ভারতের মহিলা হকি দলের ক্যাপ্টেন রানি রামপালের চোখ টোকিয়ো অলিম্পিকে। —ফাইল চিত্র।
ভারতীয় হকিতে তিনিই প্রথমা। এর আগে কোনও মহিলা হকি খেলোয়াড় খেলরত্ন সম্মান পাননি। যা এ বার পেতে চলেছেন রানি রামপাল। জাতীয় হকি দলের ক্যাপ্টেন যা নিয়ে অবশ্যই রোমাঞ্চিত। তবে তাঁর পাখির চোখ থাকছে পরের বছরের অলিম্পিকে। তেরঙা হাতে পোডিয়াম, বাজছে জনগণমন... অধিনায়কের স্বপ্নে এই ছবিই ধরা পড়ছে। সেই স্বপ্নেরই সঙ্গী হল আনন্দবাজার ডিজিটাল, বেঙ্গালুরু ক্যাম্প থেকে দেওয়া এই একান্ত সাক্ষাৎকারে।
আপনার জীবন তো রূপকথারই মতো। অজস্র প্রতিকূলতা টপকে, লড়তে লড়তে এগোতে হয়েছে। শুরুর দিনগুলো থেকে খেলরত্ন সম্মান— এই সফর কী ভাবে দেখছেন?
রানি রামপাল: এটা আমার কাছে বিশাল সম্মান। মহিলা হকি খেলোয়াড় হিসেবে এই ঐতিহ্যশালী খেলরত্ন একটা মস্ত বড় স্বীকৃতিও। এর আগে কোনও মহিলা হকি খেলোয়াড় এই সম্মান পাননি। আমিই প্রথম। সেটাও গর্বের জায়গা। আমি এই সম্মান উৎসর্গ করছি করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যাঁরা লড়ছেন, সেই সমস্ত ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের। এবং অবশ্যই এই সম্মান আমাদের মহিলা হকি দলের প্রত্যেকের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাইছি।
খেলরত্ন সম্মান উৎসর্গ করলেন করোনার বিরুদ্ধে যোদ্ধাদের। আপনি লকডাউনে সতীর্থদের সঙ্গে অর্থসংগ্রহে নেমেছিলেন। আর সেই অর্থে শুকনো খাবার বিলি করা হয়েছিল। এই তাগিদের জন্ম কি ছোটবেলার লড়াই?
রানি রামপাল: আমি বড় হয়েছি অনেক লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে। আমার মনে হয়, ক্রীড়াবিদ হিসেবে আমাদের একটা সামাজিক দায়িত্ব রয়েছে। শুধু আমি একা নই, সবাই একটা কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছি। প্রত্যেকেই নানা সমস্যার সামনে পড়েছি। সেই কারণেই যাঁদের দরকার, তাঁদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে চেয়েছিলাম। এখানে আবার ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মীদের কথা ফের বলতেই হচ্ছে। তাঁরা নিজের প্রাণ হাতে নিয়ে বাকিদের নিরাপত্তার জন্য লড়ে চলেছেন কোভিডের বিরুদ্ধে। তাঁদেরকে স্যালুট।
আরও পড়ুন: ধোনির থেকে বাংলাদেশের অনেক কিছু শেখার আছে, বলছেন হাবিবুল বাশার
কোভিডের জন্য অলিম্পিক পিছিয়ে গিয়েছে। এটা তো আপনাদের কাছেও চ্যালেঞ্জের।
রানি রামপাল: হ্যাঁ, আমাদের কাছেও এটা কঠিন সময়। অলিম্পিক পিছিয়ে গিয়েছে। আমরা একটা লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছিলাম, তৈরি হচ্ছিলাম। সেটা এক বছর পিছিয়ে যাওয়া মানে থমকে যাওয়া সব কিছু। তবে আমি সব সময় পজিটিভ দেখতে চাই যে কোনও পরিস্থিতির মধ্যে। এখন যেমন ভাবছি যে আরও এক বছর হাতে পাচ্ছি প্রস্তুতির জন্য। তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে কোনও ফাঁক রাখব না আমরা।
এই এক বছরে কী ভাবে প্রস্তুতি চলবে, তার নকশা হয়েছে?
রানি রামপাল: আমরা এখন বেঙ্গালুরুতে জাতীয় শিবিরে রয়েছি। অলিম্পিকের জন্যই ঘাম ঝরাচ্ছি অনুশীলনে। সবাই খুব খাটছি। টোকিয়ো অলিম্পিকে নিজেদের সেরাটা মেলে ধরতে হবে, এই প্রতিজ্ঞা সঙ্গী হচ্ছে সবার।
২০১৮ সালে এশিয়াডে ফাইনালে উঠেও সোনা আসেনি। এ বার অলিম্পিকে মহিলাদের হকি নিয়ে প্রত্যাশা বাড়ছে তাই। এক ধাপ কি এগনো সম্ভব?
রানি রামপাল: দেখুন, ২০১৮ সালে আমরা রানার্স আপ হয়েছিলাম। রুপো এসেছিল। ফাইনালের সেই পরাজয় থেকে অনেক কিছু শিখেছিলাম আমরা। সেগুলো আমাদের মাথায় আছে। সোনা না পেলেও এশিয়াডের পারফরম্যান্স আমাদের আত্মবিশ্বাস অনেক বাড়িয়েছে। যা অলিম্পিকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করব। আশা করছি, টোকিয়োয় এক ধাপ এগোতে পারব। সেই মোটিভেশন রয়েছে আমার দলে। এই দলের সবাই নিজের ক্ষমতায় বিশ্বাস রাখে। জানে, উজাড় করে দিতে পারলে কোনও কিছুই অসম্ভব নয়। আর সেই লক্ষ্য সামনে রেখে পরিশ্রম করছি সবাই।
২০১০ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে জাতীয় দলে এসেছিলেন। সেই বছরেই মহিলাদের অলস্টার দলে জায়গা করে নিয়েছিলেন। আপনার এই উত্থানের সঙ্গে কোথাও যেন সচিন তেন্ডুলকরের মিল দেখা যাচ্ছে।
রানি রামপাল: প্রথমেই বলে রাখি, এই সফর মোটেই সহজ ছিল না। শুরুর দিকে অস্বস্তি হত। নিজের মধ্যেই জন্ম নিত সংশয়। এত বড় বড় সব নাম, এত সিনিয়রদের পাশে আমি জায়গা করে নিতে পারব তো! আগেও বলেছি, দেশের হয়ে লম্বা সময় ধরে খেললে ভাল-মন্দ সব রকম অভিজ্ঞতাই হয়। এটা প্রত্যেকের জীবনেরই অঙ্গ। প্রত্যেককেই চলার পথে প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়, তা টপকে যেতে হয়। মসৃণ চলা আর ক’জনের হয়!
কখনই হাল ছাড়া যাবে না, ভরসা রাখতে হবে নিজের উপর, এটাই মন্ত্র রানির। ছবি টুইটার থেকে নেওয়া।
(একটু থেমে) আমি যখন প্রথম হকি খেলতে শুরু করি, তখন জাতীয় দলে দারুণ দারুণ সব খেলোয়াড় ছিলেন। আমি তাঁদের থেকে শিখেছি। তাঁদের দেখে উদ্দীপ্ত হয়েছি। তাঁদের মতো খেলতে চেয়েছি। ভারতের প্রতিনিধিত্ব করতে চেয়েছি। খেলতে খেলতে তার পর এসেছে অভিজ্ঞতা। ধাতস্থ হয়েছি সব কিছুর সঙ্গে। বরাবরই আমার মনে হয়েছে যে, আরও পরিশ্রম করতে হবে। পরিশ্রমের কোনও বিকল্প হয় না। কোনও লক্ষ্যে পৌঁছতে পারলাম কি পারলাম না, সেটা বড় নয়। পরিশ্রম করতেই হবে। আমি নিজে কখনও সন্তুষ্ট হইনি। একটা মিশনে সফল হলে পরের মিশনের দিকে তাকিয়েছি। এই যে বললাম, কখনই হাল ছাড়িনি। কখনই সন্তুষ্ট হয়ে থেমে থাকিনি।
চলার পথ সহজ ছিল না, নিজেই বললেন। হরিয়ানায় দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে প্রবল সংগ্রামের দিনগুলো মনে পড়ে?
রানি রামপাল: খুব কঠিন দিন গিয়েছে। আমি খুব গরিব ঘর থেকে উঠে এসেছি। বাবা ছিলেন ঠেলাগাড়ির চালক। বেঁচে থাকাটাই ছিল ভেরি ডিফিকাল্ট। তিন ভাই-বোনের সংসার ছিল। ভয়ানক সব দিন দেখেছি।
অর্থাৎ, বেঁচে থাকার লড়াইয়ে হকিই হয়ে উঠেছিল অস্ত্র। এটা স্রেফ খেলা ছিল না, ছিল বাঁচার মাধ্যম।
রানি রামপাল: ছোটবেলা থেকে হকি ছিল আমার প্যাশন। হকি খেলতে ভালবাসতাম। সেই কারণেই হকি খেলায় মন দিই। স্বপ্ন দেখতাম যে, এক দিন দেশের হয়ে খেলছি। এটাও মনে ছিল যে, দেশের হয়ে খেলতে পারলে যদি পরিবারকে বাঁচাতে পারি। ধীরে ধীরে এটাই জীবন হয়ে উঠল। খুব খাটতাম। জাতীয় দলে আসার পর চাকরি পেলাম। ইট ওয়াজ রিয়েলি স্ট্রাগলিং পিরিয়ড। নট ইজি। জীবন আমাকে একেবারেই সাজিয়ে দেয়নি কিছু। তবে এটাও ভাবি যে, আমি নিশ্চয়ই আশীর্বাদধন্যা। আমি ব্লেসড যে হকি খেলতে পারি। উপরওয়ালা আমাকে সেই শক্তি দিয়েছেন। সেই কারণেই সব হার্ডল, বাধা-বিপত্তি টপকে চলতে পেরেছি।
আরও পড়ুন: মেসি, রোনাল্ডোর সাম্রাজ্যে ভাগ বসাতেন লেওনডস্কি? কে পেতে পারতেন এ বারের ব্যালন ডি’অর
এই লড়াই তো অনেকের কাছেই অনুপ্রেরণার। আপনি এখন নবীন প্রজন্মের কাছে রোল মডেল। এটা তো একটা দায়িত্বও। আপনি কী ভাবে পরের প্রজন্মদের জীবনের লড়াইয়ে গাইড করতে চাইবেন?
রানি রামপাল: আমি যখন হকি খেলতে শুরু করেছিলাম, তখন অনেককে দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। এখনও হয়তো আমাকে দেখে কেউ কেউ অনুপ্রাণিত হচ্ছেন। এটা একটা চেনের মতো। মহিলা হিসেবে একটাই টোটকা বা পরামর্শ থাকবে সবার কাছে— নিজের উপর বিশ্বাস যেন কখনও না হারায়। বিলিভ ইন ইওরসেল্ফ। আর কেউ বিশ্বাস না রাখলেও নিজের আস্থা যেন অটুট থাকে। নিজের বিশ্বাস বজায় থাকলে এক সময় বাকিরাও ভরসা রাখবে। এবং আরও একটা কথা। দয়া করে কেউ ভাববেন না যে গরিব পরিবার থেকে উঠে এলে কিছুই করা যায় না। এটা একদমই ঠিক নয়। দ্রারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করেও জেতা যায়। গরিব মানেই হেরে গেলাম গোড়ায়, এই ভাবনা একেবারে ত্যাগ করতে হবে। যদি প্যাশন থাকে, যদি সামনে টাঙানো লক্ষ্যের দিকে ঠিক ভাবে চলা যায়, তবে সব কিছুই অর্জন করা যায়। আবার বলছি, মন যা চায়, তার সবটাই পাওয়া যায়। কিন্তু তার জন্য লড়াই চালাতে হয়। হাল ছাড়লে যা সম্ভব নয়।
মহিলা হকি দল নিয়ে বলিউডি একটা সিনেমা খুব জনপ্রিয়। শাহরুখের ‘চক দে ইন্ডিয়া’ তুলে ধরেছিল মহিলা হকি খেলোয়াড়দের লড়াইয়ের দিকটা।
রানি রামপাল: আমি দেখেছি সিনেমাটা। এই সিনেমাটা মহিলা হকি নিয়ে একটা সচেতনতার জন্ম দিয়েছিল। সেটাই দুর্দান্ত ব্যাপার। কারণ, মানুষ মহিলা হকি নিয়ে আগ্রহ দেখায় তার পর।
ফিরে আসি অলিম্পিকের কথায়। ২৫ বছর বয়স আপনার। ২২৬ ম্যাচে দেশের হয়ে করে ফেলেছেন ১১২ গোল। খেলরত্নও পাচ্ছেন। কেরিয়ারে অলিম্পিকের পদকই তো যা অধরা রয়েছে এখনও।
রানি রামপাল: অলিম্পিকের পদক সব অ্যাথলিট, সব খেলোয়াড়েরই স্বপ্ন। সব দলই চায় ওই মঞ্চে সফল হতে। চায় দেশের হয়ে সোনা জিততে। আর আমাদের স্বপ্নও তাই। মহিলা হকি দলও সোনার স্বপ্ন দেখছে টোকিয়োয়। দেশের প্রতিটি হকিপ্রেমীর কাছে একটাই আবেদন রাখছি যে আমাদের সাপোর্ট করুন। আপনাদের আশীর্বাদ আমাদের দরকার। আপনারা পাশে থাকুন, আপনাদের মুখে হাসি ফোটাবই আমরা। গর্বিত করবই দেশকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy