দিলীপ বেঙ্গসরকরের মতে ম্যাচ জেতানোর নিরিখেই গাওস্করের চেয়ে টেস্টে এগিয়ে থাকবেন কোহালি।
লর্ডসের লর্ড বলেই দিলীপ বেঙ্গসরকরকে চেনে ক্রিকেটবিশ্ব। লর্ডসে তাঁর তিনটি টেস্ট সেঞ্চুরি এখনও সফরকারী ব্যাটসম্যান হিসেবে নজির। প্রাক্তন জাতীয় অধিনায়ক একসময় ছিলেন নির্বাচকমণ্ডলীর চেয়ারম্যানও। একসময়ে ছিলেন বোর্ডের ট্যালেন্ট রিসার্চ ডেভেলপমেন্ট উইংয়েরও চেয়ারম্যান। ভারতীয় ক্রিকেটের ‘কর্নেল’ খেলেছেন ১১৬ টেস্ট এবং ১২৯টি ওয়ান ডে। দুই ফরম্যাট মিলিয়ে রান ১০,০০০-এর বেশি। টেস্টে গড় ৪২.১৩। মোট ১৭টি শতরান। আরবসাগরের পার থেকে তিনি আনন্দবাজার ডিজিটালকে যে সাক্ষাৎকার দিলেন, তা মেজাজে সহবাগ-সুলভ ধুমধাড়াক্কার সঙ্গে তুলনীয়।
প্রশ্ন: আইপিএলে প্রতিভা অণ্বেষণের জন্য বিখ্যাত আপনি। আপনার নজর এবার কোন তরুণ প্রতিভার দিকে?
দিলীপ বেঙ্গসরকর: আইপিএল অনেকের কাছেই একটা বড় সুযোগ। এটা তো ঘরোয়া প্রতিযোগিতা নয়। এটা এখন বিশ্বপর্যায়ের মঞ্চ। তাই যে এক্সপোজার পাওয়া যাবে, তার সঙ্গে দ্রুত ধাতস্থ হয়ে উঠতে হবে। মঞ্চটাকে কাজে লাগাতে হবে। ভারত-এ দল এবং অনূর্ধ্ব-১৯ দলের অনেকে খেলবে আইপিএলে। যশস্বী জয়সওয়াল, সিএসকে-র ঋতুরাজ গায়কোয়াড়, শুভমন গিলরা সকলেই ভাল। আর সেটা তুলে ধরার সুযোগ কেউ যেন না হারায়। বরং দু’হাতে সেটা আঁকড়ে ধরুক। কারণ, আইপিএলের মতো মঞ্চ আর রোজ রোজ মেলে না। এটা ঈশ্বরপ্রেরিত সুযোগ। আমি নিশ্চিত, নিজেদের প্রমাণ করার জন্য সকলেই উপযুক্ত প্রস্তুতি নিয়েছে।
প্রশ্ন: কোভিড পরিস্থিতিতে দীর্ঘদিন ব্যাট-বল থেকে দূরে ছিলেন ক্রিকেটাররা। ক্রিকেট তো এমন নয় যে, ফিটনেস থাকলেই ব্যাটে টাইমিং ফিরবে বা আউটসুইং জায়গামতো পড়বে। ঘরবন্দি কয়েক মাসের পর ছন্দে ফেরা কতটা কঠিন?
বেঙ্গসরকর: কঠিন। ইট বিকামস ডিফিকাল্ট। এরা পাঁচ-ছ’মাস কোনও ম্যাচ খেলেনি। ফলে কাজটা খুব কঠিন। ২২ গজে নেমে খেলার সঙ্গে কোনওকিছুর তুলনা হয় না। সেটা অত্যন্ত জরুরি। তা সে আপনি যতই ফিট হোন, যতই জিমে লাগাতার হাঁটাহাঁটি করুন বা আপনাকে যতই তরতাজা দেখাক। ম্যাচে খেলার মজা, চ্যালেঞ্জ, পরীক্ষা একেবারে আলাদা। মাঠে নেমে লম্বা একটা ইনিংস খেলা, রানিং বিটুইন দ্য উইকেটসে অংশ নেওয়া বা কয়েক ওভার হাত ঘোরানো পুরোপুরি অন্য অভিজ্ঞতা। তার সঙ্গে ফিটনেসের ততটা সম্পর্ক নেই। আবার বলছি, ম্যাচ না খেলা আর ম্যাচ-প্র্যাকটিসে থাকার মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক। ইট মেকস লট অফ ডিফারেন্স। তাই মাঠে নেমে সময় কাটানো ক্রিকেটে খুব জরুরি।
প্রশ্ন: আইপিএলের পর বিরাট কোহালিরা যাচ্ছেন অস্ট্রেলিয়ায়। সেই সফরের জন্য কাদের দিকে নির্বাচকদের লক্ষ্য থাকা উচিত?
বেঙ্গসরকর: অস্ট্রেলিয়ায় ভারত টেস্ট সিরিজ খেলবে। যা আইপিএলের থেকে একেবারেই আলাদা ফরম্যাট। টেস্টে সব সময়ই স্পেশালিস্টের প্রয়োজন পড়ে। উইকেটকিপার বা যে কোনও পজিশনেই দরকার হয় বিশেষজ্ঞের। পাঁচ দিন ধরে পরীক্ষা দিতে হয়। ফলে কাজ-চালানো কাউকে দিয়ে চলে না। যেমন মেক-শিফট উইকেটকিপার দিয়ে টেস্টে হবে না। একটা খোঁচা মিস করলেই তো চড়া মাসুল দিতে হবে। যা কোনও ভাবেই অ্যাফোর্ড করা যায় না। যার ক্যাচ মিস হল, সে-ই হয়তো ম্যাচ ঘুরিয়ে দিয়ে চলে গেল! আমার মনে হয়, টেস্টের কাজটা স্পেশালাইজড জব। সেটা মাথায় রেখেই দল বেছে নেবেন নির্বাচকরা।
প্রশ্ন: অস্ট্রেলিয়ায় কেমন খেলবে ভারত? আগের বার ব্র্যাডম্যানের দেশে ইতিহাস গড়ে ভারত টেস্ট সিরিজ জিতেছিল। এবার কিন্তু স্টিভ স্মিথ, ডেভিড ওয়ার্নাররা ফিরে এসেছেন দলে।
বেঙ্গসরকর: আশা করছি ভারত ভাল খেলবে এবং সিরিজ জিতবে। অস্ট্রেলিয়া অবশ্যই ভাল দল। বিশেষত, স্মিথ-ওয়ার্নাররা ফেরার পর। বাট ইন্ডিয়া লুকস মাচ বেটার টিম। ‘মাচ বেটার’ যদি না-ও হয়, কাগজকলমে ভারত অবশ্যই বেটার দল। নিজেদের ক্ষমতা অনুসারে খেলতে পারলে অস্ট্রেলিয়াকে হারাবে ভারত।
আরও পড়ুন: অলিম্পিকে সোনা জেতাই লক্ষ্য, এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারে বললেন পিভি সিন্ধু
প্রশ্ন: ভারত শেষ বার টেস্টে খেলেছিল নিউজিল্যান্ডে। দুটো টেস্টেই হারতে হয়েছিল। কোহালির কথায় পেসারদের নিয়ে উদ্বেগ ফুটে উঠেছিল। এবার অস্ট্রেলিয়ার গতিময় উইকেটের কথা মাথায় রেখে কি এক্সপ্রেস বোলার নেওয়ার উপর জোর দেওয়া উচিত?
বেঙ্গসরকর: এটা পুরোপুরিই নির্বাচকদের ব্যাপার। জানি না ওদের মনে কোন স্ট্র্যাটেজি রয়েছে। আমি তো এখন কারা নির্বাচক সেটাও জানি না!
প্রশ্ন: যাঁরা নির্বাচক ছিলেন তাঁরাই আছেন।
বেঙ্গসরকর: মুশকিল হল, এই নির্বাচকদের কতটা অভিজ্ঞতা আছে বা তারা অস্ট্রেলিয়ার কন্ডিশন সম্পর্কে কতটা জানে, সেই ব্যাপারে আমার কোনও ধারনা নেই। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এই নির্বাচকরা নিজেরা কেমন খেলেছিলেন, কতটা খেলেছিলেন, সেটাও আমার অজানা। আই ডোন্ট নো হু দে আর অ্যাকচুয়ালি অ্যাট দ্য মোমেন্ট। তবে যারাই নির্বাচক থাকুক, তাদের অবিলম্বে একটা রণকৌশল গড়ে ফেলতে হবে। সেইমতো দল গড়তে হবে। কম্বিনেশন গড়ার সময় স্ট্র্যাটেজিটা যেন প্রতিফলিত হয়। ভাবতে হবে ওখানকার কন্ডিশনে কারা সফল হতে পারে।
অস্ট্রেলিয়ায় টেস্ট সিরিজে ভারতেরই জেতা উচিত বলে মনে করছেন বেঙ্গসরকর। —ফাইল চিত্র।
প্রশ্ন: অস্ট্রেলিয়ায় ভারতের স্পিন আক্রমণ কেমন হবে, সেটা নিয়েও তো ধোঁয়াশা আছে। একমাত্র স্পিনারে খেলা হলে কে খেলবেন? রবিচন্দ্রন অশ্বিন, রবীন্দ্র জাডেজা নাকি কুলদীপ যাদব?
বেঙ্গসরকর: আমি জানি না। সেটাই তো বলছি। নির্বাচকদের ভাবনার আন্দাজ মিলছে না। ওরা প্রচুর ম্যাচ দেখে। তাই সেটার উপর নির্ভর করেই দল গড়বে নিশ্চয়ই। তবে আবার বলছি, নির্বাচকদের কতটা ভিশন আছে, সেটাই আমার জানা নেই। তারা কতটা জানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট, কতটা অভিজ্ঞতা রয়েছে, সেটাও অজানা। তবে ওরা যেহেতু গাঙ্গুলি অ্যান্ড কোম্পানির দ্বারা নিযুক্ত, তাই অবশ্যই এই কাজের জন্য ওরাই সঠিক লোক!
প্রশ্ন: অনেকেই মনে করেন সচিন তেন্ডুলকরের ১০০ সেঞ্চুরি বা মোট রানের রেকর্ড একমাত্র বিরাট কোহালিরই ভাঙার ক্ষমতা আছে। কিন্তু করোনা অতিমারি কি কোহালির পথ আরও দুর্গম করে দিল না? কেরিয়ার থেকে কার্যত একটা গোটা বছরই তো হারিয়ে গেল!
বেঙ্গসরকর: ভবিষ্যতে কী হবে তা বলতে পারছি না। বিরাট কোহালি কেমন খেলবে, কত দূর যাবে, সেই ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব নয়। তবে এটা নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই যে ও ফ্যান্টাস্টিক ক্রিকেটার! ও-ই এক নম্বর ব্যাটসম্যান। পাশে রাখতে হবে রোহিত শর্মাকেও। ইউ এক্সপেক্ট গ্রেট থিংস ফ্রম হিম। সেই প্রত্যাশা কতটা পূর্ণ করতে পারবে জানি না। আমি শুধু আশা করব, কোহালি যেন দেশকে প্রচুর ম্যাচ জেতায়। এই কথাটা খুব জরুরি— দেশকে জেতানো। আর এটাই বিরাটের থেকে সকলের চাহিদা।
আরও পড়ুন: দেশের হয়ে অলিম্পিক পদক জিততে চাই, এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারে বললেন সানিয়া মির্জা
প্রশ্ন: সাদা বলের ক্রিকেটে হিটম্যান রোহিত কী করতে পারেন, তা কারও অজানা নয়। কিন্তু দেশের বাইরে অস্ট্রেলিয়াতেই প্রথম টেস্টে ওপেন করবেন রোহিত। অস্ট্রেলিয়ার বাউন্সি উইকেট কি রোহিতের ব্যাটিং স্টাইলের পক্ষে বেশি সহায়ক হবে? অন্তত নিউজিল্যান্ড বা ইংল্যান্ডের মতো তো নতুন বল অতটা সুইং করবে না।
বেঙ্গসরকর: রোহিত, বিরাটরা অভিজ্ঞ ক্রিকেটার। ওরা অস্ট্রেলিয়ায় অনেক বার গিয়েছে। ওখানকার কন্ডিশনে লম্বা খেলেছে। জানে কোন শট কখন নিতে হবে। কোন শট নেওয়া উচিত হবে না বা কী ভাবে একটা ইনিংস গড়ে তুলতে হবে। দে আর এক্সপিরিয়েন্সড প্লেয়ার্স। দে উইল অ্যাডপ্ট ভেরি কুইকলি। অস্ট্রেলিয়ার কন্ডিশনে ওদের কোনও সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
প্রশ্ন: গত অর্ধশতাব্দীতে উইজডেন তাদের অনলাইন সমীক্ষায় ভারতের সেরা টেস্ট ব্যাটসম্যান হিসেবে রাহুল দ্রাবিড়কে বেছে নিয়েছে। আপনার পছন্দ কে?
বেঙ্গসরকর: আমার পছন্দ সচিন। তবে প্রত্যেকেরই নিজস্ব মতামত থাকতে পারে। আমার মতে অবশ্য দ্রাবিড় নয়, গত ৫০ বছরে ভারতের সেরা টেস্ট ব্যাটসম্যান সচিন। আমার দেখা সেরা ব্যাটসম্যান ও-ই। সচিনের পরেই বিরাট। তার পর সুনীল গাওস্কর আর রাহুল দ্রাবিড়।
প্রশ্ন: আপনার মতে সচিনের পর কোহালি?
বেঙ্গসরকর: হ্যাঁ। তিনে গাওস্কর আর চারে দ্রাবিড়।
প্রশ্ন: গাওস্করের চেয়েও টেস্ট ক্রিকেটে এগিয়ে থাকবেন বিরাট? কেন?
বেঙ্গসরকর: দেখুন, এক-দুই-তিন-চারের মধ্যে কিন্তু তফাত খুব বেশি নেই। যতই শুনতে এমন লাগুক। আবার বলছি, দেয়ার ইজ নট মাচ ডিফারেন্স বিটুইন দিস ফোর! অফ কোর্স, সচিন অজস্র ম্যাচ জিতিয়েছে। একই কথা খাটে বিরাটের ক্ষেত্রেও। তুলনা করলে গাওস্কর আর দ্রাবিড়ের চেয়ে ম্যাচ জেতানোর মাপকাঠিতে সচিন-কোহালি অনেকটাই এগিয়ে। গাওস্কর ছিল ওপেনিং ব্যাটসম্যান। ফলে সব সময়ই নতুন বলের মোকাবিলা করতে হতো। দ্রাবিড় হল নাম্বার থ্রি ব্যাটসম্যান। ওপেনার আর তিন নম্বরের মধ্যে বিশেষ ফারাক থাকে না। সচিন-বিরাটরা হল ব্যাটিং অর্ডারে চার নম্বর।
প্রশ্ন: ধোনির অবসরের টাইমিংয়ে কি গোলমাল হল? বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে জেতাতে না পারার পর ক্রিকেটকে বিদায় জানানোটা ভাল হতো না?
বেঙ্গসরকর: ভারতীয় ক্রিকেটে সর্বকালের গ্রেট প্লেয়ারদের অন্যতম ধোনি। ও জানে, কতদিন খেলতে হয়। কখন ব্যাট-প্যাড তুলে রাখতে হয়। সব গ্রেটরাই জানে কখন অবসর নিতে হয়। নিজেদের কখন প্রাক্তনদের কক্ষপথে আসার সময় হয়ে উঠেছে, এটা ওরা নিজেরাই উপলব্ধি করতে পারে। ধোনি নিশ্চয়ই টের পেয়েছে, যে এখনই অবসর নেওয়ার উপযুক্ত সময়। তাই এখনই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy