বন্দিত: অজিঙ্ক রাহানের নেতৃত্ব ভঙ্গি জিতে নিয়েছে হৃদয়। ফাইল চিত্র
রাগেন না, মুখে সব সময়ে লেগে রয়েছে হাসি। এমন লোক অস্ট্রেলিয়ায় নেতৃত্ব দেবেন কী ভাবে? ৩৬ অলআউটের পরে সেই চর্চা আরও বেড়ে যায়। সব সংশয়, সব তির্যক মন্তব্যকে উড়িয়ে অস্ট্রেলিয়ায় ঐতিহাসিক সিরিজ জয়। বিশ্বের বন্দনা জিতে নেওয়া অজিঙ্ক রাহানে একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন আনন্দবাজারকে...
প্রশ্ন: ঐতিহাসিক সিরিজ জয়ের জন্য আন্তরিক অভিনন্দন। প্রথমেই জানতে চাইব, ৩৬ অলআউটের পরে মিশন মেলবোর্ন কী ভাবে সম্ভব হল?
অজিঙ্ক রাহানে: অ্যাডিলেডে কী হয়েছে, সবাই দেখেছে। যে যার মতো তা বিশ্লেষণও করেছে। আমাদের নিজেদের চোখেও একটা ব্যাখ্যা ছিল। আর তা হচ্ছে, প্রথম দু’দিন অ্যাডিলেডে আমরা যথেষ্ট ভাল ক্রিকেট খেলেছিলাম। তৃতীয় দিনের একটা ঘণ্টার খারাপ ক্রিকেট আমাদের বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেয়। আমরা ঠিক করি, ওই খারাপ মুহূর্তটা নিয়ে ভাবব না। কেন ভাবব? শুধু ওই একটা ঘণ্টাই তো আমাদের দলের পরিচয় নয়। অনেক ভাল ক্রিকেট আমরা খেলেছি গত কয়েক বছর ধরে। তাই এক ঘণ্টার অন্ধকার নয়, আলোকিত দিকগুলো মাথায় রেখে এগোব বলে আমরা ঠিক করে নিই।
প্র: ছেলেদের কী বলেছিলেন?
রাহানে: বলেছিলাম, সকলে ইতিবাচক থাকো। মেলবোর্নে আমাদের রেকর্ড দারুণ। গত বারের সফরে এসেও মেলবোর্নে বক্সিং ডে টেস্ট জিতেছিলাম আমরা। সিরিজে প্রত্যাবর্তন করার মন্ত্রটা আমরা এ রকমই রেখেছিলাম— ইতিবাচক থেকে নিজেদের সেরাটা উজাড় করে দাও। আমি গর্বিত, গোটা দল যে ভাবে তা করে দেখিয়েছে।
প্র: কিন্তু সেই সময়ে দাঁড়িয়ে বিশ্বাস ফেরানোর কাজটা কতটা কঠিন ছিল? সদ্য ৩৬ অলআউট হয়ে গিয়েছে একটা দল। কোহালির মতো তারকা ফিরে আসছেন...
রাহানে: বিরাট যে অ্যাডিলেড টেস্টের পরে ফিরে আসবে, তা তো আমরা সফরের শুরু থেকেই জানতাম। সেই মানসিক প্রস্তুতিটা তত দিনে তাই নেওয়াই ছিল। এটাও জানতাম যে, মেলবোর্ন থেকে আমাকে অধিনায়কত্ব করতে হবে। তাই খুঁটিনাটি সব পারফরম্যান্সে লক্ষ্য রাখছিলাম। পরিকল্পনা, রণনীতি করাও শুরু করি। আমার মনে হয়, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে সিরিজ জেতার জন্য পরিকল্পনা ও ‘ভিজ়্যুয়ালাইজ়েশন’ (মনে মনে সাফল্যের ছবি আগাম দেখা) লাগে। আমরা জানতাম, বিশ্বাস না হারালে সিরিজ জয় সম্ভব। হ্যাঁ, ৩৬ অলআউটের পরেও পারব যদি বিশ্বাসটা না হারাই। আমার মনে হয়, সিরিজ জয় নিজেদের উপরে বিশ্বাস না হারানোরই পুরস্কার।
প্র: অনেকের মতে সিরিজের টার্নিং পয়েন্ট মেলবোর্নে আপনার সেঞ্চুরি। চাপের মুখে ব্যাট করতে এসে কী চলছিল মনের মধ্যে?
রাহানে: সিরিজে ০-১ পিছিয়ে ছিলাম আমরা। জানতাম, প্রত্যেকটা পদক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ হতে যাচ্ছে। এমসিজি-তে (মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ড) আকাশ মেঘলা করে এসেছিল। অস্ট্রেলীয় পেস ব্যাটারি দুরন্ত গতিতে বল করছিল। সত্যিই কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছিল ওরা। আমি নিজেকে একটাই কথা বলেছিলাম— জিঙ্কস, সব আক্রমণের সামনে অবিচল ভাবে দাঁড়িয়ে বড় স্কোর করতেই হবে। যোগ্য জবাব দিতে হবে ওদের। কিছুতে উইকেট দেওয়া চলবে না।
প্র: এই সেঞ্চুরিটাকে ঘিরে যে আবেগ, যে আনন্দ রয়েছে, তা ক্রিকেট মাঠে আর কোনও ইনিংস খেলে পেয়েছেন?
রাহানে: সেঞ্চুরিটা করার পরে তখন আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়, এটাই আমার সেরা ইনিংস কি না? আমি বলেছিলাম, লর্ডসের সেঞ্চুরিটা এর চেয়ে ভাল। সত্যি বলছি, তখন বুঝতে পারিনি এত মানুষকে এই ইনিংসটা ছুঁয়ে গিয়েছে। সিরিজ জেতার পরে দেখলাম, অনেকেই এই ইনিংসটা নিয়ে কথা বলছে। এখন তাই মনে হচ্ছে, এটাই আমার জীবনের সেরা সেঞ্চুরি।
প্র: মেলবোর্নে ব্যাট করার সময়ে উদাহরণ হিসেবে কারও কথা ভাবছিলেন? বা কোনও ইনিংস উদ্বুদ্ধ করেছিল?
রাহানে: মেলবোর্নে সচিন তেন্ডুলকরের সেই বিখ্যাত ১১৬ (১৯৯৯-এর সফরে করা) আমি অনেক বার দেখে খেলতে নামি। সেটাই ছিল আমার সামনে উদাহরণ। ওই ম্যাচটায় সচিনও ছিল অধিনায়ক। আমি অনলাইনে পাঁচ-ছ’বার সেই ইনিংসটা দেখে খেলতে নেমেছিলাম। নিজেকে বলেছিলাম, এ রকম ধরনের কিছু আমাকেও করে দেখাতে হবে।
প্র: এই সফরে নবীনদের জয়জয়কার। মহম্মদ সিরাজ, টি নটরাজন, ওয়াশিংটন সুন্দর, শুভমন গিল। তরুণদের আগমন নিয়ে কী বলবেন?
রাহানে: ক্রিকেট পাল্টেছে। ওরা আইপিএলের মতো প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ প্রতিযোগিতায় খেলছে। যেখানে প্রবল চাপ নিতে হয়, সেরা বিদেশি তারকাদের সঙ্গে সমানে-সমানে লড়তে হয়। ‘এ’ দলের সফর রয়েছে। যা এখন অনেক নিয়মিত ভাবে হয়। আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রবেশের আগেই তাই ওরা তৈরি হয়ে যাচ্ছে। তবে হ্যাঁ, টেস্ট ম্যাচের চাপ অন্য রকম। তার সঙ্গে কোনও কিছুর তুলনা হয় না। এই চাপটা যে ওরা বুক চিতিয়ে এই ভাবে সামলেছে, তার জন্য নবীন ব্রিগেডের সর্বোচ্চ কুর্নিশ প্রাপ্য।
প্র: অধিনায়ক হিসেবে তরুণদের উদ্দেশে আপনার বার্তা কী ছিল?
রাহানে: আমি কিন্তু ওদের খুব অনভিজ্ঞ হিসেবে দেখতে চাইনি। ওদের সঙ্গে বিভিন্ন কথোপকথনে বরং এটাই মনে হয়েছিল, ওরা তৈরি। প্রত্যেককেই আমি একটা কথা বলেছিলাম। নিজের উপরে বিশ্বাস রেখে সহজাত খেলাটাই খেলো। সেটা করতে পারলেই সাফল্য আসবে। সকলে দারুণ ভাবে নিজেদের সেরা খেলাটা তুলে ধরতে পেরেছে।
প্র: যখন দেখছিলেন, একের পর এক সৈন্য চোট পেয়ে ছিটকে যাচ্ছেন, তখনও চিন্তা হয়নি?
রাহানে: ওই যে বললাম, শুরুতেই আমরা ঠিক করে নিয়েছিলাম, ইতিবাচক ভাবব। ৩৬ অলআউটের মধ্যে পড়ে থাকলে কী করে এগোব? যে বেরিয়ে যাচ্ছে, তার জন্য আমাদের মন খারাপ হচ্ছিল ঠিকই। পাশাপাশি, আর এক জনের সামনে যে সুযোগের দরজা খুলে যাচ্ছে, সেটাও বোঝানোর চেষ্টা হচ্ছিল। শুনুন, নতুনদের স্কিল নিয়ে আমাদের কোনও সন্দেহ ছিল না। প্রশ্নটা ছিল, চাপের মুখে ওরা নিজেদের সেই নৈপুণ্য মেলে ধরতে পারে কি না। ওরা সেটা পেরেছে। শুভমন, ঋষভ, সিরাজ, নটরাজন, সাইনি প্রত্যেকে পেরেছে।
প্র: কিন্তু এটাই বা কী ভাবে সম্ভব যে, যাঁর হাতে ইন্ডিয়া ক্যাপ তুলে দিচ্ছেন, তিনিই বাজিমাত করে দিচ্ছেন!
রাহানে: সম্ভব হচ্ছে কারণ ভারতীয় ক্রিকেটের রিজ়ার্ভ বেঞ্চ শক্তি এখন দারুণ। কী সব ক্রিকেটার বেরচ্ছে দেখুন। ভয়ডরহীন ভাবে ওরা যে কারও চোখে চোখ রেখে জিতিয়ে দিতে পারে! ওরা প্রত্যেকে খুব ভাল ছাত্র। দ্রুত শিখে নিচ্ছে। ‘এ’ দলের সফর তরুণদের অনেক তৈরি করে দিচ্ছে।
প্র: রবি শাস্ত্রী বলেছেন, অধিনায়ক হিসেবে শান্ত, ধীরস্থির ধরনের আপনি। কিন্তু ভিতরে আগুন জ্বলছে। এই শীতল আগ্রাসন কী ভাবে এসেছে?
রাহানে: আমি ছোটবেলা থেকেই তো এ রকম। প্রত্যেকটা চরিত্র আলাদা হয়। বরাবর আমি বিশ্বাস করেছি, নিজের যা রাগ আছে ব্যাট বা বলের মাধ্যমে তার প্রকাশ ঘটাও। অন্য কোনও ভাবে নয়। সেই বয়সভিত্তিক প্রতিযোগিতা থেকে এটাই আমার মনোভাব। তাই অস্ট্রেলিয়ায় নতুন কোনও অজিঙ্ক ছিল না।
প্র: ব্রিসবেনকে বলা হত অস্ট্রেলিয়ার দুর্গ। ৩২ বছর সেখানে তারা হারেনি। ভারত কখনও টেস্ট জেতেনি। মাত্র একটা ড্র করতে পেরেছে। বাকি সবই হার। এমন একটা মাঠে খেলতে নামার আগে শুনলেন, হনুমা বিহারী ও অশ্বিনও ছিটকে গিয়েছেন। মনে হয়নি, এমন ভাঙাচোরা দল নিয়ে দুর্ভেদ্য দুর্গে কী ভাবে লড়ব?
রাহানে: এক বারের জন্যও মনে হয়নি। সিডনি টেস্ট ড্র করার পুরো কৃতিত্ব দিতে হবে বিহারী ও অশ্বিনকে। দু’জনেই চোট নিয়ে খেলেছিল। অনমনীয় জেদ আর অসহ্য যন্ত্রণা নিয়েও ওরা ম্যাচ ড্র করে তবেই মাঠ ছেড়েছিল। ওদের জন্য কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। পাশাপাশি, এটাও আমাদের মনে হয়েছিল যে, ওদের লড়াইকে সম্মান দেওয়া যায় এক ভাবেই। যদি ব্রিসবেনে ওদের অনুপস্থিতিতে ওদের লড়াইটা আমরা সকলে মিলে দেখাই।
প্র: মাঠের বাইরেও তো নানা রকম ঘটনা ঘটছিল। নিভৃতবাস পর্ব মানার পরেও সিডনি, ব্রিসবেনে বলা হল, হোটেলে বন্দি হয়ে থাকতে হবে। সিডনিতে সিরাজদের উদ্দেশে বর্ণবৈষম্যমূলক মন্তব্য উড়ে এল। এ সবের কী প্রভাব পড়ছিল দলের উপরে? জেদ কি আরও বাড়ছিল?
রাহানে: সিরাজ যখন আমাকে এসে বলল, গ্যালারি থেকে আজেবাজে কথা বলছে, আম্পায়ারকে তৎক্ষণাৎ বলি, এর বিহিত চাই। এ সব একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। আম্পায়ার বলেন, চাইলে আমরা মাঠ ছেড়েও চলে যেতে পারি। আমি তা চাইনি। আম্পায়ারকে বলি, আমরা এখানে ক্রিকেট খেলতে এসেছি। মাঠ ছেড়ে চলে যেতে নয়। যারা দুর্ব্যবহার করছে, তাদের সরিয়ে দেওয়া হোক।
প্র: সিরিজের একমাত্র সময় যখন অধিনায়ক রাহানে রেগে গিয়েছিলেন?
রাহানে: রাগের চেয়েও বেশি করে একটা অবস্থান নেওয়ার ব্যাপার ছিল। এমন আচরণ মেনে নেওয়া যায় না। আর অধিনায়ক হিসেবে আমার দায়িত্ব নিজের সতীর্থদের পাশে দাঁড়ানো।
প্র: ২০১৯ বিশ্বকাপে সুযোগ না পাওয়া। গত কয়েক বছরে টেস্ট দলেও নানা সময়ে পরীক্ষার মধ্যে পড়া। নিজেকে প্রমাণ করার বাড়তি তাগিদ কি ছিল এই সফরে?
রাহানে: জীবনে উত্থান-পতন থাকবে। একটা সময়ে খারাপ লেগেছিল, ২০১৯ বিশ্বকাপে খেলতে না পেরে। এখন আর সে সব নেই। জীবন এগিয়ে গিয়েছে। বুঝতে শিখেছি, প্রত্যেক দিন নিজেকে পরীক্ষা দিয়ে যেতে হয়। এটাই জীবন। পুরো কেরিয়ার ধরে নিজের যোগ্যতা, দক্ষতা প্রমাণ করে যেতে হবে। সেটাই করে যাব আমি। অভিযোগ নেই।
প্র: ব্রিসবেনে শেষ দিনে কী পরিকল্পনা করে নেমেছিল দল?
রাহানে: ঠিক ছিল, পুজারা আর গিল ওদের নিজেদের ভঙ্গিতে ব্যাট করবে। তার পরে আমি একটু আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করার চেষ্টা করব। চায়ের কুড়ি মিনিট আগে আমি আউট হয়ে গেলাম। ঋষভকে বলি, চা-পানের বিরতি পর্যন্ত দেখে দেখে খেলো। ঋষভ শুনেছিল। চা-পানের পরে ওর নিজের খেলা খেলতে শুরু করে। ওয়াশিংটন লুন্দর নেমে খুব ইতিবাচক ইনিংস খেলল। সকলের মিলিত অবদানেই একমাত্র এমন টেস্ট জয় সম্ভব হয়!
প্র: ঐতিহাসিক সিরিজ জয়ের পরে ফিরে যাবেন সহ-অধিনায়কের ভূমিকায়। মানিয়ে নেওয়া কত কঠিন?
রাহানে: আমি এ ভাবে ভাবিই না। বিরাটের অনুপস্থিতিতে আমার দায়িত্ব ছিল দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার এবং সেরা ফলের জন্য ঝাঁপানো। সেটা করতে পেরেই আমি আনন্দিত, গর্বিত। এ বার দেশের মাঠে ইংল্যান্ড সিরিজ। বিরাট অধিনায়ক, আমি ওর ডেপুটি। একদম ঠিক আছে। আমরা একে অন্যকে সব সময় সমর্থন করি। ক্রিকেট দলগত খেলা। যে সাফল্যটা আমরা পাই, তা দলগত প্রচেষ্টার ফল। শুধু খেলোয়াড়রা নয়, কোচেদেরও অনেক ভূমিকা থাকে। তাঁরাও এই দলের খুব গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। আমি কখনও অধিনয়াকত্ব লিপ্সায় ভুগিনি। দল বা ক্রিকেট বোর্ড আমাকে যে ভূমিকা দেবে, তাতেই নিজের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করব। দেশের তেরঙ্গা পতাকা উঁচুতে তুলে ধরতে চাই। এটাই এক এবং একমাত্র লক্ষ্য। ছিল, থাকবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy