জাতীয় পতাকা হাতে ভাবিনাবেন পটেল ছবি পিটিআই।
টোকিয়ো প্যারালিম্পিক্স থেকে টেবল টেনিসে (ক্লাস ফোর) রবিবার ভারতের প্রথম পদক এনেছেন ভাবিনাবেন পটেল। ফাইনালে চিনের ইং ঝৌয়ের কাছে ৭-১১, ৫-১১, ৬-১১ (০-৩) ফলে হেরে রুপো নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে তাঁকে। গুজরাতের এই ক্রীড়াবিদকে রবিবার সন্ধ্যায় যখন ফোনে যোগাযোগ করা গেল টোকিয়োয়, তখন রাত সাড়ে ন’টা বেজে গিয়েছে। দেশ থেকে একের পর এক অভিনন্দনবার্তা ও ফোন আসছে। তার মধ্যেও তিনি সাক্ষাৎকার দিলেন আনন্দবাজারকে।
প্রশ্ন: পাঁচ বছর আগে রিয়ো প্যারালিম্পিক্স থেকে ভারতের প্রথম মহিলা হিসেবে রুপো পেয়েছিলেন দীপা মালিক। তার পরে আপনি দ্বিতীয় মহিলা হিসেবে সেই কীর্তি স্পর্শ করলেন। অভিনন্দন। অনুভূতিটা জানতে চাই।
ভাবিনাবেন: দারুণ অনুভূতি। এই আনন্দের কোনও তুলনা চলে না। তাও আবার প্যারালিম্পিক্সের পদকটা পেলাম জাতীয় ক্রীড়া দিবসে। সারা জীবন এই আনন্দের দিনটা স্মৃতির মণিকোঠায় থেকে যাবে।
প্র: রিয়োতে যেতে পারেননি। সেই দিনটার কথা আজ মনে পড়ছে?
ভাবিনাবেন: পড়বে না কেন? পাঁচ বছর আগে অল্প কিছু পয়েন্টের জন্য রিয়োয় যাওয়া হয়নি। সেই দুঃখ এত দিন বয়ে বেড়িয়েছি। মনে আছে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, পরের প্যারালিম্পিক্সে তো যাবই, যোগ্যতা অর্জনে যেন পয়েন্ট বাধা না হয়ে দাঁড়ায়। সেখান থেকে পদক নিয়ে ফিরতে হবে। তার জন্য যা ত্যাগ স্বীকার করতে হবে, তা-ই করব। পাঁচ বছর ধরে নিষ্ঠা, সংকল্পের সেই গাছটায় নিয়মিত জল, সার দিয়ে গিয়েছি। আজ সেই গাছ ফল দিল।
প্র: তার মানে আপনার স্বপ্ন সফল।
ভাবিনা: ৯০ শতাংশ সফল, তা বলতেই পারেন। কারণ আমার পদকটা রুপো। বাকি ১০ শতাংশ পূর্ণ হয়ে যেত যদি আজ সোনার পদক গলায় ঝুলিয়ে ফিরতে পারতাম। তা এ বার হয়নি। পরের বার বাকি ১০ শতাংশ পূরণ করতে চেষ্টার ত্রুটি থাকবে না।
প্র: ভাদনগরে গ্রামের বাড়িতে সবাই নাচছে। প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতির অভিনন্দন, টানা ফোন বেজে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে না, একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছেন?
ভাবিনাবেন: একদম। তবে ভারতের হয়ে প্যারা টেবল টেনিসে অতীতেও আমি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পদক এনেছি। এমন অভিনন্দনবার্তা আগেও পেয়েছি। কিন্তু আজকের দিনটা আলাদাই বলতে হবে। বিশেষ করে একজনের জন্য।
প্র: কে তিনি?
ভাবিনাবেন: সচিন তেন্ডুলকর!
প্র: সচিন তো টুইট করে আপনাকে অভিনন্দন জানানোর পাশাপাশি দেশে ফিরলে আপনার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। আপনি জানেন সে কথা?
ভাবিনাবেন: কিছুক্ষণ আগেই জেনেছি। প্যারালিম্পিক্সের এই পদক পাওয়া যেমন আমার স্বপ্ন ছিল, তেমন সচিনের সঙ্গে দেখা করার স্বপ্ন মনে লালন করেছি সেই ছোট্ট বয়স থেকে। সচিন তেন্ডুলকর আমার অনুপ্রেরণা। আমার স্বামী নিকুল ক্রিকেট খেলতেন গুজরাতের হয়ে। পার্থিব পটেল ওঁর খুব দারুণ বন্ধু। অনেক বার পার্থিবের কাছে আবদার করেছি সচিনের সঙ্গে দেখা করিয়ে দেওয়ার। কিন্তু সেটা সময়-সুযোগের অভাবে হয়ে ওঠেনি। এ বার মনে হচ্ছে স্বপ্নটা পূর্ণ হবে এই পদকের সৌজন্যে।
প্র: সচিনের সঙ্গে দেখা হলে তাঁকে কী বলবেন?
ভাবিনাবেন: আমার স্বপ্নের নায়ক তেন্ডুলকর সামনে দাঁড়িয়ে আছেন দেখলে কিছুক্ষণ হয়তো কথা বলতেই পারব না! তবে ওঁকে এই পদকটা দেখিয়ে বলব, আমাকে এই পদকটা পেতে প্রেরণা দিয়েছেন আপনি। ওয়ান ডে ক্রিকেটে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ওর সেই ঐতিহাসিক দ্বিশতরান বা শারজায় অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সেই মরুঝড়ের বিধ্বংসী ইনিংস ছোট্ট বয়সে আমাকে কী ভাবে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা দিয়েছে, সে সব গল্প করব ওঁর সঙ্গে। আমি নিশ্চিত, প্যারালিম্পিক্স থেকে সোনা জয়ের জ্বালানি সে দিন আমাকে দিয়ে দেবেন সচিন। আরও অনেক প্রেরণামূলক গল্পও শুনতে পাব ওঁর মুখে।
প্র: ফাইনালে গোটা দেশ ভেবেছিল যে আপনি সোনা জিতবেন। সেখান থেকে ছন্দপতনের কারণটা কী?
ভাবিনাবেন: প্যারালিম্পিক্সে টেবল টেনিসে চিন ও কোরিয়ার খেলোয়াড়দের দাপট বেশি। সেমিফাইনালে শনিবার আমি যাকে হারিয়েছিলাম, সেই মিয়াও ঝ্যাং চিনেরই খেলোয়াড়। ওর কাছে এর আগে ১১ বার হেরেছি। সেমিফাইনাল ম্যাচের পরে আন্তর্জাতিক টেবল টেনিস সংস্থার প্রধান এসে আমাকে বলেন, চিনাদের দাপট শেষ হল তোমার কাছে। দারুণ ব্যাপার। ফাইনালেও এ রকম একটা ম্যাচ দেখতে চাই। বলতে পারেন, এটা কিছুটা আত্মতুষ্ট যেমন করে দিয়েছিল আমাকে, তেমনই কিছুটা স্নায়ুর চাপও তৈরি করেছিল। বলতে লজ্জা নেই রবিবার সকালে ঘুম থেকে উঠে ধ্যান করেও যা থেকে আমি মুক্ত হতে পারিনি। ভাববেন না, বিপক্ষে চিনের খেলোয়াড় ছিল বলে কুঁকড়ে গিয়েছিলাম। প্রত্যাশার চাপ আজ সামলাতে পারিনি বলেই রুপো এসেছে। কারণ ফাইনালে ইং ঝৌয়ের খেলার ভিডিয়ো দেখে আমি অনেক পরিকল্পনা সাজিয়েছিলাম। জানতাম ও কী ভাবে আক্রমণে আসে। কী ভাবে বিপক্ষের শরীরের দিকে বলগুলো ঠেলে দিয়ে পয়েন্ট নেয়। কিন্তু আজ আমি চাপ সামলাতে পারিনি। এই জায়গায় আরও উন্নতি করতে হবে আগামী দিনে।
প্র: আপনার কোচ সঙ্গে যেতে পারেননি। তিনি টোকিয়োতে যদি পাশে থাকতেন, তা হলে কি আজ অন্য রকম ফল হতে পারত?
ভাবিনাবেন: না, তা মনে করি না। কোচের সঙ্গে সব সময়েই যোগাযোগ ছিল। তিনি প্রত্যেকটি ম্যাচে নজর রাখছিলেন দেশে বসেই। নিজের ভুলেই এই হার।
প্র: আজ সেই মুখগুলো মনে পড়ছে, যাঁরা গ্রামে, স্কুলে, কলেজে আপনার দ্বারা কিছু হবে না বলেছিলেন?
ভাবিনাবেন: জন্মের পরে যে দিন থেকে আমার জ্ঞান হয়েছে, সে দিন থেকেই আমি জানি প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে এগোতে হবে। নেতিবাচক কথা জীবনে অনেকেই বলেছেন। ছোট বয়সে সেগুলো মনে সাময়িক প্রভাব ফেলত। কিন্তু বলতে দ্বিধা নেই, আজ সেগুলোর মূল্য আমার কাছে নেই। গত ১৫ বছরে আমি প্রমাণ করতে পেরেছি, যদি একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখে নিষ্ঠার সঙ্গে এগোনো যায় তাহলে জীবনে অসম্ভব বলে কিছু হয় না।
প্র: সে সব লড়াইয়ের দিনগুলোর কথা যদি বলেন।
ভাবিনাবেন: ভারতে সাধারণ মানুষেরই ভিড় বাসে উঠতে কতটা কষ্ট হয়, তা নিশ্চয়ই আপনার জানা। একটা সময়ে দিনের পর দিন আমি দু’টো ভিড় বাস বদল করে অনুশীলনে গিয়েছি। টেবল টেনিসের জন্য আমি জীবনে সব ত্যাগ স্বীকার করতে রাজি আছি। ২০১০ সালে প্যারা কমনওয়েলথ গেমস থেকে পদক আনার পরে গত ১১ বছর ধরে নিজেকে প্রত্যেকদিন একটু একটু করে ঘসেমেজে নিয়েছি এই প্রতিযোগিতার পদকের জন্য।
প্র: অতিমারির সময়ে অনুশীলন করেছিলেন কী ভাবে?
ভাবিনাবেন: ২০১৮ সালে এশিয়ান গেমসের পরে আমাকে সাই থেকে প্যারা টেবল টেনিস অনুশীলনের জন্য বিশেষ টেবল, রোবট সব দেওয়া হয়েছিল। তাই ঘরেই অনুশীলন করেছি। কোনও সমস্যা হয়নি অতিমারির সময়ে। কেবল টোকিয়োর প্রস্তুতির জন্য স্পেনে গিয়েছিলাম কয়েক দিনের জন্য। সেটা এই বছরের প্রথম দিকে। তখন অনেকেই যেতে না করেছিলেন। কিন্তু আমি সে সব পাত্তা দিইনি। স্বামীকে নিয়েই চলে গিয়েছিলাম স্পেনে। বললাম না, এই টেবল টেনিস খেলাটার জন্য আমি সব কিছু করতে রাজি!
প্র: বিভিন্ন দুর্ঘটনা বা জন্ম থেকেই প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে যাঁরা বেড়ে উঠছেন ভারত-সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, তাঁদের জন্য আপনার বার্তা কী?
ভাবিনাবেন: জীবনে সব কিছুই সম্ভব। দরকার সংকল্প। ব্যর্থতা, অপমান তো আসবেই। অন্ধকার গায়ে না মাখলে আলো আসে না। ঘাম ও রক্ত এক করে পরিশ্রম করলে সাফল্য আপনার দরজায় কড়া নেড়ে যাবেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy