রভাব জোকার চরিত্রের।
প্র: স্কটল্যান্ড থেকে অস্ট্রেলিয়া। আপনার মায়ের দেশের হয়ে বিশ্বকাপ খেলা। মেসির সঙ্গে কথোপকথন। কাতার বিশ্বকাপ নিশ্চয়ই জীবনের সেরা অভিজ্ঞতা?
কামিংস: ফুটবলে বিশ্বকাপের চেয়ে বড় কি আর কিছু হতে পারে? ফ্রান্স বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন দল। তাদের বিরুদ্ধে খেলছি। আর্জেন্টিনা। লিয়োনেল মেসি! এখনও বিশ্বাস হয় না। অস্ট্রেলিয়ার ফুটবল ভক্তদের ভালবাসা, আবেগ। যেখানে যাচ্ছি, হলুদে হলুদ।
প্র: মেসির সঙ্গে ভিডিয়ো, ছবিও রয়েছে আপনার। কী কথোপকথন হয়েছিল?
কামিংস: আমি বলেছিলাম, অল দ্য বেস্ট। বলেছিলাম, আশা করব তুমি বিশ্বকাপ জিতবে। মেসি আর রোনাল্ডো ফুটবলকে বদলে দিয়েছে। কী সব রেকর্ড! একটা-দু’টো মরসুম নয়, পরের পর বছর ধরে ওরা সফল হয়েছে। অবিশ্বাস্য!
প্র: মেসি কি আপনাকে কিছু বলেছিলেন?
কামিংস: ওর ভাষাগত সমস্যা রয়েছে। আমার কথা খুব বেশি বুঝতে পারছিল না। আমিও সত্যি কথা বলতে কী, বুঝিনি কী বলছিল। সেটা বড় কথা নয়। ওই মুহূর্তটাই তো সেরা প্রাপ্তি। ভেবেছিলাম, সারা জীবন ওদের টিভিতে দেখেই কেটে যাবে। একই ম্যাচে খেলব, তা-ও আবার বিশ্বকাপের মতো সর্বোচ্চ মঞ্চে! চিমটি কেটে দেখতে হয় সত্যিই ঘটেছে তো?
প্র: ফ্রান্সের বিরুদ্ধেও তো খেলেছিলেন। এমবাপেকে নিয়ে কী বলবেন?
কামিংস: ওই আর এক জন। এমবাপে। আমি শেষ তিরিশ মিনিট মতো খেলেছিলাম ফ্রান্সের বিরুদ্ধে। কী অসম্ভব ক্ষিপ্র! প্রথম দশ-বারো মিনিট শুধু আমার ঘাড়টা এদিক-ওদিক দুলছিল। এত দ্রুত বল চলে যাচ্ছে। কিছু ধরতেই পারছিলাম না।
প্র: আপনি জেসন কামিংস। আর এক জন আছেন প্যাট কামিন্স। তিনিও অস্ট্রেলিয়ার। চেনেন?
কামিংস: অবশ্যই জানি। অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপজয়ী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক। অস্ট্রেলিয়ায় যখন এ-লিগ খেলতাম, তখন দেখতাম ক্রিকেট নিয়ে আগ্রহ অনেকের। ভারতে এসে দেখলাম, ক্রিকেট এখানে আরও বড়। ক্রিকেট আমি দেখেছি, উপভোগ করেছি। আশা করব প্যাট কামিন্সের সঙ্গেও এক দিন দেখা হবে।
প্র: আইপিএল চলছে। এখনই তো কামিন্সের সঙ্গে দেখা হতে পারত। আইপিএল দেখার কি ইচ্ছা আছে?
কামিংস: হয়তো দেখব ভবিষ্যতে। তবে জাতীয় দলের ক্রিকেট খেলা আমি বেশি দেখেছি। ভারত বনাম অস্ট্রেলিয়া দেখেছি। বেশ উপভোগও করেছি।
প্র: শনিবার কাপ-ভাগ্য কীসের উপরে নির্ভর করবে? একটা জিনিস বলুন যা ফাইনালের ভাগ্য নির্ধারণ করে দিতে পারে।
কামিংস: কাদের মধ্যে বেশি ইচ্ছাশক্তি রয়েছে, কারা বেশি ক্ষুধার্ত। আমার মনে হয় তারাই জিতবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy